নারী অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং সমতার প্রশ্নে বিগত কয়েক দশকে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষত এটি সম্ভব হয়েছে গৃহীত নীতিগত পদক্ষেপ ও নারীর অধিকারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ– প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে ছিলেন এবং সেই ব্যবধান ঘোচাতে একান্ত প্রয়োজন ছিল নারীকেন্দ্রিক আলাদা উদ্যোগ। এসব পদক্ষেপের ফলেই আজকে নারী আগের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত, আত্মবিশ্বাসী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয়।
তবে এ প্রক্রিয়ায় একটি বড় ভুল ছিল– পুরুষদের আলাপ, চর্চা ও উদ্যোগে ‘নারী’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করা। ফলে নারীসমাজ এগিয়ে গেলেও পুরুষের একটি অংশ সেই পুরোনো ধ্যান-ধারণা, গোঁড়ামি ও লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকার ধারণা থেকেই বের করে আনা যায়নি। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, অন্যদিকে পুরুষের মানসিক প্রস্তুতি ও ‘গ্রুমিং’ সমানভাবে না হওয়ায় সমাজে তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীনতা। যার প্রভাব আজ নানা অসামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।
এই অসম বিকাশের ফলে পুরুষদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের অনিরাপত্তা। নারীর অগ্রগতিকে হুমকি মনে করে কিছু পুরুষ হয়ে উঠছে নারীবিদ্বেষী। বাধা সৃষ্টি করছে নারীর চলার পথ কিংবা চরম পরিণতিতে সম্পর্ক বিচ্ছেদ, পারিবারিক অস্থিরতা এবং কর্মসংস্থানে সংকট দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এ পরিস্থিতির দায় নারীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ মূল সমস্যা হচ্ছে পুরুষদের প্রস্তুত না করা এবং তাদের মানসিক ও সামাজিকভাবে পরিবর্তনের অংশ হিসেবে গড়ে না তোলা।
সভা-সেমিনারে নারীদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে খুবই যুক্তিযুক্ত। আবার নারী-সংক্রান্ত সভা-সেমিনারে পুরুষের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করি। পুরুষশূন্য নারীবিষয়ক আলোচনায় একই অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন তোলা উচিত। নারীর বিষয়কে কেবল নারীদের বিষয় বানিয়ে ফেলা; পুরুষদের এ আলোচনার বাইরে রাখার প্রবণতা আসলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নারীবিষয়ক কমিশন নিয়ে দেশে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে এবং এ নিয়ে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখনও আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে– এই কমিশনে কোনো পুরুষ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ এ বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করছে না।
নারীর অধিকার ও লিঙ্গ সমতা নিয়ে আলোচনা যতই হোক, তা যদি কেবল নারীদের ঘিরে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা পূর্ণতা পায় না। লিঙ্গবৈষম্য একটি কাঠামোগত ও সংস্কারনির্ভর সমস্যা, যার টেকসই সমাধানে দরকার পুরো সমাজ, বিশেষ করে পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
পরিবারে নারীর সম্ভাবনা নির্ভর করে পুরুষ সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। স্বামী যদি স্ত্রীর কর্মজীবন ও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেন অথবা বাবা যদি কন্যার স্বপ্নকে সমানভাবে মর্যাদা দেন, তবে সেটিই সমাজে ইতিবাচক বার্তা দেয়। কর্মক্ষেত্রেও পুরুষদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যৌন হয়রানি, বৈষম্যমূলক বেতন বা নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণে বাধা রোধ করতে হলে পুরুষদের নীরব দর্শক নয়, সক্রিয় অংশীদার হতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন মানে কেবল অধিকারের বিস্তার নয়; দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগও। একজন সঙ্গী হিসেবে নিজের থেকে উচ্চতর শিক্ষা, আয় কিংবা মর্যাদাসম্পন্ন পুরুষের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়তে স্বস্তি বোধ করে। একইভাবে অনেক চাকরিজীবী নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও সংসারের ব্যয়ভার পুরোটাই পুরুষ সঙ্গীর ওপর ছেড়ে দেয়। এই মানসিকতা আসলে এক অনিরাপদ, ভীতিপূর্ণ সামাজিক বেড়ে ওঠারই প্রতিফলন।
আমরা যেমন পুরুষকে বলেছি– ‘ঘরের কাজে নারীকে সাহায্য করো’, তেমনি নারীকেও বলা উচিত ছিল– ‘নিজেকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলো, যাতে বাইরের কাজেও তুমি তোমার সঙ্গীকে সহায়তা করতে পারো।’
একটি উপেক্ষিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই লিঙ্গ সমতার প্রশ্ন। পুরুষদের ওপর সমাজ যে একমুখী ‘পুরুষত্বের’ চাপ দেয়– আবেগ না দেখানো, সব দায়িত্ব একা নেওয়া, চাহিদা না বোঝা; সেই চাপ থেকে মুক্তি দেয় লিঙ্গ সমতা। এমন একটি সমাজ যেখানে পুরুষ আবেগপ্রবণ হতে পারে, সঙ্গীর সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে, কিংবা সন্তান পালনে সমানভাবে অংশ নিতে পারে, সেই সমাজে সুস্থ সম্পর্ক ও সুস্থ মানসিকতা গড়ে ওঠে। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল, সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ করা।
নারী প্রশ্নে পুরুষের উপস্থিতি নিছক সহানুভূতির নয়। এটি একটি সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। পরিবর্তনের পথ তখনই মসৃণ হবে, যখন নারী ও পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করবে। পুরুষের অনুপস্থিতি মানে সমাজের অর্ধেক শক্তির অনুপস্থিতি।
মোনছেফা তৃপ্তি: পরিবেশ ও নারী অধিকারকর্মী
munsafatripti.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সাতক্ষীরায় ৩৫ সাংবাদিক নিয়ে বাস খাদে
সাতক্ষীরার তালায় গতকাল রোববার বিকালে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থানার মির্জাপুর বাজার সংলগ্ন ইসলামকাঠির মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ওই বাসে ৩৫ জন সাংবাদিক ছিলেন। তারা সুন্দরবন সফর শেষে ঢাকায় ফিরছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৭ মে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ কাভার করার জন্য ঢাকা থেকে ৩৫ জন সাংবাদিক সাতক্ষীরা এসেছিলেন। পরে তারা সুন্দরবন সফরে যান। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে তাদের বহনকারী বাসটি তালার ইসলামকাঠির মোড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে খাদে পড়ে যায়। এ সময় বাসে থাকা অনেকে কমবেশি আহত হন। আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাস্তার খারাপ অবস্থা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর পেয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পাটকেলঘাটা থানা পুলিশ ও তালা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান।
পাটকেলঘাটা থানার ওসি মো. মাইন উদ্দীন জানান, দুর্ঘটনায় বাসটি উল্টে গেলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।