মোবাইল ফোনে দাওয়াত দেওয়ার এই স্টাইলটার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর মতো আধুনিক হতে পারেনি আহাদ হাজি। কেমন জানি আদবকায়দাহীন দায়ের মতো লাগে বিষয়টা। বিনা কারণে যাদের কাছে খুব একটা যাওয়া হয় না, একটা উপলক্ষ তৈরি হলে সেই সুযোগে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দুদণ্ড বসে দু–চারটা সুখ–দুঃখের আলাপসালাপ হয়। বাপ-দাদার আমলের এই রীতি ভেঙে আধুনিকতার গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। তাই আহাদ হাজি দোকানে দোকানে সশরীর হাজির হয়ে গোটা চার–পাঁচেক মুরব্বিকে বলে এসেছেন। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, আহাদ হাজির বাড়ির প্রথম বিয়ে ইত্যাদি নানাবিধ অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা বাইরে হাজির করলেও মনের ভেতরে ছিল গোপন আনন্দ। সামনাসামনি মানুষকে খবরটা দেওয়ার পর মানুষের বিস্ময় কিংবা ঈর্ষাজর্জরিত চেহারা দেখার লোভটা সামলানো কঠিন। আরে দু–চারজনের চোখ না টাটালে সুখ আর কোথায়? কিন্তু মনের এই গোপনতা বাইরে এনে প্রকাশ্যে স্বীকার করার দুর্বলতা প্রকাশ করা যায় না।
দুই হাতে দুই দইয়ের ভাঁড় নিয়ে বাড়ির পথে ফিরতে ফিরতে আহাদ হাজি গলির মোড়ে মোড়ে উঠতি তরুণদের জটলা দেখে। নতুন কিছু নয়, বরং নিত্যদিনের পরিচিত দৃশ্য। আজ পোলাপানের আনাগোনা একটু বেশি, এ–ই যা। কী যে অদ্ভুত অভ্যাস হয়েছে এই যুগের পোলাপানের। সারা দিন মোবাইল টিপে কী যে দেখে! আজকেও কী দেখছে আর হাসতে হাসতে ঝড়ে এলোপাতাড়ি টক্কর লাগতে থাকা গাছের ডালের মতো একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ছে।
দূর থেকে আহাদ হাজিকে আসতে দেখে অবশ্য দৌড়ে ঝুপঝাপ পালিয়ে যায় সব কটা। আহাদ হাজি ভাবে, আইজকা হইছে কী এইগুলার? অন্য দিন আদাব–সালাম দিয়ে দায় সারে, আইজকা দৌইড়াইয়া পালাইতাছে! বিষয়টা বেশ উপভোগ করেন তিনি। একটু–আধটু আদব–কায়দা, সম্ভ্রম এখনো বহাল আছে তাহলে, পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।
পাশাপাশি শুয়ে নওশিন আপুর গুমোট কান্নার ফ্যাঁচফ্যাঁচ নাক টানার শব্দ নওরিনের স্নায়ু অবশ করে আসা ঘুমের তীব্রতাকে ধাক্কা দেয়। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে নওরিনের। অথচ নওশিন আপুর ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্না থামছে না। নওরিনের একবার বলতে ইচ্ছে করে, ‘থামো তো নওশিন আপু, ঘুমাইবার দেও। ভীষণ ঘুম পাইছে।’ ভারী হতে থাকা চোখের পাতার ওজন যেন কণ্ঠ চেপে ধরে। আওয়াজ বের হয় না। নওশিন আপু কাঁদতে থাকে.
