চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে আপাতত ক্ষান্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ৯০ দিনের জন্য উভয় দেশই উল্লেখযোগ্য হারে শুল্ক কমিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনায় ভারত কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সেই সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণার পর ভারতে যে হারে বিনিয়োগ আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল, তাতেও ভাটা পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্ণোদ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর করার পর ধারণা করা হচ্ছিল, বিশ্ববাণিজ্যে ভারত সুবিধা পাবে। কিছু বিনিয়োগ ভারতে আসতেও শুরু করেছিল। আইফোন নির্মাণকারী কোম্পানি অ্যাপল বলেছিল, এখন থেকে তারা ভারতেই বেশি উৎপাদন করবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন পারস্পরিক শুল্ক ৯০ দিনের কমাতে রাজি হওয়ায় এখন ভারত ও চীনের শুল্কহার প্রায় কাছাকাছি। ফলে ভারত বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে যে লাভজনক ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ ব্যবহার করেছে, সেই কৌশল দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের আওতায় সাধারণত কোম্পানিগুলো চীনের বাইরেও অন্য দেশে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছিল। শ্রীবাস্তব বলেন, এখন সেই সুবিধা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে, কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে আনায় ভারত ও চীনের শুল্কহার প্রায় সমান হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই পিছু হটার মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট বলে মনে করেন শ্রীবাস্তব। সেটা হলো, ‘ওয়াশিংটন আবারও বেইজিংয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছে।’ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একমত হয়েছে, তারা আগামী ৯০ দিনের জন্য পরস্পরের ঘোষিত পারস্পরিক শুল্ক ও পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহার করবে। এতে দুই প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে প্রশমিত হয়েছে।

এই সমঝোতার অংশ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্কহার ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিল।

শ্রীবাস্তবের মতে, এই পরিবর্তন ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, যে কৌশলের ফলে বহু কোম্পানি তাদের উৎপাদন ভারত, ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর মতো দেশে সরিয়ে নিচ্ছিল।

শ্রীবাস্তব আরও বলেন, যদিও স্বল্প বিনিয়োগের সংযোজন জাতীয় কারখানা আপাতত ভারতে থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃত শিল্পভিত্তিক গভীর উৎপাদন কার্যক্রম থেমে যেতে পারে বা আবারও চীনে ফিরে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভারত প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে অনেকে ভারতে আসতে দ্বিধাবোধ করবেন।

২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারিতে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। পরবর্তী সময়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিভিন্ন দেশের সুরক্ষা নীতি গ্রহণের ফলে অনেক আন্তর্জাতিক উৎপাদন সংস্থা তাদের কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে। এর অংশ হিসেবে অনেকে ভারত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের কথা ভাবছিল।

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী উদীয়মান সরবরাহ কেন্দ্রগুলোর দিকে নজর রাখছিলেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে ভারতের মতো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও বিশাল বাজারের দেশ উল্লেখযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠছিল। সেই সঙ্গে আছে দেশটির বিশাল তরুণ শ্রমশক্তি।

শ্রীবাস্তবের পরামর্শ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত বাণিজ্যচুক্তিতে ভারত যদি ১০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা ধরে রাখতে পারে, অর্থাৎ যদি তা ২ এপ্রিল প্রস্তাবিত ২৬ শতাংশে না ওঠে, তাহলেই বলা যাবে, ভারত চুক্তি করতে চৌকস। তবে কেবল বাণিজ্যনীতি নয়, ভারতের এখনই উৎপাদন খরচ কমানো, পরিবহন ও সরবরাহব্যবস্থার কাঠামো সংস্কারও নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।

ভবিষ্যতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনার সময় ভারতকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে গাড়ি ও ওষুধশিল্পের মতো সংবেদনশীল খাতগুলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে উন্মুক্ত না হয়ে পড়ে। প্রকৃত ও অর্থবহ পারস্পরিক লাভ ছাড়া এসব খাত উন্মুক্ত করা থেকে বিরত থাকা জরুরি বলে মনে করেন অজয় শ্রীবাস্তব।

যেসব দেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য–ঘাটতি আছে, তাদের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে পরবর্তীকালে অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যচুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করলে ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য ওই শুল্ক স্থগিত করেন। এই সময়সীমা শুরু হয়েছে ৯ এপ্রিল থেকে। যদিও তা চীনের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। গত সোমবার চীনের সঙ্গে পৃথক বন্দোবস্তে গেল যুক্তরাষ্ট্র।

সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা শেষ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাখ্যা, সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র যা আদায় করবে, কার্যত তার ভগ্নাংশ সুবিধাও পাচ্ছে না ব্রিটেন। তাঁরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় ভারতের প্রতিনিধিরা যেন এই বিষয় মাথায় রাখেন এবং সতর্ক পদক্ষেপ নেন। এমন একটি চুক্তি যেন করা যায়, যাতে উভয় পক্ষ লাভবান হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ৯০ দ ন র ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি

চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।

এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।

আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।

বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।

এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।

এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশে কফি–সংস্কৃতি প্রসারে ‘আমা কফি’
  • রাজশাহীতে আইনি ব্যবস্থা নিন
  • বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের ৩ প্যাকেজ ঘোষণা
  • চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি