নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপে ষাটের দশকের প্রথম দিকেই যে কৃত্রিম ‘সুন্দরবন’ সৃষ্টির উদ্যোগ শুরু হয়, দেশ স্বাধীনের পরও তা অব্যাহত থাকে। ধীরে ধীরে সেখানে শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) গাছের চারাগুলো মাথা তুলে দাঁড়ায়। সঙ্গে হরিণের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৯৭৪ থেকে ’৭৯ সালের মধ্যে বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপে ১৪টি হরিণ অবমুক্ত করে। ১৯৯৬ সালের শুমারিতে দেখা যায়, দ্বীপটিতে হরিণের সংখ্যা বেড়ে ২২ হাজার হয়েছে। এখন সেখানে হরিণের সংখ্যা দুই হাজারও হয় কি না সন্দেহ।

৩০ বছর ধরে নিঝুম দ্বীপে বসবাস করছেন জেলে আবদুল আলীম। গত মে মাসে দ্বীপের নামার বাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে দ্বীপের চারদিকে খালি হরিণ আর হরিণ আছিল। এত হরিণ আছিল যে মানুষ গনা যাইত, কিন্তু হরিণ গনা যাইত না। এখন হরিণ দেখাই যায় না, আর মানুষ তো গইনা কূল পাওয়া যায় না।’

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, হরিণ নিয়ে শুরুতেই করা হয় মস্ত এক ভুল। প্রতিবেশ বিবেচনা না করেই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বনে ছাড়া হয় হরিণ। যেখানে হরিণ থাকবে, সেখানে বাঘ, বানর, কুমির ও ম্যানগ্রোভ বনের অন্য সব প্রাণী ও উদ্ভিদ থাকতেই হবে। নইলে খাদ্যচক্র, বাস্তুতন্ত্রের মতো প্রাকৃতিক সূত্রগুলোর ব্যত্যয় ঘটে ডেকে আনবে বিপর্যয়। মানবসৃষ্ট নিঝুম দ্বীপের ‘সুন্দরবনে’ অবমুক্ত করা হরিণের বেলায় সেটাই ঘটেছে। প্রকৃতির এই অমোঘ বিধানের কথা তখন মাথায় আসেনি প্রশাসনের। ফলে যা ঘটার, তা-ই ঘটেছে; অস্বাভাবিক গতিতে হরিণের বংশবৃদ্ধি যেমন হয়েছে, তেমনি আবার অস্বাভাবিক গতিতেই হয়েছে বংশনাশ।

ওদিকে নিঝুম দ্বীপে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পাশাপাশি আবার সরকারি সিদ্ধান্তেই সেখানে লোকালয়করণের মতো দ্বিমুখী নীতিও কাল হয়ে উঠেছে হরিণের জন্য। একেক সময় একেক দল সরকার গঠন করেছে আর নিজেদের ভোটব্যাংক বাড়াতে দলীয় সমর্থক গোষ্ঠীকে বনের জমি বন্দোবস্ত দিয়ে দ্বীপে ঢুকিয়েছে। এই মানুষেরা দ্বীপের মধ্যে যাচ্ছেতাই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হরিণের বাসস্থান ধ্বংস করে এদের বংশ নিপাত করেছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্যহীনতার কারণে ধীরে ধীরে নিঝুম দ্বীপে বুনো কুকুর ও শিয়াল বাড়তে থাকে এবং তারা হরিণের বাচ্চা ধরে খেয়ে ফেলে। জোয়ার, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মারা পড়ে হাজারো হরিণ। লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় হরিণেরা সুপেয় পানির অভাবে পড়ে। একটা পর্যায়ে স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকেরা হরিণ ধরে খাওয়া শুরু করেন। 

একাকী হরিণ বিপাকে

বন বিভাগের প্রকাশনা নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১৫-২০২৫-এর তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সাল থেকেই নিঝুম দ্বীপে স্বল্প পরিসরে বনায়ন শুরু হয়। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছর থেকে পুরোদমে বনায়নের কাজ শুরু করে বন বিভাগ।

