বিল দখল করে পুকুর খনন মৎস্য খামার তৈরির মচ্ছব
Published: 10th, May 2025 GMT
দখলদারদের খপ্পরে পড়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নান্দাইল উপজেলার বলদা বিল। প্রভাবশালীরা বিলের খাস জায়গা দখল করে সেখানে বড় বড় মৎস্য খামার তৈরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, এভাবে দখল হতে থাকলে আগামীতে বিল বলে আর কিছুই থাকবে না।
নান্দাইল উপজেলার উত্তরে সদর ইউনিয়নে বলদা বিলের অবস্থান। এ বিলের দক্ষিণে কাটলীপাড়া ও দাতারাটিয়া গ্রাম। উত্তরে দক্ষিণ রসুলপুর, উত্তর রসুলপুর, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কুমারুলী গ্রাম। পশ্চিমে দাতারাটিয়া ও দত্তগ্রাম, পূর্বে কাটলীপাড়া গ্রাম।
আগে বলদা বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। প্রতিবছর বিলে মাছ ধরার ‘হাইত’ উৎসব হতো। সময়ের বিবর্তনে পলি পড়ে বিলটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এখন আর বিলে তেমন পানি থাকে না, মাছও পাওয়া যায় না খুব একটা। এ সুযোগে বিলের খাসজমি দখল করে মাছ চাষের পুকুর তৈরি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে মুক্ত জলাশয়ে মাছের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন আরও কমে যাবে। তা ছাড়া মাছ ধরা এবং বিক্রি করে সংসার চালানো পরিবারগুলো পেশা বদল করতে বাধ্য হবে।
স্থানীয়রা জানান, জলাশয়টি ভরাট হওয়ার পর থেকেই এলাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মাছ ধরে যারা সংসার চালাতেন তারা মাছ ধরতে না পেরে কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। আবার পানির অভাবে চাষাবাদে ঠিকমতো সেচও দিতে পারছেন না কৃষক। এই পরিস্থিতি বিল দখল করে পুকুর খনন করলে আরও সংকট তৈরি হবে। দখল রোধে কর্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, চারপাশের গ্রামগুলো বিল থেকে অনেক দূরে। পার থেকে যতটুকু দেখা যায়, তাতে খাল বাদে কোথাও পানির অস্তিত্ব নেই। বিলের দুই দিকে দুটি ভেকু (খননযন্ত্র) মৎস্য খামারের জন্য মাটি খনন করতে দেখা গেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, বিলটির আয়তন প্রায় ২০০ একর। তাতে খাসজমির পরিমাণ হবে ৮০ থেকে ৯০ একর। আগে বেশি পানি থাকার কারণে বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। শুকনো মৌসুমেও এখানে বোরো ধানের আবাদ সম্ভব হতো না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, বিলটি ভরাট হয়ে গভীরতা হারাচ্ছে। ফলে কয়েক বছর ধরে শুকনো মৌসুমে বিলের জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। বর্তমানে কেউ কেউ মাছ চাষের জন্য নিজেদের জমির পাশাপাশি বিলের খাসজমি দখল করে বড় বড় পুকুর খনন শুরু করেছেন। তাদের দাবি, প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন লোক এ ধরনের মৎস্য খামার তৈরির সঙ্গে জড়িত। এভাবে দখল হতে থাকলে আগামীতে বিলটির অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, খামার গড়ে তোলার কারণে বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খালটিও বন্ধ হওয়ার পথে।
বিলে ঘাস কাটতে আসা কাটলীপাড়া গ্রামের সেকান্দর আলী জানান, অনেক দিন আগে থেকেই বিলে মৎস্য খামার তৈরি শুরু হয়েছে। সবাই নিজেদের জমিতে খামার তৈরি করছেন বলে প্রচার করলেও কেউ কেউ বিলের খাসজমিও দখল করে নিচ্ছেন। তবে জড়িতদের নাম-পরিচয় বলতে রাজি হননি তিনি। বিল পারে হাঁসের পাল নিয়ে আসা সুজন মিয়া বলেন, ‘বিল শুকিয়ে যাওয়ায় সবাই পুকুর তৈরি করছে।’
দখলদারদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় ভূমি অফিসের সহায়তায় বিলের খাসজমি নিজেদের নামে লিখে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিলে মৎস্য খামার তৈরি করছেন কাটলীপাড়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য কনু মেম্বার। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আগে তাঁর বাপদাদার নামে বিলে থাকা ৬৩ কাঠা জমিতে একটি এবং পরে তাদের খরিদ করা ৭২ কাঠা জমিতে আরেকটি মৎস্য খামার দিয়েছেন তারা। বিলের ১ শতাংশ জমিও দখল করেননি বলে দাবি তাঁর। কারা দখল করছেন, তাও জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।
হাসনাত মাহমুদ তালহা জানান, তিনি তাদের পৈতৃক জমিতেই খামার করেছেন। বিলের কোনো জমি দখল করেননি। তবে এ-সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকায় না প্রকাশের অনুরোধ জানান তিনি।
নান্দাইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (নায়েব) আজিজুল হকের ভাষ্য, এরশাদ সরকার আমলে কেউ কেউ বিলের
খাসজমি নিজেদের নামে কাগজপত্র করে দখল করেছেন বলে শুনেছেন তিনি। তবে এখন আর এমনটি হচ্ছে না।
নান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন জানান, আগে অনেকেই কাগজপত্র করে বিলের জমি দখলে নিয়েছেন বলে শুনেছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নান্দাইল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়জুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি সরেজমিন দেখে মৎস্য খামার মালিকদের জমির মালিকানার কাগজপত্র নিয়ে অফিসে আসার জন্য বলেছেন। তারা এলে দলিলপত্র যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মৎস য খ ম র ত র ব ল র খ সজম ছ ন বল উপজ ল করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ভূমি অধিগ্রহণ না করেই কাজ
