পুলিশে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা, এসআই পদে সরাসরি নয়
Published: 16th, May 2025 GMT
তিন স্তরের পরিবর্তে দুই স্তরে নতুন সদস্য নিয়োগ দিতে কাজ করছে পুলিশ। উপপরিদর্শক (এসআই) পদে সরাসরি নিয়োগ না দিয়ে শুধু কনস্টেবল বা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদে নিয়োগ দিতে চায় বাহিনীটি। আর ওপরের পদে নিয়োগ হবে শুধু সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপি পদে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এই প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে মতামত জরিপের জন্য জেলা পুলিশের কাছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিভিন্ন পদের পুলিশ সদস্যদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিরসন, পদোন্নতি জটিলতা দূর করা এবং পেশাগত উৎকর্ষের জন্যই দুই পর্যায়ে নিয়োগের চিন্তা চলছে। কনস্টেবল থেকে যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন, তাঁদের সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা একটু ভিন্ন চোখে দেখেন। আবার এসআই থেকে যাঁরা এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা হন, তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিচের পদগুলো থেকে পদোন্নতি পেয়ে উঠে আসা কর্মকর্তাদের সুযোগ–সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে অন্য ধাপের কর্মকর্তারা অনেক সময় প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়ান। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব নিরসন করা দুই ধাপে নিয়োগের চিন্তার অন্যতম কারণ।
পুলিশ সংস্কার কমিশনকে পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া প্রস্তাবে দুই স্তরে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে কনস্টেবলদের ১৭তম গ্রেডের পরিবর্তে ১৬তম গ্রেড প্রদান করার কথাও বলা হয়। তবে সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে এই প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় দুই স্তরে নিয়োগের নানা দিক তুলে ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে কনস্টেবলদের গ্রেড পরিবর্তন অথবা ভবিষ্যতে সরাসরি এএসআই পদে নিয়োগ দেওয়ারও চিন্তা চলছে। তাঁরাই পরে যোগ্যতা অনুযায়ী এএসপিসহ তদূর্ধ্ব পদ পর্যন্ত পদোন্নতি পাবেন।
দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেনমোহাম্মদ নুরুল হুদা, সাবেক আইজিপিএসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত পদোন্নতি, মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ঘোচানো এবং মামলার তদন্তের জন্য শুরু থেকেই সব পর্যায়ের সদস্যদের প্রস্তুত করতে কাজ করছে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা চলছে। এই প্রস্তাব পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
যেভাবে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা
মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় পুলিশকে। সাধারণত মামলা তদন্তের মূল কাজটি করে থাকেন এসআইরা। পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) ১৯৪৩-এর প্রবিধান ৭৪১ অনুযায়ী, পুলিশের মোট এসআই পদের ৫০ শতাংশই হন কনস্টেবল থেকে। মামলা তদন্তে পদোন্নতি পাওয়া এসআইদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি নিয়ে বহুদিন থেকেই আলোচনা রয়েছে। এ অবস্থায় এএসপির নিচে এক স্তরে নিয়োগ দিয়ে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে চায় পুলিশ। তাতে মামলা তদন্তে গুণগত মানের উন্নয়ন হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও বলছেন, সরকারি চাকরির বিদ্যমান ব্যবস্থায় সাধারণত তিনটি পদোন্নতি হলে সেটিকে সন্তোষজনক পদোন্নতি বলা যায়। অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে কারও পাঁচ ধাপ পর্যন্তও পদোন্নতি হতে পারে। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে এই পদোন্নতিজট অনেক বেশি। এ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে একধরনের হতাশা রয়েছে। আবার ওপরে পদ তৈরি না করে নিচে অতিরিক্ত নিয়োগের ফলে অনেকেই সময়মতো পদোন্নতি পাচ্ছেন না। দুই ধাপে নিয়োগ হলে অনেকাংশেই এ সমস্যার সমাধান হবে। কনস্টেবলরাই একসময় এএসপি পর্যন্ত পদোন্নতি পাবেন। এতে সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ও হতাশাও কমে যাবে।
