সবাই জেনেবুঝে যেভাবে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে
Published: 18th, May 2025 GMT
প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের শেষ দিকে গিয়ে দেখা যায়, কৃষ্ণের যাদব বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এই পতনের আগেই বিভিন্ন অশুভ লক্ষণ দেখা দেয়। প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে, পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। পাপ, প্রতারণা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের বিশ্বাস ও পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। যাদব বংশের সদস্যরা জ্ঞানী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অপমান করতে থাকেন। একদিন কৃষ্ণের আত্মীয়রা পিকনিকে গিয়ে মদ্যপান করেন এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন; শেষ পর্যন্ত সবাই একে অপরকে মেরে ফেলেন।
এই সতর্কতামূলক কাহিনি আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে যখন দক্ষিণ এশিয়াসহ নানা অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং অনেক দেশই নিজেদের সীমার ভেতরে রক্ষাদেয়াল গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসন বর্তমান বৈশ্বিক বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলার জন্য অনেকটাই দায়ী। তবে অন্য ধনী দেশগুলোও এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ, তারা ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত কোনো সংহতির পরিচয় দেয়নি।
ট্রাম্পের আচরণ স্পষ্ট করে দিয়েছে, তিনি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, মিত্রদেরও আক্রমণ করেন। ফলে এখন বিশ্বে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আরও বেড়ে গেছে। এটি কেবল জোট গড়ে তোলা, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করা এবং ‘সফট পাওয়ার’ বা নরম কৌশলগত প্রভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্ভব। এর একটি সহজ ও তুলনামূলকভাবে সস্তা উপায় হলো বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়া চালিয়ে যাওয়া।
এমন সহায়তা দেওয়া হলে গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে (বিশেষ করে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিষয়ে তাদের নীরব সহযোগিতা নিয়ে), তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতে পারে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তার সরাসরি সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য অর্থায়ন যেভাবে কমিয়ে দিয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাপী যেসব বিষয় সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ (যেমন স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু স্থিতিশীলতা), সেগুলোর জন্য সহায়তা অনেক কমে যাবে। ‘গ্লোবাল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট’ নামে একটি ধারণা আছে, যা বলছে, এ ধরনের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সব দেশেরই দায়িত্ব রয়েছে। প্রতিটি দেশ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তহবিলে অর্থ দেবে এবং যেসব জায়গায় বেশি প্রয়োজন এবং যেসব স্থানে এর বেশি প্রভাব পড়বে, সেসব জায়গায় সেই তহবিল ব্যবহৃত হবে।
কিন্তু ধনী দেশগুলো এভাবে বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে আমরা যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যবস্থাকে এত দিন ধরে চিনি, সেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে গোটা ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ধনী দেশের প্রতিক্রিয়া খুবই হতাশাজনক। যুক্তরাষ্ট্র যখন তার বিদেশি সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে, তখন অন্য ধনী দেশগুলো সেই ঘাটতি পূরণ করার বদলে বরং নিজেরাও সাহায্য হ্রাস করেছে। ইউরোপের কিছু সরকার বলেছে, তাদের এখন প্রতিরক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করতে হবে, তাই বিদেশে সাহায্যের টাকা কমাতে হচ্ছে। এর ফলে যেসব জরুরি প্রয়োজনীয়তা ‘গ্লোবাল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট’ বা বৈশ্বিক জনস্বার্থে বিনিয়োগের আওতায় পড়ে, সেগুলোরই এখন জোগান দেওয়া যাচ্ছে না।
এ অবস্থা আরও বেশি অবাক করার মতো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করায় যে অর্থের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করা ধনী দেশগুলোর জন্য খুব একটা কঠিন বা ব্যয়বহুল কিছু নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে সংস্থাটি ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট–ঘাটতিতে পড়বে। অথচ এই পরিমাণ অর্থ সহজেই ধনী দেশগুলো, এমনকি বড় আকারের মধ্যম আয়ের দেশগুলোও দিতে পারে।
এই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুমান করছে, তারা প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থ কম পাবে, যার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ সংস্থাটি ২০২৪ সালে সারা বিশ্বে ১০ কোটির বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে এবং পাঁচ বছর আগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল।
