বিনিয়োগ সহায়ক নীতি ও সেবার দায়িত্বও নিতে হবে এনবিআরকে
Published: 26th, January 2025 GMT
বাণিজ্য-বিনিয়োগ নিয়ে অনেক আশাবাদ শোনা গেছে অতীতে। এখন সময় এসেছে প্রয়োজনীয় সেবা এবং মানের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করার। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় সেবা প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ প্রতিষ্ঠানকে শুধু রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করলেই হবে না; বাণিজ্য বিনিয়োগ সহায়ক নীতি এবং সেবার দায়িত্বও পালন করতে হবে। তা না হলে শুধু ভালো কথায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনা সম্ভব হবে না।
গতকাল রোববার ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে নীতির সমন্বয়’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা এবং তাদের প্রতিনিধিরা। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে এ সভার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা ড.
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একটা অংশ এখন দেশে নেই। তারা বিপুল পরিমাণে অর্থসম্পদ বাইরে নিয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন খালি রয়েছে কেন? প্রায় সব দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ টাকা বাইরে নিয়ে গেছে একটি চক্র। এটা ক্ষমার যোগ্য নয়। বেসরকারি খাতকেও প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
ভ্যাটের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে তারা একটি সিদ্ধান্তে আসবেন। এ সময় পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন তিনি। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেড ক্যাটেগরির কোম্পানির শেয়ারের অনেক লেনদেন হয়। দেখা গেছে, কিছু কারখানায় গরু-ছাগল চরে বেড়ায়; কিন্তু শেয়ারের দর বেশি।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, আমদানি শুল্ক প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এগুলো সব একসঙ্গে প্রত্যাহার করা কঠিন হয়ে যাবে। তবে পর্যায়ক্রমে করা যাবে। তিনি বলেন, কাস্টম হাউসগুলো সরকারের অর্থ আয়ের মেশিন হওয়া উচিত নয়। বরং এগুলোকে ব্যবসার সহায়ক হিসেবে কাজ করতে হবে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, শুধু কর সংগ্রহ নয়, এনবিআরের উচিত বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানের দিকেও মনোযোগ দেওয়া। বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সের বাইরে চিন্তা করে সব খাতের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে। বিভিন্ন সংস্থাকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী বিনিয়োগ সংস্থা গঠন করে তাদের ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। খরচের ব্যাপারে সরকারকে আরও দক্ষ ও সাশ্রয়ী হতে হবে। ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়ানোর আগে নিজেদের ব্যয় কমানো উচিত। ব্যাংক ঋণের সুদহার একক অঙ্কে আনতে হবে।
মূল প্রবন্ধে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নেই। বিশেষ করে জিডিপির তুলনায় বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ কম। এই পরিস্থিতি উত্তরণে বিদ্যমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতি সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া শুল্ক-কর নিয়ে বিদ্যমান জটিলতা নিরসন করতে হবে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টার পরিবর্তে সম্প্রতি ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। বর্তমানে সরকারের অগ্রাধিকার বিষয় হওয়া উচিত দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও কর্মসংস্থান। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদহার।
কোকা-কোলা বাংলাদেশের এমডি শাদাব আহমেদ খান বলেন, সরকারকে নতুন বিনিয়োগ ও পুনর্বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন তারা। কিন্তু এ জন্য শুল্ক-কর কমিয়ে বিনিয়োগের সুরক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ বিজয় বলেন, বর্তমানে দেশের ব্যবসায়ীরা আস্থার অভাবে ভুগছেন। এটি দূর
করা প্রয়োজন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে হামলা যেভাবে যুদ্ধের নৈতিক যুক্তি পাল্টে দিল
গত ১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের ওপর আসন্ন হামলার আশঙ্কায় আক্রমণ চালায়। বিস্ফোরণের শব্দে ইরানের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে ওঠে। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল ইরানের ফর্দো ও নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, গবেষণাগার এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের বাসভবন। অভিযান শেষে দেখা যায় ইসরায়েল ৯৭৪ ইরানিকে হত্যা করেছে। ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারান ২৮ জন।
ইসরায়েল তাদের এ হামলাকে আগাম ‘আত্মরক্ষা’ বলে বর্ণনা করেছে। তাদের দাবি, একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে ইরান মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদন—কোথাও এমন প্রমাণ মেলেনি। এ হামলা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইরানি কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটি নতুন পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল।
সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?কিন্তু সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?
