চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্ত সম্প্রতি দেশে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেছে। বিদেশি অংশগ্রহণে বিনিয়োগ ও দক্ষতা আসতে পারে, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। তবে এ ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিস্তৃত ও সুপরিকল্পিত কৌশল প্রয়োজন, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষের একার ওপর নির্ভর করে না। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল পরিচালনাকারী সরকারি সংস্থা হলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)। এটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ ছাড়া বন্দরের অভ্যন্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সরকারি সংস্থাও বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত। পাশাপাশি বেসরকারি খাত, যেমন কনটেইনার পরিচালনা, নিরাপত্তা, পণ্য হ্যান্ডলিং, শিপিং এজেন্ট, কার্গো এজেন্ট ও ফ্রেট ফরোয়ার্ডাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সংস্কার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে সামগ্রিক এবং নিশ্চিত করতে হবে সব পক্ষের কার্যকর সমন্বয়।

জুলাইয়ের ঘটনার পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতা রক্ষা, সুশাসন ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের উদ্দেশ্যে কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ নিতে পারে, এ রকম জনরায় আছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর যেমন একটি কৌশলগত খাত, সেখানে সংস্কারপ্রক্রিয়া আরও সতর্ক ও সামগ্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো জরুরি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা, অংশীজনের পরামর্শ ও রাজনৈতিক ঐকমত্য অপরিহার্য। অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের ভিত্তি তৈরি না হলে সেই সংস্কার টেকসই হবে না।

এই প্রেক্ষাপটে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। রাজনৈতিক দলসহ প্রধান অংশীজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হলে তাঁদের মতামত জানা যাবে এবং সংস্কারে সমর্থন পাওয়া সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে স্পষ্ট পথরেখা তৈরি করা দরকার, যেখানে বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকবে। তারা যেন স্থানীয় দক্ষতার বিকল্প না হয়, বরং তার সম্পূরক হিসেবে কাজ করে।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা অত্যন্ত জরুরি। সব ধরনের চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, মানুষ যেন চুক্তির শর্তাবলি পর্যালোচনা করতে পারে। জাতীয় স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে। কেবল এ ধরনের অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই চট্টগ্রাম বন্দরের টেকসই আধুনিকায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। সেটা হলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে এবং জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবে না।

সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সানেম।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে

গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বাড়ি-জমি কিনছেন, তা নিয়ে সে দেশের জনমনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লারনাকা ও লিমাসল এলাকায় ইসরায়েলিদের জায়গা–জমি কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।

বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল যেন ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে তাদের একধরনের ‘অঘোষিত উপস্থিতি’ তৈরি করে ফেলছে।

এখন গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে জনসংখ্যাগত ভারসাম্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসের স্বঘোষিত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (টিআরএনসি) দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

‘নতুন ইসরায়েল’—এ কথা এখন গ্রিক সাইপ্রাসের রাজনীতিতে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু এই পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত বসতি স্থাপন কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রিক সাইপ্রাস যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেলের নেতারা গ্রিক সাইপ্রাসকে এখন ‘ইসরায়েলের দখলে নতুন দেশ’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরায়েলি উপস্থিতি নিয়ে সেখানে একটি গুরুতর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।

স্টেফানু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি নাগরিকেরা সেখানে যে বসতি গড়ে তুলছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, তাঁদের নিজস্ব শিক্ষা, খাবার, উপাসনালয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে নিজেদের আলাদা করে রাখার মতো জায়গা বানাচ্ছেন তাঁরা। এর ফলে এই বসতির বাসিন্দারা স্থানীয় সংস্কৃতি বা সমাজে মিশে যাচ্ছেন না, বরং নিজেদের আলাদা একটি ‘মিনি ইসরায়েল’ বানিয়ে নিচ্ছেন।

এই বসতি স্থাপনের পেছনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ছাবাদ’। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় অতিরক্ষণশীল ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলন। ছাবাদ ইতিমধ্যে গ্রিক সাইপ্রাসে সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়), কিন্ডারগার্টেন (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র), কোশার খাবারের দোকান এবং কবরস্থানের মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিশ্লেষকদের মত হলো, ইসরায়েলি সম্প্রদায় শুধু পর্যটক বা অস্থায়ী বাসিন্দা নন, তাঁরা গ্রিক সাইপ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উপস্থিতি গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, সিনাগগ, কবরস্থান, কোশার খাবারের দোকান, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি অবকাঠামো স্থাপন আসলে একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের অংশ, যা ভবিষ্যতের কোনো সংকটকালে সামাজিক প্রভাব বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।

তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েত-এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।

আঙ্কারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এমেতে গোজুগোজেল্লি সেখানকার সংবাদমাধ্যম মিল্লিয়েত-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি কেবল জমি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এমন ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা শক্তিশালী মতাদর্শিক নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে, তারা নজরদারি, প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো কাজও করতে পারে।

তিনি বিশেষভাবে ছাবাদ সংগঠনের কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, এই সংগঠনের প্রভাব এরই মধ্যে তুর্কি সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাহ্যিকভাবে নিরীহ দেখালেও এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। এর মধ্যে অনেকে ইসরায়েলের ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা সমাজে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন।

গোজুগোজেল্লি সতর্ক করে বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো ‘সফট পাওয়ার’ (নরম কৌশলগত শক্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা এমন বিকল্প জনসমষ্টি তৈরি করতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এর ফলে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রাস উভয়ের রাজনৈতিক অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাব

এ ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক সীমা নিয়ে নানা জটিল বিরোধের মুখে রয়েছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিয়ে গঠিত একটি কৌশলগত জোটকে বিশ্লেষকেরা তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিরোধে গঠিত প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই জোট মূলত গ্যাস অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রতিরক্ষা সমন্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি তুরস্ককে সামুদ্রিকভাবে কার্যত ঘিরে ফেলেছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহত্তর কৌশলগত নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে। যদি লারনাকা ও লিমাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক পর্যায়ের নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান কার্যক্রম নজরদারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

নাগরিক নাকি গোয়েন্দা

পর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের আগমনকে শুধু সাধারণ অভিবাসন ভেবে ভুল করা যাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মানচিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যতের সংঘাতকালীন তৎপরতার জন্য প্রস্তুত আছেন।

আইনবিশেষজ্ঞ এমেতে গোজুগোজেল্লি বলেন, ‘এটি নিরীহ অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ তিনি নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের আদর্শিকভাবে সংযুক্ত ও সংগঠিত জনসংখ্যা শুধু নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্যই নয়, দ্বীপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করতে পারে।

ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ

ইসরায়েলিদের জমি কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা এখন মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে এসব জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে নতুন সীমানা দাবি বা রাজনৈতিক শর্ত হাজির করা হতে পারে।

তাঁরা এটিও বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যেসব একতরফা প্রতিরক্ষা ও বসতি স্থাপন চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অব গ্যারান্টি’ বা ‘গ্যারান্টি চুক্তি’ লঙ্ঘন করতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য সাইপ্রাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদানকারী) দেশ। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে এই একতরফা চুক্তিগুলো দ্বীপের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

তুরস্কের জন্য নজরদারি ও প্রতিরোধ বাড়ানোর আহ্বান

গোজুগোজেল্লি পরামর্শ দিয়েছেন, তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসকে পূর্ব উপকূল বরাবর নজরদারি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ড্রোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো উচিত। ছাবাদের মতো সংগঠনের উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিকে দক্ষিণে দখল হয়ে থাকা তুর্কি সম্পত্তির অনিরসনকৃত ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে হবে। এতে আইনি ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যগুলোও স্পষ্ট হবে।

*তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে