প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের শেষ দিকে গিয়ে দেখা যায়, কৃষ্ণের যাদব বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এই পতনের আগেই বিভিন্ন অশুভ লক্ষণ দেখা দেয়। প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে, পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। পাপ, প্রতারণা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের বিশ্বাস ও পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। যাদব বংশের সদস্যরা জ্ঞানী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অপমান করতে থাকেন। একদিন কৃষ্ণের আত্মীয়রা পিকনিকে গিয়ে মদ্যপান করেন এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন; শেষ পর্যন্ত সবাই একে অপরকে মেরে ফেলেন।

এই সতর্কতামূলক কাহিনি আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে যখন দক্ষিণ এশিয়াসহ নানা অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং অনেক দেশই নিজেদের সীমার ভেতরে রক্ষাদেয়াল গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসন বর্তমান বৈশ্বিক বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলার জন্য অনেকটাই দায়ী। তবে অন্য ধনী দেশগুলোও এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ, তারা ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত কোনো সংহতির পরিচয় দেয়নি।

ট্রাম্পের আচরণ স্পষ্ট করে দিয়েছে, তিনি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, মিত্রদেরও আক্রমণ করেন। ফলে এখন বিশ্বে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আরও বেড়ে গেছে। এটি কেবল জোট গড়ে তোলা, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করা এবং ‘সফট পাওয়ার’ বা নরম কৌশলগত প্রভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্ভব। এর একটি সহজ ও তুলনামূলকভাবে সস্তা উপায় হলো বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়া চালিয়ে যাওয়া।

এমন সহায়তা দেওয়া হলে গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে (বিশেষ করে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিষয়ে তাদের নীরব সহযোগিতা নিয়ে), তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতে পারে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তার সরাসরি সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য অর্থায়ন যেভাবে কমিয়ে দিয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাপী যেসব বিষয় সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ (যেমন স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু স্থিতিশীলতা), সেগুলোর জন্য সহায়তা অনেক কমে যাবে। ‘গ্লোবাল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট’ নামে একটি ধারণা আছে, যা বলছে, এ ধরনের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সব দেশেরই দায়িত্ব রয়েছে। প্রতিটি দেশ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তহবিলে অর্থ দেবে এবং যেসব জায়গায় বেশি প্রয়োজন এবং যেসব স্থানে এর বেশি প্রভাব পড়বে, সেসব জায়গায় সেই তহবিল ব্যবহৃত হবে।

কিন্তু ধনী দেশগুলো এভাবে বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে আমরা যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যবস্থাকে এত দিন ধরে চিনি, সেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে গোটা ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ধনী দেশের প্রতিক্রিয়া খুবই হতাশাজনক। যুক্তরাষ্ট্র যখন তার বিদেশি সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে, তখন অন্য ধনী দেশগুলো সেই ঘাটতি পূরণ করার বদলে বরং নিজেরাও সাহায্য হ্রাস করেছে। ইউরোপের কিছু সরকার বলেছে, তাদের এখন প্রতিরক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করতে হবে, তাই বিদেশে সাহায্যের টাকা কমাতে হচ্ছে। এর ফলে যেসব জরুরি প্রয়োজনীয়তা ‘গ্লোবাল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট’ বা বৈশ্বিক জনস্বার্থে বিনিয়োগের আওতায় পড়ে, সেগুলোরই এখন জোগান দেওয়া যাচ্ছে না।

এ অবস্থা আরও বেশি অবাক করার মতো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করায় যে অর্থের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করা ধনী দেশগুলোর জন্য খুব একটা কঠিন বা ব্যয়বহুল কিছু নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে সংস্থাটি ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট–ঘাটতিতে পড়বে। অথচ এই পরিমাণ অর্থ সহজেই ধনী দেশগুলো, এমনকি বড় আকারের মধ্যম আয়ের দেশগুলোও দিতে পারে।

এই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুমান করছে, তারা প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থ কম পাবে, যার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ সংস্থাটি ২০২৪ সালে সারা বিশ্বে ১০ কোটির বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে এবং পাঁচ বছর আগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল।

জাতিসংঘের এইডস–বিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনএআইডিএস) অবস্থাও প্রায় একই। সংস্থাটি তাদের বাজেটের ৪০ শতাংশের বেশি অর্থ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেত। এখন যুক্তরাষ্ট্র অর্থ দেওয়া বন্ধ করায় তাদের কর্মীর সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিতে হবে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হয় কমাতে হবে, না হয় পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইউএনএআইডিএসের অন্য বড় দুই দাতাদেশ, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যও তাদের অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। এর ফল হতে পারে ভয়াবহ। এর ফল হিসেবে ২০২৯ সালের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ ছয় গুণ বেড়ে যেতে পারে এবং এইডসে মৃত্যু ৪০০ শতাংশ বাড়তে পারে।

এমনকি নতুন ধরনের ভাইরাসও দেখা দিতে পারে, যা সব দেশের জন্যই বিপজ্জনক হবে। তবু পুরো বাজেট–ঘাটতি মাত্র ৫৮ মিলিয়ন ডলার, যা জাতিসংঘের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ইউএনওসিএইচএ) ঘাটতির সমান। এ সংস্থাও বাধ্য হয়ে তাদের ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে। এত বড় ক্ষতির বিপরীতে ঘাটতির অঙ্কটা খুবই সামান্য। তবু ধনী দেশগুলো এগিয়ে আসছে না।

এই অর্থের পরিমাণ এতটাই সামান্য যে যুক্তরাষ্ট্র অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার পর যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা ধনী দেশগুলো বা বড় আকারের মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য পূরণ করা একেবারেই কঠিন কিছু হতো না। এটি তাদের জন্য প্রায় কোনো আর্থিক চাপই তৈরি করত না। কিন্তু বাস্তবে খুব কম দেশই এগিয়ে এসেছে।

কিন্তু ধনী দেশগুলো এভাবে বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে আমরা যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যবস্থাকে এত দিন ধরে চিনি, সেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে গোটা ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

জয়তী ঘোষ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ল র জন য সহয গ ত র ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

বরখাস্ত-অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক সেনাসদস্যদের বিক্ষোভ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান

বিভিন্ন সময় সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত একদল ব্যক্তি চাকরি ফিরে পাওয়াসহ কয়েকটি দাবিতে রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের বিক্ষোভ ঘিরে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে রাতে একটি বক্তব্য দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

আইএসপিআর বলেছে, জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে রোববার কতিপয় বরখাস্ত-অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক সেনাসদস্য তাঁদের চাকরিতে পুনর্বহাল, শাস্তি মওকুফ ও আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল জাতীয় প্রেসক্লাবে যায় এবং অত্যন্ত ধৈর্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য শোনে। প্রতিনিধিদল সেনাবাহিনীর প্রচলিত বিধিবিধান অনুসারে দাবিদাওয়া যাচাই ও সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেয়। একই সঙ্গে অভিযোগসমূহ কোনো তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে না পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি উপস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, ১৪ মে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ধরনের মোট ৮০২টি আবেদন গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে ১০৬টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে এবং বাকি আবেদনগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে‌, যা সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও মানবিকতার সঙ্গে বিবেচনা করছে। তবে দুঃখজনক যে আজকের (রোববার) কিছু অনভিপ্রেত আচরণ এই সুশৃঙ্খল বাহিনীর ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আইএসপিআর বলেছে, পরপর দুবার সফল বৈঠক শেষে প্রতিনিধিদল ফেরত যাওয়ার সময় কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল বরখাস্ত সেনাসদস্যের উসকানি ওই প্রতিনিধিদলের গাড়ির সম্মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং অশ্রাব্য ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয়। সমগ্র দিনজুড়ে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহমর্মিতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালালেও একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুসংখ্যক বিশৃঙ্খল সাবেক সদস্যকে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়।

যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক কার্যকলাপ, জনস্বার্থবিরোধী আচরণ কিংবা বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে—এমন কর্মকাণ্ড কখনোই কাম্য নয় বলে উল্লেখ করেছে আইএসপিআর। তারা বলেছে, সব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্য, সহমর্মিতা এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করছে। সাংবিধানিক কাঠামো ও শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবার সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বরখাস্ত-অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক সেনাসদস্যদের বিক্ষোভ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান
  • বিএনপিপন্থী চার আইনজীবীকে কারণ দর্শাতে নোটিশ দিল জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম
  • কারাগারে লাল থ্লেং কিম বমের মৃত্যুর বিচার দাবিতে বিক্ষোভ
  • বম নারী ও শিশুদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল
  • ‘এমন কর্মসূচি দিতে বাধ্য করবেন না, যাতে শিক্ষক–ছাত্রের সম্পর্ক বজায় থাকে না’
  • আপনাকে যাঁরা পছন্দ করেন না, কীভাবে তাঁদের সামলে চলবেন
  • কর্মক্ষেত্রে নিজের দোষে আত্মবিশ্বাস হারাবেন না
  • আমাদের সংস্কৃতি বদলায়নি, বদলেছে সংহতি
  • ‘ইমোশনালি ম্যাচিউর’ বাবা মায়েরা শিশুর সঙ্গে যে পাঁচ আচরণ করেন