নৈতিকতাবিদ ও আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা ‘প্রি-এম্পটিভ’ যুদ্ধ ও ‘প্রিভেন্টিভ’ যুদ্ধের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনেছেন। প্রি-এম্পটিভ যুদ্ধ হয় আসন্ন হুমকির প্রতিক্রিয়ায়। অপর দিকে প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ চালানো হয় ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাব্য হুমকির আশঙ্কা থেকে।
শুধু প্রথম ধরনের যুদ্ধটিই নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য। তথাকথিত ক্যারোলাইন সূত্রে দেখা যায়, প্রি-এম্পটিভ হামলা তখনই ন্যায্য হতে পারে, যদি হুমকিটি হয় ‘তাৎক্ষণিক, চরম এবং এমন অবস্থায় যে বিকল্প কোনো উপায় নেই’। কিন্তু ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ এসব পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করছিল না। কূটনৈতিক পথও পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল না। এ হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের যে ঝুঁকি ছিল (তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া), তা সামরিক প্রয়োজনীয়তার সীমা বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে।
আইন নৈতিক বিধিনিষেধের প্রতিফলন করে। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ৫১ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদটিতে কোথাও সশস্ত্র আক্রমণ হলে, তারপর আত্মরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল যে ‘পূর্বসতর্কতামূলক আত্মরক্ষা’র কথা বলেছে, সেটি একটি বিতর্কিত আইনি প্রথার ওপর দাঁড়িয়ে তারা বলছে। এটি কোনো স্বীকৃত চুক্তিভিত্তিক আইন নয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের হামলাকে ‘একটি নগ্ন আগ্রাসন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই আইন লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থার ভিতকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে। একটি রাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রি-এম্পশন বা আগাম হামলার যুক্তি দাঁড় করাতে পারে, তাহলে অন্যরাও তা করবে। যেমন চীন তাইওয়ানের কাছে টহলদারি দেখে আক্রমণ করতে পারে কিংবা পাকিস্তান ভারতের কথিত সামরিক তৎপরতাকে কেন্দ্র করে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে।
ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনকারীরা যুক্তি দিতে পারেন, অস্তিত্বের হুমকি থাকলে তখন চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করা ন্যায্য। ইরানের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন এবং নিয়মিতভাবে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন।
এখানে যে ঐতিহাসিক ক্ষত আছে, সেটা বাস্তব। কিন্তু দার্শনিকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে বক্তব্য তা যতই বিদ্বেষপূর্ণ হোক না কেন, সেটা কাজের সমান নয়। উসকানিমূলক বক্তব্য আর সশস্ত্র হামলার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। যদি শুধু কথাটাই যুদ্ধ শুরুর ন্যায্যতা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে যেকোনো দেশই অপছন্দের বক্তৃতাকে অজুহাত বানিয়ে আগাম হামলা চালাতে শুরু করতে পারে। ফলে বিশ্ব ‘আদিম রাষ্ট্রের’ দশায় ঢুকে যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত যুদ্ধ শুরুর অজুহাত হয়ে দাঁড়াবে।
ড্রোন নজরদারি আর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাগুলো যখন প্রতিদিনের ভূরাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তখন যুদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাভাবিক বিষয়। আর শান্তি হয়ে যায় ব্যতিক্রমী ঘটনা।
● হোসেইন দাব্বাঘ নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি লন্ডন–এর দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত