নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তর হোক ন্যায্য ও পরিকল্পিত
Published: 20th, May 2025 GMT
বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসের এই রূপান্তর একদিকে যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে তেমনি চ্যালেঞ্জও আনছে। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া এই রূপান্তর জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের হাজারো কর্মীর জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। পরিবেশের পাশাপাশি জ্বালানি খাতনির্ভর শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করাই হবে একটি ন্যায়সংগত রূপান্তর।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং প্রায় ১০ শতাংশ কয়লার ওপর নির্ভরশীল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের অস্থিরতা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতির কারণে দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যানে সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ শক্তিকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো– জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কক্সবাজারে নির্মাণাধীন ৬০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প।
তাছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট রুফটপ সোলার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এই অগ্রগতির পরও নবায়নযোগ্য জ্বালানি দেশের মোট বিদ্যুৎ মিশ্রণের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিপুল বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।
জ্বালানি খাতে রূপান্তরের ফলে গ্যাস অনুসন্ধান, কয়লা আমদানি এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত অনেকের চাকরি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ কাজ করেন– যাদের অধিকাংশেরই সবুজ জ্বালানিভিত্তিক দক্ষতা নেই। ফলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া তারা হয়তো বেকার হয়ে পড়বেন অথবা অনানুষ্ঠানিক ও কম মজুরির চাকরিতে ঢুকবেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত খসড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৭ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য সুসংগঠিত কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এতে শ্রমিকদের জীবিকা রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত, বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রমনির্ভর খাত তৈরি পোশাক শিল্পে।
৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় করা এই খাতের শ্রমিকরা ইতোমধ্যে সবুজ রূপান্তরের অভিঘাত টের পাচ্ছেন। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকানো মানেই স্বয়ংক্রিয়তা নয়; কিন্তু বাস্তবে প্রযুক্তি ও কার্বন-নিরপেক্ষ উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মজুরি স্থবিরতা, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।
পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপ বাড়ছে। তারা পণ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে বলছেন, কিন্তু সেই ব্যয়ভার বহনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন না। ফলে এই চাপ কারখানা মালিকদের ওপর পড়ছে এবং তারা তা নামিয়ে দিচ্ছেন সবচেয়ে দুর্বল অংশ– শ্রমিকদের ওপর।
এটাই ন্যায়সংগত রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি নয়। ন্যায়সংগত রূপান্তর এমন একটি ধারণা, যেখানে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে যাত্রা হবে ন্যায়ভিত্তিক– যেখানে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা, ফের দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। দুঃখজনকভাবে খসড়া নীতিতে এসব বিষয় অনুপস্থিত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য কোনো সহায়তা ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো বা দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রস্তাব নেই।
চার বছরের বেশি সময় ধরে খসড়া তৈরির পরও এই নীতি জাতীয় পরিকল্পনাগুলোর সঙ্গে (যেমন– বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান, মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান বা প্যারিস চুক্তির আওতায় গৃহীত প্রতিশ্রুতি-NDC) সংযুক্ত নয়। এটি নবায়নযোগ্য লক্ষ্যের সঙ্গে শ্রমিকের ন্যায়বিচার ও সাম্যতাকে সংযুক্ত করে না, যা এই রূপান্তরের টেকসইতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে।
জার্মানি, স্পেনসহ কিছু দেশ ন্যায়সংগত রূপান্তর কৌশল গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জার্মানিতে কয়লা বন্ধ করার পর ৪০ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজের মাধ্যমে কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণ, বিকল্প চাকরি সৃষ্টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে বিনিয়োগ করা হয়েছে। স্পেনে সরকার, ট্রেড ইউনিয়ন ও জ্বালানি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা ও পুনঃচাকরি কর্মসূচি চালু করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপের আওতায় আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণ ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশও এ অভিজ্ঞতাগুলো স্থানীয় প্রেক্ষাপটে মানিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে একটি ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জ্বালানি রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশে প্রয়োজন কর্মসংস্থান রক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারকে একীভূত করে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করা। সরকার, বেসরকারি খাত ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে সৌর প্যানেল ইনস্টলেশন, বায়ু টারবাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি সঞ্চয় প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য মজুরি ভর্তুকি, পেনশন নিরাপত্তা ও চাকরি পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি চালু। ট্যাক্স ছাড় ও স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি উৎসাহিত করা। জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে শ্রমিক স্থানান্তর পরিকল্পনা ও টেকসই শিল্প উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।
একটি সুপরিকল্পিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তর ইনস্টলেশন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সবুজ প্রযুক্তি উৎপাদনে হাজার হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারে। তবে পরিকল্পনার অভাবে এই রূপান্তর বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি ব্যবস্থাপনা যেন শুধু সবুজ নয় বরং ন্যায়সংগত ও মানবিক হয়, যাতে করে পরিবেশের সুরক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি শ্রমিকের জীবিকার নিশ্চয়তা বজায় থাকে।
সাইফুন্নাহার সুমি: সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: লক ষ য র জন য র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকার পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে ভারত
ঢাকা ভিত্তিক ‘পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের’ সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি বাতিল করেছে ভারতের আহমেদাবাদ ভিত্তিক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন (এনআইডি)।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এনআইডি জানিয়েছে, ‘জাতীয় অগ্রাধিকার এবং ভাবাবেগের স্বার্থে’ তারা ঢাকা ভিত্তিক পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, কয়েক বছর আগে এনআইডি এবং পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট উভয়ই পারস্পরিক উপযোগী শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য একটি সহযোগিতামূলক চুক্তি করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে জাতীয় অগ্রাধিকারের সর্বোচ্চ স্বার্থে এবং জাতীয় ভাবাবেগের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সেই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। নৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এনআইডি সেই সহযোগিতামূলক চুক্তির সমাপ্তি প্রক্রিয়া করেছে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় ডিজাইন ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে অন্যতম এনআইডি। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে শিল্প, যোগাযোগ, টেক্সটাইল এবং আইটি ইন্টিগ্রেটেড ডিজাইনের জন্য সেরা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে প্রশংসিত। এটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক একটি বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা সংস্থা হিসেবেও স্বীকৃত।
অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া ‘পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট’ নামক প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ ফটোগ্রাফি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফটোগ্রাফির পাশাপাশি, চলচ্চিত্র এবং মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার ওপর বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।