সাঁথিয়া উপজেলার গাগড়াখালী-সোনাতলা বাইপাস সড়ক উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছিল ছয় বছর আগে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগের অপ্রশস্ত সড়কের পাশে মাটি ফেলাসহ কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ শুরু করে। সড়কের বর্ধিত অংশের বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় জমির মালিকেরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে কাজে বাধা দেন। তারা একজোট হয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে মামলা করলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে সড়কটি খুঁড়ে রাখায় খানাখন্দে ভরে গেছে। বৃষ্টিতে বেহাল সড়কটি কাদাপানিতে সয়লাব। পাটগাড়ি এলাকায় কালভার্ট নির্মাণ করে ফেলে রাখা হয়েছে। সংযোগ সড়ক না থাকায় সেটিও কোনো কাজে আসছে না। এতে অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এ পথে চলাচলকারী ৫০ হাজার মানুষ।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের পাবনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়াই গাগড়াখালী-সোনাতলা বাইপাস সড়কের কাজ শুরু হয়। আট কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কাজ পায় ঢাকার এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। প্রথমদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কের পাশে মাটি ফেলাসহ কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ শুরু করে।
গাগড়াখালি, ফেচুয়ান ও তেঘরি গ্রামের সড়কের বর্ধিত অংশের বেশির ভাগ জমিই ব্যক্তিমালিকানাধীন। মালিকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কাজ শুরু করায় তারা বাধা দেন এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করেন। এখনও মামলার চূড়ান্ত রায় হয়নি। এ কারণে কাজ বন্ধের জন্য আদালত থেকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বর্ধিত অংশ অধিগ্রহণের জন্য টাকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কাগজপত্র জমা দিয়ে ভূমিমালিকরা টাকা তুলে নিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নামমাত্র কয়েকজন জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পেলেও অনেকেই পাননি। কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের কাগজপত্র সঠিক নয়।
এ বিষয়ে জমির মালিক তেঘড়ি গ্রামের সৈয়দ গোলাম মওলা বলেন, ‘আমার কাগজপত্র সঠিক আছে। আমার মতো গাগড়াখালি, ফেচুয়ান ও তেঘরি গ্রামের ৩০ থেকে ৩৫ জনের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও তারা ক্ষতিপূরণ পায়নি।’
তেঘড়ি গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলা, গোলাম রসুল, আব্দুস সাত্তার, আব্দুল ওহাব, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল বারি, আলমগীর হোসেন, রিজিয়া খাতুনসহ কয়েকজন জমির মালিক বলেন, ‘২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট ক্ষতিপূরণ চেয়ে পাবনা আদালতে মামলা করেছি। ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাড়া পাইনি। ক্ষতিপূরণ পেলে মামলা তুলে নেব।’
মামলার বাদী ফেচুয়ান গ্রামের মকবুল হোসেন, সুজন হোসেন ও আজিজ খাঁ জানান, সড়ক হলে সবারই সুবিধা হয়। জমির মালিকরা সড়কের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কথা হলে সওজের উপসহকারী প্রকৌশলী মাহবুব হাসান জানান, সোনাতলা থেকে পাটগাড়ি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ঠিকাদারের সময় পেরিয়ে যাওয়াসহ কিছু জটিলতার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি।
সরেজমিন পাটগাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক ছাড়াই কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ কালভার্টের দুই পাশে মাটি ফেলে রাখায় কাদামাটিতে একাকার। এ পথ দিয়ে চলাচল এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কটি দ্রুত নির্মাণের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন তেঘড়ি গ্রামের গোলাম কিবরিয়া, পাটগাড়ি গ্রামের রফিকুল ইসলাম সান, স্কুলশিক্ষার্থী সিমি খাতুনসহ অনেকে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপক প্রহ্লাদ কুমার বলেন, ‘আমরা যথাসময়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এবং মামলার কারণে কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। এরই মধ্যে সময় পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে।’
পাবনা সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান বলেন, ‘যাদের জমির কাগজপত্র সঠিক ছিল, তারা টাকা পেয়েছেন। যাদের কাগজ সঠিক নেই, তারা পাননি। জটিলতা এখনও কাটেনি। মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন প্রকল্প এলে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে। অনুমোদন হলে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কটির কাজ শুরু করা হবে।’