উপমহাদেশের বাস্তবতায় কনস্টেবল পদে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। কনস্টেবলদের কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি থাকতে পারে। দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। সব দিক বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদাদুই স্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে লন্ডন পুলিশের মডেল সামনে রাখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, লন্ডনে কনস্টেবল পদে নিয়োগ হলে তাঁরাই একসময় কাউন্টির চিফ কনস্টেবল (পুলিশপ্রধান) হন। সেই মডেলকে অনুসরণ করতে চায় পুলিশ।
পরিকল্পনায় যা আছে
এএসপি ও কনস্টেবল বা এএসআই পদে নিয়োগ।
কনস্টেবল পদোন্নতি পেয়ে হতে পারবেন এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা।
মেধাবীদের টানতে বিশেষ উদ্যোগ।
কমিশনকে দেওয়া প্রস্তাবে যা ছিল
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে তিন স্তরে চার ক্যাটাগরিতে পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়। প্রথম স্তরে ১৭তম গ্রেডে কনস্টেবল, দ্বিতীয় স্তরে ১০ম গ্রেডে এসআই (নিরস্ত্র) ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগ এবং তৃতীয় স্তরে নবম গ্রেডে এএসপি পদে নিয়োগ হয়। এ ছাড়া পুলিশে বিভিন্ন শ্রেণি বা পদে সিভিল কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
এই নিয়োগপদ্ধতি পরিবর্তন করে সংস্কার কমিশনকে দেওয়া পুলিশের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পুলিশকে অধিক স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, জনবান্ধব ও সর্বতো গ্রহণযোগ্য বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিন স্তরের পরিবর্তে দুই স্তরবিশিষ্ট নিয়োগপদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ট্রেড পুলিশম্যান ও দাপ্তরিক কাজে নন-পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নির্ধারিত পদে জনবল নিয়োগ করতে হবে। কোন পদে নিয়োগে কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে, পুলিশের প্রস্তাবে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছিল।
কনস্টেবল থেকে যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন, তাঁদের সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা একটু ভিন্ন চোখে দেখেন। আবার এসআই থেকে যাঁরা এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা হন, তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।আছে চ্যালেঞ্জ, প্রয়োজন বাস্তবধর্মী চিন্তা
২০২১ সালে ক্যাডেট এসআই (নিরস্ত্র) পদে অধিক যোগ্য ও মেধাবীদের টানতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে এসআই পদে দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকদের যোগ দেওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ বন্ধ হলে নিচের স্তরে যোগ দিতে আগ্রহ হারাতে পারেন মেধাবীরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পুলিশে মেধাবীদের নিয়োগের স্রোত যেন কমে না যায়, এ জন্য কনস্টেবল পদে নিয়োগ না দিয়ে সরাসরি এএসআই পদে নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, তা–ও ভাবা হচ্ছে। আবার মেধাবীদের পুলিশে যোগ দিতে কীভাবে আগ্রহী করা যায়, সেই চিন্তাও চলছে। দ্বিতীয় স্তরে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রশিক্ষণের সময় আইন ও পুলিশবিজ্ঞান সম্পর্কে উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। এই স্তরে নিয়োগের প্রাথমিক শর্ত হতে পারে স্নাতক উত্তীর্ণ। পাশাপাশি পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনকে (এসিআর) আরও বেশি গুরুত্ববহ করে তোলা হবে। কর্মজীবনে তার ভূমিকা দেখা হবে।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, উপমহাদেশের বাস্তবতায় কনস্টেবল পদে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। কনস্টেবলদের কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি থাকতে পারে। দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। সব দিক বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য কর মকর ত র প রস ত ব ন পদ র র জন য তদন ত আইজ প প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিশ্রুত গ্যাস এখনও মিলছে না
সংকট কাটাতে গত ৭ মে শিল্পে অতিরিক্ত ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সপ্তাহ পেরোলেও সংকটের তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ খুব একটা বাড়েনি। ভোগান্তি আগের মতো রয়ে গেছে। ২৫ কোটি ঘনফুটের বিপরীতে মিলছে মাত্র চার থেকে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ার অধিকাংশ পোশাক কারখানা দিনের বড় একটা সময় বন্ধ থাকছে। এর ফলে উৎপাদনে ধস নেমেছে। বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য সময়মতো সরবরাহ করাতে পারছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি আয়। আগামী ঈদে সময়মতো শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। লোকসান ঠেকাতে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস সংকটে ঝুঁকিতে পড়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। সমস্যার সমাধান চেয়ে সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে চিঠি পাঠায় টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাস সরবরাহে যে সংকট, তা অব্যাহত থাকলে বস্ত্রকলগুলোর উৎপাদন আরও কমে একসময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সামনে ঈদুল আজহায় শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধে সংকট তৈরি হতে পারে। শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কাও রয়েছে বলে চিঠিতে সতর্ক করা হয়।
এরপর গত ৭ মে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জ্বালানি উপদেষ্টা। সভা শেষে তিনি জানান, শিল্পে অতিরিক্ত ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হবে। এর মধ্যে রমজানে বিদ্যুতের জন্য বরাদ্দ দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট থেকে ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরিয়ে শিল্প খাতে দেওয়া হবে। মে থেকে আগস্ট– এই চার মাসে চারটি অতিরিক্ত এলএনজি কার্গো আমদানি করা হবে। এর ফলে দৈনিক আরও ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে।
তবে শিল্পমালিকরা বলছেন, এখনও তারা প্রায় আগের মতো গ্যাস পাচ্ছেন। পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি, বিশেষ করে সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে সংকট প্রকট হয়েছে। নিট গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সমকালকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়েনি।
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নরসিংদী এলাকায় গ্যাস সরবরাহকারী তিতাসের এক ব্যবস্থাপক সমকালকে জানিয়েছেন, তারা এক সপ্তাহ আগে যে পরিমাণ গ্যাস পেতেন, এখনও প্রায় সমপরিমাণ গ্যাস পাচ্ছেন। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস থেকে গাজীপুর অঞ্চলে সরবরাহ একটু বাড়ানো হয়েছে। সেটিও চার থেকে পাঁচ কোটি ঘনফুটের বেশি না।
পেট্রোবাংলার সরবরাহ করা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬ মে দেশে দৈনিক মোট গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২৭২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যুতে দেওয়া হয় ১০৭ কোটি, সারে ১২.৬ কোটি এবং আবাসিক ও শিল্পে ১৪৯ কোটি ঘনফুট। ১২ মে মোট সরবরাহ ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎ পায় ৯৯.৬ কোটি, সার কারখানা ১১.২ কোটি এবং আবাসিক ও শিল্প পায় ১৬০ কোটি ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার এক পরিচালক সমকালকে বলেন, রমজানে বিদ্যুতে যে গ্যাস দেওয়া হতো, তা এপ্রিলেই কমানো হয়েছে। আর রমজানের চেয়ে বর্তমানে গ্যাসের মোট সরবরাহ কমেছে প্রায় ১৪ কোটি ঘনফুট। ফলে চাইলেই শিল্পে সরবরাহ খুব বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাড়তি যে এলএনজি কার্গো আসার কথা রয়েছে, তা আসবে চলতি মাসের শেষের দিকে। তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
জানতে চাইলে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির সমকালকে বলেন, চাইলেই তো রাতারাতি গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায় না। তার ওপর গত দু’দিন তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। তাই বিদ্যুতেও বেশি গ্যাস দিতে হচ্ছে। এর পরও তিতাসকে যতটুকু সম্ভব বেশি গ্যাস দিতে বলা হয়েছে। আর বাড়তি এলএনজি কার্গো কেনার অর্থ জোগাড় করতে হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) অনুমোদন পাওয়া গেছে। ২১ বা ২২ মে কার্গোটি দেশে আসার কথা রয়েছে। তখন শিল্পে সরবরাহ আরও বাড়বে।
