সামাজিক সংস্কারের কারণে মাসিক নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। মাসিক নিয়ে সচেতনতার অভাবে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ভিন্ন ভিন্ন জরিপে দেখা যায়, এখনো দেশের ৭১ থেকে ৮৩ শতাংশ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। মাসিকের সময় অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করার কারণে তাঁরা সংক্রমণঝুঁকিতে পড়েন। অনেকে রাসায়নিক সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহার করেন, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
২৮ মে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। বৈঠকে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে পরিবার ও স্কুল থেকে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা। ‘সংক্রমণমুক্ত ও নিরাপদ মাসিক নারীর অধিকার’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) ও স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্র্যান্ড সেনোরা।
ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও ওয়াটারএইডের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ (জাতীয় স্বাস্থ্যবিধি জরিপ) প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে কিশোরীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে ২৯ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করে। দরিদ্র পরিবারগুলোর কিশোরী ও নারীদের মধ্যে প্যাড ব্যবহারের হার যথাক্রমে ১১ শতাংশ ও ৬ শতাংশ।
গোলটেবিল বৈঠকে মাসিক সুরক্ষা নিয়ে কান্তার বাংলাদেশের একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরেন স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং জেসমিন জামান। ওই জরিপের তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ নারী নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। দেশে ৯৭ শতাংশ মেয়ে কোনো না কোনো সময় সার্ভিক্স (জরায়ুর নিচের দিকে সরু অংশ) সংক্রমণে ভোগেন। যাঁরা মাসিকের সময় অস্বাস্থ্যকর কাপড়, তুলা বা রাসায়নিক সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। মাসিকের সময় গড়ে ৪০ শতাংশ ছাত্রী স্কুলে গড়ে ৩ দিন অনুপস্থিত থাকে। তৈরি পোশাক কারখানায় মাসিকের কারণে মাসে গড়ে ৬ দিন পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকেন নারী কর্মীরা। ওজিএসবি ও সেনোরা ২ হাজার স্কুল ও ৫০০ পোশাক কারখানায় প্যাড ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টিতে একযোগে কাজ করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ নারী যেন নিরাপদ মাসিক চর্চার মধ্যে ঢুকতে পারেন, সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হবে।
বৈঠকে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, অনেক নারী ও কিশোরী মাসিকের সময় প্যাডের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করে। লোকলজ্জায় সেসব কাপড় ভালোভাবে শুকাতেও পারে না। মা ও মেয়েদের জানা উচিত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের মাধ্যমে অল্প শ্রম দিয়েই তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারেন। সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহারের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করে তিনি বলেন, প্রজনন অঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। মাসিকের সময় অ্যাসিডিক ভাব কম থাকে। সে সময় কেমিক্যালযুক্ত সুগন্ধি প্যাড ব্যবহার করলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম পরিবারের নারী–পুরুষ সবাইকে মাসিক নিয়ে কথা বলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাড়িতে আলোচনা করা উচিত যে মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। স্কুলের পাঠ্যক্রমে মাসিকসহ প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায় থাকলেও তা পড়ানো হয় না। এটা দুঃখজনক। স্কুলে মেয়েদের জন্য ভালো শৌচাগার থাকে না। একটি মেয়ের প্যাড পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে প্রসবের পর নারীদের বিনা মূল্যে প্যাড দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি।
ওজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ বলেন, মাসিক নিয়ে গুরুতর কোনো সমস্যা না হলে কেউ চিকিৎসকের কাছে আসেন না। অথচ একটি মেয়ের মাসিক শুরু হলে তার ভবিষ্যৎ সুস্বাস্থ্যের জন্য কীভাবে সুরক্ষিতভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা করা যায়, তা জানতে আসেন না। মাসিক নিয়ে লজ্জা ও মাসিকের বিষয়টি গুরুত্ব না দেওয়ার যে প্রবণতা রয়েছে, তার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহার না করার ওপর জোর দেন।
হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা গমেজ বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে শৌচাগারে নিউজপেপার ছোট ছোট টুকরা করে দেওয়া থাকে, যাতে প্যাড মুড়িয়ে অ্যালুমিনিয়ামের ঝুড়িতে ফেলা হয়। মেয়েদের নিয়মিত মাসিক ব্যবস্থাপনা ও প্যাড ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে জানানো হয়। তবে দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, মাসিক নিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে পরিবর্তন আসবেই।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা.
স্যানিটারি প্যাডের দাম কমানোর ওপর জোর দিয়ে শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য তাসলিমা আখতার বলেন, শ্রমজীবী মানুষের অর্থসংকটের কারণে তাঁদের মধ্যে মাসিক সুরক্ষায় প্যাড ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী। সংখ্যাটি ৫ কোটি ধরে এবং মাসে মাসিকের পেছনে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গড়ে একেকজনের ৩০০ টাকা করে খরচের হিসাব ধরলে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকার এটা সবার জন্য বিনা মূল্যে না দিতে পারলেও অন্তত কমিউনিটি হাসপাতালে বিনা মূল্যে দিতে পারে। এতে করে প্যাড ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে উঠবে। ‘স্বাস্থ্যই প্রথম’ স্লোগান সামনে রেখে স্কুলে স্বাস্থ্যকল্যাণ ক্লাব গড়ে তোলা প্রয়োজন।
ওজিএসবির সহসভাপতি অধ্যাপক সাবেরা খাতুন বলেন, অন্তত ছয় ঘণ্টা পরপর প্যাড পরিবর্তন করতে হবে। সংক্রমণ থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। অনেকে প্যাডের ওপর টিস্যু ব্যবহার করেন, সেটাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেকে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করেন। এটা কতটা ঝুঁকিমুক্ত, এটা সরকার অনুমোদিত কি না সেটা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, পরিবারের নারী সদস্যদের মাসিক সুরক্ষায় পুরুষকে সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওনক হাসান। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প য ড ব যবহ র র ব যবহ র কর ন ম স ক স রক ষ ম স ক র সময় প রথম আল স ক রমণ ব যবস থ পর ব র ন বল ন র জন য র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বন্ধ্যাত্বে ভুগছেন: ডব্লিউএইচও
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথমবারের মতো বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা উন্নত করার জন্য গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। ডব্লিউএইচও তাদের প্রতিবেদনটি শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) প্রকাশ করেছে।
শনিবার (২৯ নভেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফিপির বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে মালয় টাইমস।
আরো পড়ুন:
পুতুলকে নিয়ে ভাবমূর্তি সংকটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
কোভিড-১৯ এর টিকার নতুন সুপারিশমালা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
ডব্লিউএইচও’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন তাদের জীবদ্দশায় বন্ধ্যাত্বের সম্মুখীন হয়ে থাকে। এই অবস্থা সব অঞ্চল এবং আয়ের স্তরের ব্যক্তি এবং দম্পতিদের প্রভাবিত করে। কিন্তু তারপরও নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই কম।
ডব্লিউএইচও’র যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান প্যাসকেল অ্যালোটি সাংবাদিকদের বলেন, বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি ‘অনেক দিন ধরে’ অবহেলিত রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, নতুন গাইডলাইনটি একীভূত ও প্রমাণভিত্তিক ভিত্তি প্রদান করবে যাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিরাপদ, কার্যকর ও সকলের জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য হয়।
ডব্লিউএইচও-এর মতে, বন্ধ্যাত্ব হলো পুরুষ ও নারী প্রজনন ব্যবস্থার একটি অবস্থা, যা ১২ মাস বা তার বেশি সময় ধরে নিয়মিত অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের পরে গর্ভধারণ করতে অক্ষমতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই পরিস্থিতি বড় ধরনের দুর্দশা, কলঙ্ক ও আর্থিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ডব্লিউএইচও বলেছে, বেশ কয়েকটি দেশে বন্ধ্যাত্ব পরীক্ষা ও চিকিৎসার বেশিরভাগ খরচ রোগীদের বহন করতে হয়, যা প্রায়শই ‘বিপর্যয়কর আর্থিক ব্যয়’ ডেকে আনে। কিছু পরিস্থিতিতে, এমনকি ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) এর একটি রাউন্ডের খরচও গড় বার্ষিক পরিবারের আয়ের দ্বিগুণ হতে পারে।
বন্ধ্যাত্বের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শুক্রবার প্রকাশিত প্রথম গাইডলাইনে ৪০টি সুপারিশ রয়েছে। যা বন্ধ্যাত্বের সাধারণ কারণ খুঁজে বের করার জন্য নির্দিষ্ট রোগ বা অবস্থা জানার জন্য একটি যত্ন, নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য প্রমাণ-ভিত্তিক পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সম্পর্কে বয়সের ব্যবধান, যৌন সংক্রমণ সম্পর্কিত বিষয়ে অসচেতনতা, দ্বন্দ্ব, দুর্দশা এবং আর্থিক কষ্টের কারণ বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে বলে প্রতিবেদেন উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নতমানের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে আরো বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর খাদ্য, শারীরিক কার্যকলাপ এবং তামাক ব্যবহার বন্ধের মতো জীবনধারার ব্যবস্থাগুলো সুপারিশ করা হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