বন বিভাগের তথ্য ও বন্য প্রাণী গবেষকদের মতামত থেকে জানা যায়, বনায়নের শুরুতে নিঝুম দ্বীপে চার ধরনের গাছ লাগানো হয়—কেওড়া, গেওয়া, বাইন ও কাঁকড়া। কেওড়াগাছের পাতা আর দূর্বা ঘাস হরিণের প্রধান খাবার। যে সময় হরিণ ছাড়া হয়, তখন এই বনের কেওড়াগাছের উচ্চতা হরিণের নাগালের মধ্যেই ছিল। হাজার হাজার কেওড়াগাছে হরিণের খাবার ছিল অফুরান। আর হরিণ শিকার করে খাবে, এমন কোনো প্রাণীও বনে ছিল না। ফলে তরতর করে হরিণের বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। দুই দশকের মধ্যে হরিণের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছায় ২২ হাজারে। ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারি থেকে এই সংখ্যা জানা যায়।

স্ত্রী চিত্রা হরিণ ১৪ থেকে ১৭ মাস বয়সের মধ্যে মা হওয়ার উপযোগী হয়। গর্ভধারণকাল হয় ২১০-২২৫ দিন। সাধারণত বসন্তকালে হরিণ বাচ্চা প্রসব করে। একসঙ্গে একটি, কখনো দুটি শাবকেরও জন্ম হয়। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত তারা মায়ের দুধ খায়। এই ছয় মাসের মধ্যে যদি শাবক মারা যায়, তবে মা আবারও প্রজননক্ষম হয়। বনের হরিণ ৯ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত বাঁচে। প্রায় প্রতিবছরই বাচ্চা দিতে পারে স্ত্রী হরিণ। ২০১৯ সালে স্পটেড ডিয়ার শিরোনামে নেপালের হারিও বন কর্মসূচির একটি প্রকাশনা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

নিঝুম দ্বীপের বনে একদিকে হরিণ বাড়তে থাকে, অন্যদিকে বাড়ে গাছের উচ্চতাও। একটা পর্যায়ে গাছের পাতা হরিণের নাগালের বাইরে চলে যায়। আবার বাড়তি হরিণের খাদ্যচাহিদাও বেড়ে যায়। পরে খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে ঢুকে পড়তে থাকে হরিণ। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম আলোকে জানান, একটা সময় বাড়ির উঠানে লাগানো সবজিগাছও খেয়ে ফেলা শুরু করে হরিণের দল। দেখা যায়, রান্না করে রাখা হাঁড়িভর্তি ভাত সাবাড় হয়ে গেছে। ধানখেতেও হানা দিত হরিণের পাল; দলবেঁধে খেয়ে ফেলত ফসল। খাবারের সন্ধানে বনের ভেতরে-বাইরে, সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াতে থাকে হাজার হাজার হরিণ। হরিণের সংখ্যা এত বাড়ে যে ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাডভাইজারি কমিটির পক্ষ থেকে হরিণ শিকারের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নেওয়া হয়। ২০০৬ সালে এই বোর্ড তাদের ২১তম সভায় নিঝুম দ্বীপে হরিণ শিকারের অনুমতি দিয়ে হরিণের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর পরামর্শ দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, নিঝুম দ্বীপের যে আয়তন, তা এত বেশি হরিণের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

বন্য প্রাণী গবেষক, বন বিভাগের তথ্য, নিঝুম দ্বীপ নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণাপত্র এবং স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকেই হরিণের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০০৬ সালে করা এক গবেষণায় এই দ্বীপে হরিণের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪০০ পাওয়া যায়। কিন্তু এই সংখ্যাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বন্য প্রাণী গবেষকদের মতে, যেকোনো বনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে চিত্রা হরিণ ৪০ থেকে ৬০টি থাকলেই ওই বনে ভালো সংখ্যায় হরিণ টিকে আছে বলে ধরা হয়।

২০০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাডভাইজারি বোর্ডের একটি প্রতিনিধিদল নিঝুম দ্বীপের হরিণের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য সেখানে যায়। কিন্তু তারা দুই দিন নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চলে ঘুরে মাত্র একটি হরিণ দেখতে পায়। পরে তারা হরিণ শিকারের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংঘ আইইউসিএনের ২০১৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের রেড লিস্ট খণ্ড ২: স্তন্যপায়ী প্রাণী বইয়ে বলা হয়, ২০০৬ সালে নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি ছিল। কিন্তু আবাসস্থল হ্রাস, খাদ্যসংকট এবং শিয়াল ও বন্য কুকুর দ্বারা নবজাতক হরিণ শিকারের কারণে এই সংখ্যা ২০১৫ সালে দুই হাজারের নিচে নেমে আসে।

গত মে মাসেও নিঝুম দ্বীপে সরেজমিনে মাত্র একটি হরিণের দেখা পাওয়া যায়। বন বিভাগের নিয়মিত টইলেও হরিণ দেখা যায় খুবই কম। এক মাসে (৮ এপ্রিল থেকে ১০ মে) তারা মাত্র আটটি হরিণ দেখেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান।

সে সময় নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিঝুম দ্বীপের ৪০ হাজার ৩৯০ একর জমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল। সেখানে এখন ইউনিয়ন পরিষদ হয়েছে। মানুষ বেড়েছে। মানুষ আর বন্য প্রাণী তো পাশাপাশি থাকতে পারে না! তাই ধীরে ধীরে হরিণ কমে গেছে।’

‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’

জলদস্যু ও স্থানীয়দের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হরিণ পাচার ও হরিণের মাংস বিক্রি শুরু করে। ছোট বা মাঝারি আকারের একেকটি হরিণ ২৫-৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়ায় অনেক বাসিন্দাও হরিণ শিকার ও পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।

বন বিভাগের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর হরিণ পাচারের একটি মামলা করা হয়। এজাহারে বলা হয়, ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টায় কোস্টগার্ডের তমরুদ্দিন ক্যাম্পের সদস্যরা একটি দেশি নৌকায় জীবন্ত চিত্রা হরিণ পরিবহনকালে সাত ব্যক্তিকে আটক করে। পরে বন বিভাগের লোকজন হরিণ ও আটক ব্যক্তিদের নিজেদের হেফাজতে নেয়।

২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর করা আরেকটি মামলার এজাহারে বলা হয়, নোয়াখালীর নলচিরা রেঞ্জের ঢালচর বিটের নিউচর জোনাক সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ছয়জনের একটি দল একটি চিত্রা হরিণ শিকার করে। হরিণটিকে গাছে ঝুলিয়ে দুজন চামড়া ছাড়াচ্ছিল আর দুজন ওই কাজে সহযোগিতা করছিল। বাকি দুজন হরিণ ধরার জাল (ফাঁদ) গুটাচ্ছিল। পরে কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় তাদের সেখান থেকে আটক করা হয়।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১২ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধিত হয়ে কার্যকর হওয়ার আগপর্যন্ত মানুষ গোপনে এবং প্রকাশ্যে হরিণ শিকার করত; হরিণ ধরে রান্না করে খেত।

১৯৮৮ সালে পুনর্বাসনের সময় নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার এলাকায় বসত গড়েন আবদুল মালেক (৬২)। গত মে মাসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন সময় আছিল, যখন প্রতিদিন হরিণ ধইরা জবাই করা হইতো। দ্বীপে এমন কোনো মানুষ নাই, যে হরিণের মাংস খায় নাই।’

২০১৫ সালের মার্চে নিঝুম দ্বীপের ছোঁয়াখালীতে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে হরিণ শিকার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন। দুটি আগ্নেয়াস্ত্রও আটক করা হয় তখন। 

শিয়াল ও বুনো কুকুরও হরিণ ধরে খাওয়া শুরু করে বলে জানান নোয়াখালী বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের চর ওসমান বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহাগ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সময় দ্বীপে শিয়াল ছিল না। জোয়ারের পানিতে অন্য অঞ্চল থেকে এখানে ভেসে আসে শিয়াল। পরে দেখা যায়, শিয়াল হরিণশাবক ধরে ধরে খায়। বিশেষ করে হরিণেরা যখন সপরিবার পুকুরে পানি খেতে আসে, তখন শিয়াল হরিণশাবককে আক্রমণ করে। এখন দ্বীপে শিয়ালের সংখ্যা অনেক বেশি।’

জলবায়ুর অভিঘাত

বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, আইলার মতো বড় ঘূর্ণিঝড়গুলোতেও প্রচুর পরিমাণে হরিণ মারা পড়েছে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই হাজার হাজার হরিণ ভেসে গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজের তত্ত্বাবধানে করা একটি গবেষণায় বলা হয়, বর্ষাকালে কিছু হরিণের খুরারোগ হয়। তখন ওদের হাঁটতে কষ্ট হয়। এ রকম কিছু হরিণ কুকুরের কামড়ে মারা পড়ে। গবেষণায় ২৬৮টি মরা হরিণের হাড় ও মাথা নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্ত্রী হরিণ বেশি মারা পড়ায় বংশবিস্তারও কমে যায়। বনে সুপেয় পানির অভাবও দেখা দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে। (শেষ)

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী]

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

তিন শূন্য তত্ত্ব: বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ

সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্য তত্ত্বকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেন। ওই বক্তব্যে ড. ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শূন্য তত্ত্ব এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। এতে গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী। তিন শূন্য অর্জনে তিনি চারটি মহাশক্তির কথা বলেছেন– তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। তাঁর মতে, প্রত্যেক তরুণ হবে ‘থ্রি জিরো পারসন সিটিজেন’। অর্থাৎ তারা কার্বন নিঃসরণ করবে না; সম্পদ মজুতের পরিবর্তে সামাজিক ব্যবসা করবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণে উদ্যোগী হবে। 
বস্তুত বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও তিন শূন্য তত্ত্বের ধারণা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এখানে বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সীমানাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার মূল লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু বর্তমানে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলছে, তা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। উন্নত রাষ্ট্রগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেনেও বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে দুর্বল বা অনুন্নত দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করছে। জাতিসংঘ ২০১৫ সালে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে পেশ করে। এসডিজি নামে পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য টেকসই বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা। এসডিজির মধ্যে আছে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার। লক্ষণীয়, ২০১৫ সালেই তিন শূন্য তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপিত হয় রাজধানী ঢাকার চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৫’ উদযাপনকালে এ তত্ত্ব দেন। অর্থাৎ শূন্য তত্ত্ব ও এসডিজি বিশ্ববাসীর কাছে কাছাকাছি সময়ে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘শূন্য তত্ত্ব’ হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রদত্ত ব্যক্তিগত মতবাদ। বিশ্ব সুরক্ষায় প্রদত্ত এ দার্শনিক মতবাদ এসডিজির সামগ্রিক লক্ষ্যের সমন্বিত রূপ। ড. ইউনূসের শূন্য তত্ত্বের ধারণা থেকেই বিশ্ববাসী এসডিজি বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা পাবে বলে আমি মনে করি।

১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থায় মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক উত্তরণের লক্ষ্যে লেবার পার্টির পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রী আর্থার গ্রিনউড ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তমতে, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম হেনরি বিভারিজের নেতৃত্বে ‘ইন্টারডিপার্টমেন্টাল কমিটি অন সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড অ্যালায়েড সার্ভিসেস’ শীর্ষক কমিটি গঠন করা হয়। বিভারিজ কমিশনের রিপোর্ট আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আর্থনৈতিক সংস্কার সাধন ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আজও একটি আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। বিভারেজ কমিশনের রিপোর্ট সমাজের অগ্রগতির পথে পাঁচটি অন্তরায় চিহ্নিত করেছিল। চিহ্নিত অন্তরায়গুলো হলো– অভাব, রোগব্যাধি, অজ্ঞতা, মলিনতা ও অলসতা, যা পঞ্চদৈত্য হিসেবে বিবেচিত। গত শতাব্দীর সমস্যা ও বর্তমান শতকের সংকটের ধরনে বহুলাংশে মিল রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বর্তমান শতকের বিরাজমান সব সমস্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই তিন শূন্য তত্ত্বের লক্ষ্য অর্জনে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব হয়। 

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার মহান অঙ্গীকার। একদিন তরুণ প্রজন্ম শপথ নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীন করেছিল বাংলাদেশ। উৎসর্গ করেছিল মূল্যবান জীবন। কিন্তু শহীদের বিসর্জন ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার পরিচালনাকারীরা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তারা স্বাধীনতার সুবিধাভোগী কিংবা হননকারী হিসেবে অতিমুনাফা, লুণ্ঠন, দুর্বৃত্তায়ন ও মুদ্রা পাচারে লিপ্ত। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের প্রাথমিক ফলমতে, বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসাবে অতিদ্রুত বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ প্রতিবেদন-২০১৮’ মতে, এ দেশে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি তরুণ সমাজ বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে দেশে একটি গণবিপ্লবের সূচনা করেছে। আশা করা যায়, এ বিপ্লবের ফলে শূন্য তত্ত্বের বাস্তবায়ন গতিশীল হবে। দেশের দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থান সংকট দূর হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা হোক সবার অঙ্গীকার।

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও, ঢাকা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তিন শূন্য তত্ত্ব: বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