সাভার ও আশুলিয়ায় শিল্প ধুঁকছে
সাভারের হেমায়েতপুরের বৃহত্তর পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান একেএইচ গ্রুপ। এই তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক। কারখানার মালিক আবুল কাশেম সমকালকে জানান, এপ্রিলের চেয়ে এ মাসে গ্যাস সংকট আরও বেড়েছে। সরকার গ্যাস সংকট উত্তরণে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকার নিউ এজ পোশাক কারখানার উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন বলেন, আমাদের পোশাক কারখানায় প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপ)। সেখানে গ্যাস পাচ্ছি ১ থেকে ২ পিএসআই। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করায় খরচ দ্বিগুণ হচ্ছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় বিদেশি ক্রেতা হারাতে হচ্ছে।
জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়ায় কারখানা রয়েছে এক হাজার দুইশর বেশি। কয়েক মাস ধরে এসব কারখানা গ্যাস সংকটে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে আছে। সাভারের উলাইল এলাকার আল-মুসলিম পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপক মোসলেমুদ্দিন জানান, জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য পোশাক কারখানাগুলোয় ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু গত ১ জানুয়ারি থেকে এ চাপ ২-৩ পিএসআইয়ে নেমে এসেছে। এতে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরেজমিন ওই কারখানায় দেখা যায়, ড্রায়ার মেশিনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় তৈরি পোশাক ওয়াশ করা যাচ্ছে না। শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। তিতাসের আশুলিয়া জোনের ব্যবস্থাপক আবু ছালেহ মুহাম্মদ খাদেমুদ্দীন জানান, লাইনে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সাভার ও আশুলিয়া শিল্প এলাকায় গ্যাসের চাপ কম।
গাজীপুরেও সংকট
গতকাল দুপুরে গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী এলাকার তুসুকা জিন্স লিমিডেট কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, গ্যাস সংকটে শ্রমিকরা বেকার সময় পার করছেন। তুসুকা গ্রুপের পরিচালক তারেক হাসান বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১ পিএসআইয়েরও কম। অথচ কারখানা চালানোর জন্য প্রয়োজন ১৫ পিএসআই। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে শুধু ডিজেল কেনায় প্রতিদিন বাড়তি খরচ হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। পাশের মৌচাক এলাকার ফ্যাশন ওয়্যার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ কারখানায় গ্যাস সবরাহ নেই বললেই চলে। পাঁচ হাজার শ্রমিকের কারখানাটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আংশিক চালানো হচ্ছে। গতকাল এ কারখানার ৭৫ শতাংশ শ্রমিক অলস সময় পার করেছেন। সাদমা গ্রুপের পরিচালক সোহেল রানা সমকালকে বলেন, ডিজেল বাবদ প্রতিদিন চার লাখের বেশি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। তারপরও পুরোপুরি চালাতে পারছি না। এখন ঠিকমতো উৎপাদন করতে না পারলে ঈদের আগে বড় ধাক্কা আসতে পারে। ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে না পারলে পরিস্থিতি কোন দিকে যায় কে জানে।
সফিপুর আনসার একাডেমি এলাকার স্টারলিং নামক পোশাক তৈরির কারখানার নিজস্ব জেনারেটরটি গ্যাস সংকটে কারণে চালানো যাচ্ছে না। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময় শ্রমিকদের কর্মস্থলে বসে থাকতে হচ্ছে।
গাজীপুরের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মহর আলী বলেন, জেলা ও মহানগরে দুই হাজারের বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারখানা পরিদর্শনে গেলে কর্তৃপক্ষ প্রায় সময়ই গ্যাস সংকটের বিষয়ে অভিযোগ করেন। তিতাস গ্যাসের গাজীপুর জোনের ব্যবস্থাপক রিদওয়ানুজ্জামান সমকালকে বলেন, জেলা ও মহানগরে দৈনিক প্রায় ৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে পাওয়া যাচ্ছে ৩০ কোটি ঘনফুট।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি)