ছবি: প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণদের সংবিধান ভাবনা এবং রাজনীতির পাঠ

বাহাত্তরের সংবিধানে নিঃসন্দেহে অনেক প্রগতিশীল বিধানের সন্নিবেশ ঘটেছিল। যে কয়েকটি বিধানে ত্রুটি ছিল, তা সরকারের মৌল বৈশিষ্ট্যের ওপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে যে মানুষের ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, বেশির ভাগই ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর সাময়িক ফায়দা হাসিলের জন্য, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নয়। এই সংবিধানকে কার্যকর রেখে জনবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা যায় না। জনগণের সামষ্টিক আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণের জন্য সংবিধানের প্রতিটি অক্ষরে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের মূল্যবোধের প্রতিফলন হওয়া জরুরি। দেশের সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এমনভাবে সংবিধান পুনর্লিখন হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংবিধান ধারণ করতে পারে; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের চাহিদাটাও সংবিধান মেটাতে পারে। 

একাত্তরটা ছিল বৈষম্য এবং জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায্য এক যুদ্ধ। চব্বিশের লড়াইটাও ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে ইনসাফ কায়েমের। এখানটায় কোনো নীতিগত বিরোধই নেই। বরং একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের সংগ্রাম সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। তাই একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের সেতুবন্ধ করা জরুরি। একাত্তরে লড়াই করে স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি; চব্বিশের লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বিচার ব্যবস্থা পেতে চাই। যারা একাত্তরকে চব্বিশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায় অথবা একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের বিরোধ দেখাতে চায়, তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

২০০৭ সালে ১/১১-এর সরকারের সময় সংস্কারের কথা উঠেছিল। যারা সংস্কারের কথা বলেছিলেন, তাদের কারও কারও দুরভিসন্ধি ছিল না, তা বলা যায় না। তবে সেই সময় সংস্কারকে একটি বিতর্কিত কথায় পরিণত করা হয়েছিল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে। সংস্কারকে একপ্রকার গালিতে পর্যবশিত করা হয়েছিল। কী সংস্কার দরকার, সেটির দিকে মনোনিবেশ না করে কে সংস্কারের কথা বলল, কেন বলল, কোন পক্ষের হয়ে বলল– সেগুলো নিয়ে আলাপ তুলে একরকম বয়ান চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এতটাই নগ্ন হয়ে পড়েছে যে এখন সংস্কারের কথা সবাই বলছে। যারা বলছে না, তারা অন্তত অস্বীকার করতে পারছে না। মূলত তরুণ প্রজন্মের মাঝে সংস্কার নিয়ে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, সেজন্য তা অস্বীকার করা অসম্ভব। তবে এর মাঝেও অনেকে ছলে-বলে সংস্কারের চেয়ে অন্য বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য জনমত গঠন করতে চাইছে, গতানুগতিক ধারায় নির্বাচন করার কথা বলছে। এই চ্যালেঞ্জ দেশের জনগণকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী যে রাজনৈতিক শক্তি দৃশ্যমান বিচার এবং মৌলিক সংস্কারের জন্য কাজ করতে পারবে, রাজনৈতিকভাবে জনতার পক্ষ নিয়ে চ্যালেঞ্জটা নিতে পারবে, সেই রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অর্থবহভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে। তরুণরা নবদিগন্তের সূচনা করতে চায়।

তরুণ প্রজন্মের চাওয়া হচ্ছে, যে রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বৈরাচার তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে এবং দানবে রূপ নেয়– তা গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আদালতে, এলাকাতে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপ 

করে যা বুঝেছি তা হলো, তরুণরা সংবিধান পুনর্লিখনের ব্যাপারে একমত। তারা জান ও জবানের নিরাপত্তা চায়। তরুণরা এমন এক ব্যবস্থা চায়, যার ফলস্বরূপ সরকারকে জনগণ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। 

তরুণদের একটা বিরাট অংশ রাজনীতিবিমুখ। তথাকথিত রাজনীতিবিদ এবং বিরাজনীতিকীকরণের হোতারা এর জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে এবং ষড়যন্ত্র এঁটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংবিধান যতই সুন্দর করে পুনর্লিখন করা হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যতই সংস্কার আনা হোক না কেন, রাজনৈতিকভাবে সচেতন না থাকলে, সব সময় রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকরা তীক্ষ্ণদৃষ্টি না রাখলে আবারও সংকট আসতে বাধ্য। কারণ আইন যতই গণমুখী হোক, যার দ্বারা তা প্রয়োগ হবে তার ওপর কিছু ক্ষমতা ছাড়তেই হয়, তাকে বিশ্বাস করতেই হয়। তাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হলে দায়িত্বশীলদের দ্বারা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হচ্ছে কিনা বা দায়িত্বশীলরা বিশ্বাস ভাঙছে কিনা– তা দেখভাল করা সম্ভব হয় না। জাতিগতভাবে রাজনৈতিকভাবে সচেতনতার অভাব একটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক সচেতনতা যেমন জরুরি, ঠিক একইভাবে রাজনীতির ময়দানে সৎ, মেধাবী এবং যোগত্যাসম্পন্ন মানুষগুলোর আসাটাও অনেক জরুরি। রাজনীতির প্রতি ঘৃণা এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখাটা যে কত বড় অপরাজনীতি– তা তরুণ প্রজন্মকে সৎপথ অনুসরণকারী মুরুব্বিদের বোঝাতে হবে। 

রাজনীতিকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দলকেন্দ্রিক অপরাজনীতির বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। সৎ চিন্তাভাবনা ধারণকারী ব্যক্তিদের এলাকাভিত্তিক কাজ করতে হবে। মৌলিক জায়গায় সবাই এক থাকলে সময়ের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। সামষ্টিকভাবে রাজনীতির বয়ানটা গণমানুষকেন্দ্রিক করতে হবে। 

চব্বিশের স্লোগান মনে পড়ে? ‘বিকল্প কে? তুমিই বিকল্প, আমিই বিকল্প’। এটিকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে হবে। রাজনীতির মাঠের জন্য এটি যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে সংবিধান পুনর্লিখনের জন্যও এটি সত্য। ড. কামাল হোসেন আমাদের অগ্রজ। তিনি বাহাত্তরে গঠিত সংবিধান খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিসহ ৩৪ জন সংবিধান খসড়া কমিটিতে ছিলেন, তারা সবাই মিলে সংবিধান প্রস্তুত করেছিলেন। পরে গণপরিষদে কিছু সংশোধনী এনে বাহাত্তরের সংবিধান গৃহীত হয়। সামগ্রিকভাবে সেই সংবিধান কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাই সংবিধান পুনর্লিখন করা দরকার। বাহাত্তরের সংবিধানের জনবান্ধব বিধানগুলোকে পুনর্লিখনের সময় সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে হবে। জাতীয় রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সক্রিয় স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করাটা জরুরি। সংবিধান পুনর্লিখনের প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ ইনক্লুসিভ করার চেষ্টা এবং সদিচ্ছা দেখানো দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবশ্য পালনীয় কাজ।

অ্যাডভোকেট জায়েদ বিন নাসের: সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