একসময় শুধু ক্লাসরুমেই ব্যস্ত থাকতেন। এখন তার পরিচয় একজন সফল উদ্যোক্তা। শখ থেকে শুরু করা রামবুটান চাষে নরসিংদীর শিবপুরের সাধারাচর ইউনিয়নের শিক্ষক মাওলানা আবদুল রশিদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে।
মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বর্তমানে একজন পরিচিত রামবুটান চাষি। রামবুটান থেকে যার বার্ষিক আয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
২০১৫ সালে ইউটিউবে ভিডিও দেখে রামবুটান ফল সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে নিজ বাড়ির মাত্র ৬৫ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করেন কয়েকটি রামবুটান গাছ। তখন তিনি ভাবতেও পারেননি এই উদ্যোগ একদিন তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল করে তুলবে এবং অনুপ্রেরণা জোগাবে আশপাশের বহু তরুণকে।
পরিকল্পনা, ধৈর্য, নিয়মিত পরিচর্যা ও পরিশ্রম- এই চারটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আবদুল রশিদের রামবুটান বাগান এখন বিস্তৃত হয়েছে ১৭০ শতাংশ জমিতে। চাষ শুরুর প্রায় পাঁচ বছর পর থেকেই গাছে নিয়মিত ফল আসা শুরু হয়। বর্তমানে তার বাগান থেকে উৎপাদিত রামবুটান দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে, যেখানে বাজারদর কেজিপ্রতি এক হাজার থেকে বারোশ’ টাকা পর্যন্ত।
শুধু ফল নয়, তার বাগান থেকেই উৎপাদিত চারা সংগ্রহ করছেন দেশের বিভিন্ন জেলার আগ্রহী কৃষক ও উদ্যোক্তারা। রামবুটানের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। দেখতে অনেকটা লিচুর মতো হলেও এর লোমশ খোসা ও ভিন্ন স্বাদের কারণে এই বিদেশি ফল এখন বাংলাদেশের মাটিতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মূলত মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় চাষ হওয়া এই ফল এখন বাংলাদেশের কৃষি খাতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
স্থানীয় যুবকদের মধ্যে ইতোমধ্যে এই বাগান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ও আলামিন জানান, একজন শিক্ষক এত বড় উদ্যোক্তা হয়েছেন সেটা তাদের জন্য গর্বের বিষয়। রামবুটান ফল খেতে খুব সুস্বাদু। এতে অনেক পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। বিশেষ করে এই ধরনের উদ্যোগ কৃষিকে আবারও একটি আকর্ষণীয় ও লাভজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। একজন শিক্ষক, একজন চাষি, একজন উদ্যোক্তা—মাওলানা আবদুল রশিদের এই পরিচয় এখন সমাজে দৃষ্টান্ত।
চাষি আবদুল রশিদ বলেন, “শুধু ফল বিক্রি করেই নয়, চারা বিক্রি করেও আমি ভালো আয় করছি। আমি চাই, দেশের আরও অনেক জায়গায় রামবুটান চাষ ছড়িয়ে পড়ুক। এজন্য আমি নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তাদের।”
তিনি আরো বলেন, “শুধু অর্থ উপার্জনের দিক দিয়েই নয়, এই উদ্যোগে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা-পরিশ্রম, চিন্তার ভিন্নতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত একজন সাধারণ মানুষকেও অনন্য করে তুলতে পারে। কৃষি খাতে এমন উদ্ভাবনী চিন্তা ও সফলতার গল্প দেশের প্রতিটি তরুণদের জন্য নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প হোক সেটাই আমার চাওয়া।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, “বাংলাদেশের জলবায়ু রামবুটান চাষের জন্য উপযোগী। যারা আগ্রহী, তাদের আমরা সরকারি পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত।”
ঢাকা/হৃদয়/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র মব ট ন চ ষ
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