জাতিসংঘের এইডস–বিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনএআইডিএস) অবস্থাও প্রায় একই। সংস্থাটি তাদের বাজেটের ৪০ শতাংশের বেশি অর্থ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেত। এখন যুক্তরাষ্ট্র অর্থ দেওয়া বন্ধ করায় তাদের কর্মীর সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিতে হবে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হয় কমাতে হবে, না হয় পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইউএনএআইডিএসের অন্য বড় দুই দাতাদেশ, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যও তাদের অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। এর ফল হতে পারে ভয়াবহ। এর ফল হিসেবে ২০২৯ সালের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ ছয় গুণ বেড়ে যেতে পারে এবং এইডসে মৃত্যু ৪০০ শতাংশ বাড়তে পারে।
এমনকি নতুন ধরনের ভাইরাসও দেখা দিতে পারে, যা সব দেশের জন্যই বিপজ্জনক হবে। তবু পুরো বাজেট–ঘাটতি মাত্র ৫৮ মিলিয়ন ডলার, যা জাতিসংঘের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ইউএনওসিএইচএ) ঘাটতির সমান। এ সংস্থাও বাধ্য হয়ে তাদের ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে। এত বড় ক্ষতির বিপরীতে ঘাটতির অঙ্কটা খুবই সামান্য। তবু ধনী দেশগুলো এগিয়ে আসছে না।
এই অর্থের পরিমাণ এতটাই সামান্য যে যুক্তরাষ্ট্র অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার পর যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা ধনী দেশগুলো বা বড় আকারের মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য পূরণ করা একেবারেই কঠিন কিছু হতো না। এটি তাদের জন্য প্রায় কোনো আর্থিক চাপই তৈরি করত না। কিন্তু বাস্তবে খুব কম দেশই এগিয়ে এসেছে।
কিন্তু ধনী দেশগুলো এভাবে বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে আমরা যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যবস্থাকে এত দিন ধরে চিনি, সেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে গোটা ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
জয়তী ঘোষ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ ল র জন য সহয গ ত র ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে বাসে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীকে হেনস্তার ভিডিও ভাইরাল, হেনস্তাকারী গ্রেপ্তার
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি ও হেনস্তার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার তিন দিন পর হেনস্তাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তার নাজিম উদ্দিন (৪৫) ওই বাসের কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বাসে এক তরুণী তাঁর পোশাক নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদ করছেন। বাসে ওঠার পর সামনের আসনে বসা ওই ব্যক্তি তাঁর পোশাক নিয়ে অশোভন মন্তব্য করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তরুণী প্রতিবাদ জানাতে সামনে এগিয়ে যান এবং প্রশ্ন করেন, ‘আমার পোশাক নিয়ে আপনার সমস্যা কী?’ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে ওই ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে তরুণীকে চড় মারেন। মুহূর্তেই তরুণী জুতা খুলে পাল্টা আঘাত করেন। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে দুজনই বাসের সামনের দিকে পড়ে যান। তরুণী নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও প্রতিরোধ করেন।
ঘটনার ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই তরুণীর সাহসী অবস্থানের প্রশংসা করেছেন, অন্যদিকে কেউ কেউ ঘটনাটিতে উভয় পক্ষের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
নাজিম উদ্দিনকে আটক করার সঙ্গে যুক্ত র্যাব-৪–এর মেজর আবরার ফয়সাল সাদী প্রথম আলোকে বলেন, তরুণীকে কটূক্তি ও হেনস্তা করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর হেনস্তকারী ব্যক্তিকে আটক করতে র্যাব-৪–এর একটি দল অভিযান শুরু করে। গতকাল সন্ধ্যায় নাজিম উদ্দিনকে শনাক্ত করে আটক করা হয়। পরে তাঁকে মোহাম্মদপুর থানায় সোপর্দ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক প্রথম আলোকে বলেন, হেনস্তার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে আজ শুক্রবার সকালে নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নাজিম উদ্দিন ধানমন্ডি ১৫ থকে মোহাম্মদপুরের বছিলায় চলাচলরত রমজান পরিবহনের কন্ডাক্টর। ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটির জের ধরে তাঁদের দুজনের মধ্যে মারামারি হয়। ছাত্রীটি মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
আজ সন্ধ্যায় পাঠানো র্যাব-৪–এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রমজান পরিবহনের একটি বাস ধানমন্ডি ১৫ থেকে মোহাম্মদপুরের বছিলায় যাচ্ছিল। বাসটি বছিলার মেট্রো হাউজিংয়ের সামনে পৌঁছালে চালকের সহকারী মো. নিজাম উদ্দিন বাসটির যাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর দিকে তাকিয়ে তাঁর পোশাক নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এতে ওই তরুণী প্রতিবাদ করায় নাজিম উদ্দিন তাঁর সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং তাঁকে চড় মারেন। একপর্যায়ে তরুণীও আত্মরক্ষার্থে নিজের পায়ের জুতা খুলে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দিনকে আঘাত করেন।