সকাল থেকেই আকলিমা ফুফুর এই মেন্দা মেরে বসে থাকাটা মোটেই ভালো লাগছিল না নওশিন আপুর। আজ বিশ বছর ধরে আম্মা নয়, এই ঘরের কর্ত্রী আকলিমা ফুফু। অকালে বিধবা হওয়া আকলিমা ফুফু দশ বছর বয়সের আদনান ভাইকে নিয়ে যখন এ বাড়িতে খালি হাতে উঠে আসে, তখন নওশিন আপুর বয়স পাঁচ আর নওরিনের দুই। শ্বশুরবাড়ির বিশাল সম্পত্তির কিছুই আকলিমা ফুফু তো পায়ইনি, উল্টা স্বামীর বিপুল ঋণের বোঝার খোঁটা সহ্য করতে হতো দিনরাত। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছিল ভাইয়ের বাড়িতে। আহাদ হাজি তো বটেই, তার স্ত্রীও আপন করে নিয়েছিল আকলিমা ফুফুকে। ‘আমরা একবেলা খাইলে তোমরাও একবেলা খাইবা’ বলে অকৃত্রিম স্নেহেই নিজের বোনের মতোই বুকে টেনে নিয়েছিল তাকে।
আহাদ হাজির পরিবারে সদস্য হয়ে গিয়েছিল আদনান ভাই আর আকলিমা ফুফু। বিনিময়ে আহাদ হাজির স্ত্রীকে গার্হস্থ্য জায়ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়ে আহাদ হাজির সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল আকলিমা ফুফু। কী রান্না হবে থেকে কী বাজার লাগবে। নওরিনের পেট খারাপ, ওর স্যালাইন লাগবে; নওশিনের দাঁতব্যথা, ব্যথার ওষুধ লাগবে; কোন কাপড়ে মাড় দিতে হবে, আহাদ হাজির ওজুর পানি কখন তৈরি রাখতে হবে, ছোটখাটো কিংবা বড়সড়ো সব খেয়াল রাখার দায়িত্ব সানন্দ পালন করেন আকলিমা ফুফু। বিয়ের আগে আহাদ হাজির স্ত্রী ছিলেন সিনেমাপাগল, সালমান শাহ-শাবনূরের সব ছবির গান তো বটেই, সংলাপসুদ্ধ মুখস্থ বলতে পারতেন। শাবনূরের নৃত্যের ছন্দ তার হৃদয়ে, সংসারের নুন-মরিচ-তেল ভালো লাগে! তিনিও সানন্দ আকলিমা ফুফুর ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব দিয়ে আয়েশ করে বসে বসে দেখতেন, সুবর্ণলতা কী বুদ্ধি করেই না শাশুড়ির বাঁকা কথার উত্তর দেয়!
দুপুরের দিকে নওশিন আপু নওরিনের কাছে এসে জানতে চায়, ‘আকলিমা ফুফুর কী হইছে রে আজকে?’ চুপ করে থাকে নওরিন। ততক্ষণে ব্যাপারটা আহাদ হাজির স্ত্রী হয়ে আকলিমা ফুফুর কান অবধি পৌঁছে গেছে। জানে না শুধু নওশিন আপু আর আব্বা। তাই দুজনেরই উৎসাহে কমতি নেই।
আহাদ হাজির স্ত্রী বিকেল–বিকেল আব্বার ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি আর পায়জামা বের করতে করতে মিনমিন করে একবার বলে, ‘বিয়ার আলাপটা এইবার বাদ দেওন যায় না? পোলাডা ত কইছে, দুই বছর পর আবার আইবো।’
ধমকে ওঠে আহাদ হাজি। মাথা খারাপ? এইবার বিয়েটা হয়ে গেলে বরং দুই বছরও লাগবে না মাইয়াডারে নিতে। যেন এমন আহাম্মকের মতো কথা কোনোকালে সে শোনেনি, গায়ে বসা পোকার মতো তাচ্ছিল্যে ঝেড়ে ফেলে দেয় সে স্ত্রীর কথা। গলা চড়িয়ে ধমক দেয় স্ত্রীকে, ‘যা করনের তাড়ায় করতে অইবো, পুলাডার ভিসা আছে আর কয়দিন!’ আহাদ হাজির ধমকের উচ্চকিত আওয়াজ সারা বাসায় দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে একরোখা রেশ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিছুক্ষণ। আহাদ হাজির স্ত্রী আর আকলিমা ফুফু দুজনই বোঝে, এই লোককে এখন কিছু বলা বা বোঝানো অসম্ভব।
আব্বার এই কণ্ঠের দৃঢ় একগুয়েমি নওশিন আপুর চেপে রাখা আনন্দের বেলুনে আত্মবিশ্বাসের সুই ফোটায়। একসাথে মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা বাহারি ইচ্ছার হাজারটা সোনালি–রুপালি ঝিলিমিলি স্বপ্ন হাওয়ায় ওড়ে। এই আকলিমা ফুফুর মেন্দা মেরে বসে থাকা, আম্মার মিনমিন আর নওরিনের নৈর্ব্যক্তিকতা—সব সত্ত্বেও নওশিন আপু দেখে, কাছারিঘরে ঘরভর্তি উজ্জ্বলতা। স্বপ্নের, আনন্দের, নিশ্চিন্তার, নির্ভার ভবিষ্যতের। খাটের ওপরে পা তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছেন আহাদ হাজি। সামনে পানের বাটায় খাসিয়া পান, ভেজা কাঁচা সুপারির টুকরা আর বাবা জর্দার কৌটা। এককৌটা চুন। পান-কাঁচা সুপারি-জর্দার যৌথ গন্ধটা ঘরময় অভ্যাসের মতোই মুখ লুকিয়ে থাকে। সারা দিন এমন গন্ধের অভ্যস্ততায় আলাদা করে কিছুই মনে হয় না।
মকবুল হাজি আর পাড়ার দু-চারজন মুরব্বির জন্য অপেক্ষা করছে আহাদ হাজি, এশার নামাজ শেষ। এখনই চলে আসবে সবাই আর আকলিমা তো ঘরেই আছে। সময়মতো ডেকে নিলেই হবে। শত হোক আদনানের গর্ভধারিণী মা। যদিও সব সময়ই আদনানের ব্যাপারে আহাদ হাজির মতই ওর মত। তবু সামাজিকতার কারণে ওকেও সবার সামনে ডাকতে হবে।
আদনানকে মানুষ করা নিয়ে ভাবতে হয়নি আহাদ হাজিকে। অস্বীকার করার উপায় নেই, নিজের সন্তানের মতো যত্নে মোড়ানো নজর কিংবা বাহুল্য খরচ সে করেনি আদনানের জন্য। আদনান পড়েছে সরকারি প্রাইমারিতেই। সরকারি স্কুলে। প্রতি ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে, বৃত্তি পেয়ে নিজের টাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে আমেরিকার ওয়াইহো স্টেটে ফান্ডিং নিয়ে এমএ করে পিএইচডি করছে এখন। স্বভাবে–চরিত্রে পাড়াপড়শির মুখে মুখে ও সোনার টুকরা ছেলে। কোনো দিন কোনো বাজে অভ্যাস, বাজে আচরণ দেখেনি কেউ। নিজের ঘরে মানুষ হওয়া ছেলেটাকে আহাদ হাজি নিজের ঘরেই রেখে দেবে, এটার বিকল্প ভাবাটাই বরং অস্বাভাবিক ঠেকে পাড়াপড়শির কাছে।
ব্যাপারটার সামাজিকীকরণ বাকি শুধু। সব তো ঠিকঠাকই আছে। প্রচলিত বিয়েশাদির আলাপের মতো বাগ্বিতণ্ডা, দেনদরবারের বালাই নেই। তবু আহাদ হাজির বউ আখনি আর ফিন্নি রান্না করেছে। আকলিমা ট্যাং আর লেবু দিয়ে চিনি–লবণ মিশিয়ে শরবত বানিয়েছে। হাজার হলেও বিয়ে বলে কথা।
আদনান ভাই কফি চায় পুবের ঘর থেকে। নওরিন ট্রেতে এক গ্লাস পানি, একটুকরা কেক আর এক মগ কফি নিয়ে তৈরি হয়। বিদেশে গিয়ে এই অভ্যাস হয়েছে আদনান ভাইয়ের। কফির সাথে নাকি কুকিজ লাগে। দায়িত্বটা সব সময় নওরিনেরই। নওরিনের যখন–তখন আদনান ভাইয়ের ঘরে যাওয়া নিয়ে কেউ কিছু ভাবে না বাসায়। আদনান ভাই আর নওশিন আপুর বিয়ে হবে, এটা এতই স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে একটা আনুষ্ঠানিকতা কিংবা আইনগত বৈধতার ব্যাপার যে মাঝামাঝি রয়ে গেছে, তার গুরুত্ব উহ্যই থাকে সবার কাছে। নওশিন আপু এসে সামনে দাঁড়ায়। লজ্জা আর প্রেম শিহরণের যুগল মিলনে লাল হয়ে উঠেছে নওশিন আপুর গাল জোড়া, নাকের ডগা। নওরিন বুঝতে পারে, আজ নওশিন আপুর ইচ্ছা করছে, ও নিজেই যাবে আদনান ভাইয়ের জন্য কফি নিয়ে।
নওরিন ভাবে, কোনোভাবেই কোনো দিন নওশিন আপুর মতো হতে পারল না সে। না দেখতে–শুনতে, না লেখাপড়ায়, না ব্যক্তিত্বে। লম্বা, চিকন কোমর, গায়ের রং, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, গান গাওয়া, শত যুবকের উৎপাত অগ্রাহ্য করা একেবারে যথার্থ নারীর প্রতিশব্দ নওশিন আপু। অন্যদিকে সামাজিকভাবে যা যা না থাকলে সমাজে উপযুক্ত নারী হিসেবে কেউ গ্রহণযোগ্যতা হারায়, তার সবকিছুই বিদ্যমান নওরিনের ভেতর। নিজের চেহারা–সুরতের জন্য, মেধাহীনতার জন্য ছোটবেলা থেকেই অযত্ন–অবহেলাই প্রাপ্য তার।
আর তাই ছোটবেলা থেকেই নওরিন দেখে এসেছে, পরিবারে নওশিন আপুর গুরুত্ব বেশি। ব্যাপারটা দিন শেষে রাত আসা আর রাত শেষে আসা দিনের মতোই যেন স্বাভাবিক। ভালো জামা, ভালো খেলনা, নতুন বই সব নওশিন আপুর। বড় বোনের গায়ের জামা আর খেলনা কিংবা বইয়ের প্রথাবদ্ধ উত্তরাধিকার ছোট বোন। এটাই রীতি। এটা দৃষ্টিকটু, অনায্য বা সমস্যা কোনোটাই নয়। নওশিন আপুর পুরোনো হয়ে যাওয়া এমনকি কখনো ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়েও কেটেছে নওরিনের কৈশোর থেকে যৌবন।
ছেঁড়া জামার ফাঁকে উদ্ভিন্ন যৌবনের লক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিলেও গায়ে মাখেনি কেউ। ঘন সরের মতো গায়ের রং নওশিন আপুর, তাকে রেখে কালো ধুমসি নওরিনের দিকে কেউ তাকাতে পারে, এমন ভাবনাও আসে না কারও মাথায়। আদনান ভাইয়ের সামনে ওড়না ভেদ করে স্তনবৃন্ত ফুলে উঠলেও নওরিন জানে, কারও চোখেই পড়ে না সেটা। আহাদ হাজি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেমনে যে মামার বাড়ির এই কাইল্যা আদলটাই পাইছে মাইয়াডা!’ আদনানের সাথে নওশিন আপুর বিয়েটা হয়ে গেলেই আহাদ হাজি যে কাউকে ধরে নওরিনকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন। খুব ভালো করে জানে নওরিন।
২দেশে আসার আগে পুবের ঘরটা তৈরি করে রাখা হয়েছে আদনান ভাইয়ের জন্য। আমেরিকায় যাবার আগে এই ঘরেই থাকত আদনান। তখন আর এখন, সময়ের পার্থক্য পাঁচ বছর হলেও পরিস্থিতির পার্থক্য আকাশ–পাতাল। ঘরটা পাঁচ বছর আগে ছিল একচালা। চারপাশে আস্তরহীন ইটের দেয়াল। ঘরে মা–ছেলের ঘুমানোর একটা বিছানা আর আদনান ভাইয়ের পড়ার টেবিল। আদনান আমেরিকায় গেলে আকলিমা একাই এই ঘরে থাকত। এবার আসার আগে আহাদ হাজি পুরো ঘরটা ভেঙে তৈরি করলেন। ফ্লোরে টাইলস, অ্যাটাচড বাথরুম।
আদনান যখন তার ঠোঁটে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, কারও ঠোঁটের উষ্ণতা টের পায়, তখনো ঘরে আলো জ্বলছে। ল্যাপটপটা বন্ধ করলেও শেষ পর্যন্ত আলোটা নেভানো হয়নি। একসাথে বড় হয়েছে তিনজন, নওশিন, নওরিন আর আদনান। এক বিছানায় শুয়ে। এক প্লেটে ভাত মেখে খাইয়ে দিত আকলিমা। খেলতে খেলতে যৌবনের গলিতে প্রবেশ করেছে এরা, খুব কাছাকাছি বাস করে। আদনানের চেনা, এই শরীরের প্রতিটি ভাঁজ চেনা। ঠোঁটের কোণে এই আঁচিলটায় একদিন ঠোঁট ছোঁয়াবে, অনেক দিনের স্বপ্ন তার। খালি গায়ে রান্নাবাটি খেলতে থাকা মেয়েটির শরীর কীভাবে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠল, আমেরিকার ল্যাবে বসে অনেক দিন কল্পনা করতে চেয়েছে সে। আদনান ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষা তার, অনেক দিনের অপেক্ষা।
৩সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হতে থাকার পরও কেউ না এলে আহাদ হাজি তার বাটন ফোন দিয়ে একের পর এক কল দিতে থাকে। একে একে সবাইকে। কেউ কল ধরে না। শরবত আর সেমাইয়ে সাথে আকলিমা টেবিলে আখনি আর ফিন্নির বাটি সাজায় রোবটের মতো। আহাদ হাজির স্ত্রী আজ আর টিভির রিমোট হাতে নেয় না। চুপ হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়, নিষ্প্রাণ দেয়ালের দিকে মুখের বিব্রত ভাঁজ লুকিয়ে।
কেউ ফোন না ধরলে হাল ছেড়ে দিয়ে, অনুচ্চ স্বরে আকলিমাকে ডাকে আহাদ হাজি, ‘বইন...।’ হৃদয়ে পাষাণ বেঁধে আহাদ হাজির সামনে যেন মৃত্যু পরোয়ানা পাঠ করে আকলিমা, রাজসভার পেয়াদার মতো। আবেগ–অনুভূতিহীন। কোনো ভনিতা না করেই বলে আকলিমা, ‘নওশিন না, নওরিনরে বিয়া করতে চায় আদনান।’
৪‘নিজেরে এমনভাবে বিকাইয়া দিলি তুই! তোর নিজের কথা বাদ দে, পরিবারের সম্মানের কথা একবার ভাবলি না?’ জোরে জোরে ধাক্কা দেয় নওশিন আপু নওরিনকে। নওরিন দেখতে পায়, নওশিন আপু নয়, হাত ধরে আদনান ভাই ডাকছে, ‘নওরিন...’ সংসারের অনেক দয়া সহ্য করেছে সে, আদনান ভাইয়ের দয়া তার একদম সহ্য হবে না। প্রবল অভিমানে একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় নওরিন।
এদিকে একটা ভিডিও ক্লিপ ঘুরতে থাকে পাড়ার মোড়ে মোড়ে, উঠতি বয়সী ছেলেপেলেদের হাতে হাতে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আহ দ হ জ র স ত র আদন ন ভ ই অন ক দ ন আদন ন র নওর ন র ন র মত র জন য আম র ক আকল ম
এছাড়াও পড়ুন:
সৈয়দ আব্দুল হাদীর জন্মদিনে গানে গানে তরুণ শিল্পীদের শ্রদ্ধা
‘সূর্যোদয়ে তুমি’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘একবার যদি কেউ’, ‘যেও না সাথী’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘আমি তোমারই প্রেম ভিখারি’, ‘আছেন আমার মোক্তার’, ‘তেল গেল ফুরাইয়া’, ‘তোমরা কাউকে বলো না’, ‘এমনও তো প্রেম হয়’-সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর জন্মদিন আজ।
যদিও এ মুহূর্তে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন, তারপরও দেশবরেণ্য এই শিল্পীর ৮৫তম জন্মদিন আলাদাভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে চ্যানেল আই। আজ সকাল ৭টায় সংবাদের পর প্রচার করতে যাচ্ছে সৈয়দ আব্দুল হাদীর সাড়া জাগানো কিছু গান নিয়ে সাজানো ‘গান দিয়ে শুরু’ অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্ব। সরাসরি সম্প্রচারিত এ অনুষ্ঠানে সৈয়দ আব্দুল হাদীকে গানে গানে শ্রদ্ধা জানাবে এ প্রজন্মের তিন তরুণ শিল্পী মহারাজা, আলাউদ্দিন ও শানু। এ ছাড়াও থাকছে সৈয়দ আব্দুল হাদীকে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র।
১৯৪০ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া সৈয়দ আব্দুল হাদী হতে চেয়েছিলেন একজন শিক্ষক। কিন্তু জীবনের গতিপথ বদলে গেছে গানের ভুবনে পা রাখার পর। কখনও ভাবতে পারেননি, শখের বশে গান গাইতে গিয়ে কণ্ঠশিল্পী পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবেন। তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কি যখন শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নেওয়া শুরু করে, তখন আর চলার পথ বদলে ফেলার সুযোগ পাননি। ততদিন নিজেও সংগীতের প্রেমে ডুবে গিয়েছিলেন। অনুভব করেছিলেন, শিল্পী হিসেবে শ্রোতাদের প্রতি তাঁর এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সে কারণে নিরলস গান করে যাচ্ছেন তিনি। নিজের আত্মজীবনীতেও এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি।
একুশে পদক ও পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত সৈয়দ আব্দুল হাদী। তিনি শিল্পী হিসেবে শুধু গান গেয়ে যাওয়া নয়, সংগীত ভুবনে নতুন কিছু তুলে ধরা এবং নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার বিষয়েও বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
‘গানে গানে দেশে দেশে’ ও ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের গানগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শ্রোতা ও তরুণ শিল্পীদের। আরও আগে বিটিভির প্রযোজক হিসেবে ভিন্নধর্মী আয়োজনের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় শিল্পীদের পরিচিত করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এ নিয়ে সমকালকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সবার জীবনে একটা সময় আসে, যখন নিজের পরিবর্তে আগামী প্রজন্মকে নিয়ে ভাবতে হয়। আমি কতটুকু কী দিতে পেরেছি, আরও কিছু দেওয়ার আছে কিনা– সেই ভাবনার চেয়ে বড় হয়ে উঠে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী করা উচিত। সেই ভাবনা থেকেই ‘গানে গানে দেশে দেশে’, ‘স্মৃতিময় গানগুলো’সহ আরও কিছু অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং আমাদের কালজয়ী গানগুলোর পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। নতুন আয়োজনেও উৎস জুগিয়েছি নানাভাবে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সময়ের সঙ্গে শ্রোতার চাহিদা বদলে যায়। এজন্য শিল্পী থেকে শুরু করে গীতিকার, সুরকার, সংগীতায়োজক’ সবাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা থেকেই তো বিবর্তন। আমরাও চেষ্টা করছি, গানের কথা, সুর সংগীত এবং গায়কিতে সময়কে ধরে রাখার। একটা বিষয় সবসময় মাথায় রেখেছি, তা হলো গানে মেলোডি ধরে রাখা। কারণ, মেলোডি সুরের গানের চাহিদা কখনও ম্লান হয়নি।’ তার এই কথায় স্পষ্ট, দেশীয় সংগীতের সমৃদ্ধিতে নিরলস কাজ করে যেতে চান তিনি।