৮ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা
Published: 4th, February 2025 GMT
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেটের আকার এমন ধরেই আয়-ব্যয়ের খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে এটি তুলে ধরা হবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ সংক্রান্ত সভায় অর্থ উপদেষ্টা ড.
সভায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে একটি সম্ভাব্য সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবেন অর্থ সচিব। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় ৬ লাখ ২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্যও ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট রেখে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী অর্থবছরের যে বাজেট বরাদ্দ ধরা হয়েছে, তা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে দেওয়া হয়েছিল চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সম্পদ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বৈঠকে আগামী অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটের খসড়া তুলে ধরা হয়। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আকার খানিকটা কমানো হয়েছে। আগামী জুনে এ বাজেট চূড়ান্ত করার সময় কিছু পরিবর্তন হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ও সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বেশি না থাকায় আগামী বাজেটেও ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট হওয়া উচিত।
জানা গেছে, আগামী বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে কর্মসংস্থান বাড়ানো ও সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ব্যয় ৮ লাখ কোটি টাকার বেশিই ধরা হচ্ছে। কারণ অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, সরকারি ব্যয় বিশেষত উন্নয়ন ব্যয় একেবারে কমে গেলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আগামী অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এডিপির বাস্তবায়ন মাত্র ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রকল্প কাটছাঁট করা হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্পে পর্যালোচনা করে কমানো হয়েছে ব্যয়। একই সঙ্গে সম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে উন্নয়ন কাজে কাঙ্ক্ষিত গতি না আসায় এডিপি বাস্তবায়ন কমে গেছে। অর্থ বিভাগ মনে করছে, অর্থবছর শেষে এডিপির বরাদ্দের ১ লাখ কোটি টাকার বেশি অব্যবহৃত থেকে যেতে পারে। তাই আগামী বাজেটে বরাদ্দ যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে আগামী অর্থবছর দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এরই অংশ হিসেবে এবারই প্রথম করজাল সম্প্রসারণের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্ভাব্য আয়করদাতাদের চিহ্নিত করা হবে। বাজেটে আয়কর খাত থেকে বেশি রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করা হবে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে অন্তত ৫ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতে পারে। চলতি বাজেটে সংস্থাটির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে সংস্থাটি প্রায় ৫৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫: প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণ
ধর্মীয় শাস্ত্রমতে, মানুষের গোপনীয়তার বোধ এবং পৃথিবীতে আগমন দুটি সমসাময়িক ঘটনা। সেদিক থেকে গোপনীয়তার চাওয়া মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদ দ্বারা শর্ত সাপেক্ষে জনগণের বাসস্থান, চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের অধিকার স্বীকৃত।
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার অন্য নাম তথ্যের গোপনীয়তার সুরক্ষার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ শিরোনামে দুটি অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে এবং কাজটিকে সফলতা হিসেবে উদ্যাপনও করা হয়েছে বলে আমরা সংবাদে দেখেছি।
ইন্টারনেটভিত্তিক বর্তমানের ডিজিটাল বিশ্বব্যবস্থায় ব্যক্তিগত তথ্যের গুরুত্ব বোঝাতে একে ‘ইন্টারনেটের জ্বালানি’, ‘ইন্টারনেটের মুদ্রা’, ‘নতুন স্বর্ণ’ ইত্যাদি বিভিন্ন উপমা ব্যবহার করা হয়। এর সুরক্ষার জন্য যেখানে বিশ্বের ১৬৫টির অধিক দেশে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন ছিল এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছিল না, সেখানে এমন একটি পদক্ষেপ নেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য. এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও কাজটি যেভাবে করা হলো, তা নিয়ে কিছু একাডেমিক আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েই গেছে ।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিবিষয়ক আইন করার ক্ষেত্রে বড় দাগে তিনটি মডেল দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজার–নির্ভর মার্কিন মডেল, অধিকার-নির্ভর ইউরোপিয়ান মডেল আর সরকারনিয়ন্ত্রিত চীনা মডেল। এই প্রতিটি মডেলেরই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা, সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার বিষয় আছে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর বিগত সরকার ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে ডিজিটালের নামে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ আর কেনাকাটায় তারা যতটা মনোযোগী ছিল, ‘ইন্টারনেটের জ্বালানি’ জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা বা নিরাপত্তার জন্য যথাযথ আইনি কাঠামো তৈরিতে তাদের ততটা আগ্রহী দেখা যায়নি। দেশের মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নানানভাবে ফাঁস হয়েছে, তা ঠেকানো যায়নি এবং দোষীদের কারও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছে বলেও জানাও যায়নি।
এটি বিগত আওয়ামী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যর্থতা ছিল বলা যায়। যদিও তারা এমন একটি আইনি কাঠামো তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ২০১৮ সালেই এবং ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এ–বিষয়ক আইনের সর্বশেষ খসড়া উপস্থাপন করে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মুখে তারা ক্ষমতা থেকে অপসারিত না হলে হয়তো সেই খসড়া এত দিনে আমরা আইন হিসেবে পেতাম।
আমাদের মতো দেশে সরকারের কথা বা কাজকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার মতো আস্থা আমাদের গড়ে ওঠেনি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ বা যাচাই করার সক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আছে কি না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করা ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-কে বলা যায় উক্ত কাজের ধারাবাহিকতা এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫। সুনির্দিষ্ট গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ না করে কোনো গবেষণা এবং গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ছাড়াই, নিজেদের মতো করে আইনের খসড়া তৈরি করে পছন্দের কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নামমাত্র আলোচনা করে সংসদকে পাশ কাটিয়ে আইন প্রণয়ন করার যে সংস্কৃতি বিগত সরকার চালু করেছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেই পথেই হেঁটেছে।
পাশাপাশি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বোধ্য ভাষা ও শব্দ এবং বিভিন্ন কারিগরি শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, যেগুলোর অনেকগুলোর ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়নি বা যেগুলো যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো মূল আইনে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে যাঁদের জন্য আইন করা হলো আর যাঁরা আইন বাস্তবায়ন করবেন, তাঁরা উভয়েই বিভ্রান্ত হবেন, যন্ত্রণা ভোগ করবেন এবং এই অবস্থার সুযোগ নেবে প্রকৃত অপরাধীরা—এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
অথচ আগের সরকারের করা খসড়াতে যে সীমাবদ্ধতাগুলো ছিল বলে অংশীজনেরা মতামত দিয়েছিলেন, তার অনেকগুলোই কাটিয়ে ওঠার সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে ছিল, যা চাইলেই তারা লুফে নিয়ে দেশকে এ–বিষয়ক একটি কার্যকর আইনি কাঠামো উপহার দিতে পারত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে গুণীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করে, যথাযথ গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করে এবং এ–সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল, আমরা ভেবেছিলাম আমাদের মতো ছোট কিন্তু জনবহুল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল জগতের আইনকানুন করার সময়ও একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
আরও পড়ুনউপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি কোথায়?২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩আফসোসের বিষয়, এমন চমৎকার একটি সুযোগ হাতছাড়া করা হলো এবং প্রধান উপদেষ্টার অধীনে থাকা মন্ত্রণালয় থেকে ডিজিটাল জগৎ–সম্পর্কিত সাইবার সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে এমন তিনটি অধ্যাদেশ করা হলো যেগুলোর বিধান বাস্তবায়ন করতে সমস্যার কারণে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে যদি এগুলো বাতিলও করে দেয় বা এগুলোর দুর্বলতার সুযোগে যদি অপব্যবহার করে, তবু অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং এ নিয়ে জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ না মানার কথাগুলো সংবাদে এসেছে। আমরা বরং আজ ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষাবিষয়ক যে দুটি অধ্যাদেশ পাস করা হলো, সেগুলো নিয়ে এখানে কিছু প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরি।
প্রথমেই দেখা যাক, এ ধরনের আইন প্রণয়নের ঐতিহাসিক পটভূমি। যেদিন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে চলা শুরু করেছে, সেদিন থেকেই ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ম মেনে সংগ্রহ করার শুরু হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ফ্যাসিস্ট সরকার নাগরিকদের তথ্যে গড়া জাতীয় তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে বিরোধী দলের কর্মীদের নজরদারির মাধ্যমে খুঁজে খুঁজে আক্রমণের বস্তু বানায়।
এমন পটভূমিতে জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘১৯৮৪’ রচনা করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল, ‘বড় ভাই তোমাকে দেখছেন’, মানে তুমি সর্বক্ষণ নজরদারির মধ্যে আছ। বইতে এমন এক অবস্থার উপস্থাপন করা হয়, যেখানে মানুষের কোনো ধরনের গোপনীয়তা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে যখন ব্যক্তিগত কম্পিউটারের প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ খুব সহজ ও স্বয়ংক্রিয় হতে থাকে, তখন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। আবার আন্তর্জাতিক আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যখন বাড়তে থাকে, তখন ‘সামাজিক চুক্তির’ আলোকে গড়ে ওঠা সার্বভৌম রাষ্ট্রে জনগণের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বের বিষয়টিও গুরুত্ব পেতে থাকে।
আরও পড়ুনআশঙ্কা ও অনাস্থার উপাত্ত সুরক্ষা আইন২৫ অক্টোবর ২০২২এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শতাব্দীর আশির দশকে এমন আইনের যাত্রা শুরু হয়, যেখানে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়, যারা একই সঙ্গে সরকার, জনগণ এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থ সুরক্ষা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখবে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেট যখন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন ইউরোপের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও এ ধরনের আইন করা শুরু করে। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এ ছাড়া উদীয়মান বিভিন্ন প্রযুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং হতে পারে বলে এ ধরনের আইন সাধারণত পরিবেশ আইনের মতো নীতিনির্ভর হয়। প্রযুক্তির দর্শনের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া নীতিগুলো এ ধরনের আইনের প্রাণ, এগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির মতো, যেগুলো এ ধরনের আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূলসূত্র হিসেবে কাজ করে, ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এবং রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের কাজের ভিত্তি হয়। এ ছাড়া এই নীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের আইন তথ্যধারীকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অধিকার প্রদান করে। পাশাপাশি এ ধরনের আইনে ব্যক্তিগত তথ্য প্রক্রিয়াকারীদের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং সেগুলো ভঙ্গ করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। তবে সবকিছুর পরও বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হয়, যেন ইন্টারব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য কোনোভাবে ব্যাহত না হয়ে স্বাভাবিক থাকে।
আমাদের মতো দেশে সরকারের কথা বা কাজকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার মতো আস্থা আমাদের গড়ে ওঠেনি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ বা যাচাই করার সক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আছে কি না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বর্তমান সময়ে তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বস্তু হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোন বিশ্বাসে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য-উপাত্ত দেবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৫ মে ২০২৫ তারিখে ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের সর্বশেষ যে খসড়া প্রকাশ করে সর্বসাধারণকে ২৫ মে ২০২৫ তারিখের মধ্যে মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, সেই খসড়ার প্রথমেই ‘প্রায় সম্পূর্ণ সংস্করণ’ শব্দগুলো ইংরেজিতে লেখা ছিল। সেই খসড়া ছিল অনেকটা আগের সরকারের রেখে যাওয়া সর্বশেষ খসড়ার কাছাকাছি এবং এই সর্বশেষ সংস্করণেও অংশীজনেরা মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, উক্ত খসড়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি বিধান, যেমন ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার নীতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান কোনো কারণ বা যৌক্তিকতা ছাড়াই বাদ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে অধ্যাদেশটি পাস করা হয়েছে। এর ফলে এমন আইনের অঙ্গহানির পাশাপাশি যা হয়েছে, তাকে কোনোভাবেই স্বচ্ছ, সততা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন বলা যায় না।
উপদেষ্টা পরিষদের অধ্যাদেশটি পাস হওয়ার পর যে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে সেখানে দাবি করা হয়েছে যে অধ্যাদেশটি ইউরোপের এ–বিষয়ক আইনের (‘জিডিপিআর’) আলোকে করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষার জন্য ইউরোপে কমপক্ষে ২০টি মূল আইন রয়েছে এবং এর সঙ্গে রয়েছে আদালতে রায় ও অসংখ্য সহায়ক আইন বা নির্দেশিকা। তাই বাংলাদেশের সদ্য পাস হওয়া অধ্যাদেশে ইউরোপের আইনি কাঠামোর কতটুকু রাখা বা অনুসরণ করা হলো, তা নিয়ে মতামত দিতে বিস্তারিত গবেষণা করার দরকার পড়বে। যেহেতু অধ্যাদেশের বিভিন্ন বিধান অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতার সপক্ষে কোনো ধরনের গবেষণা প্রতিবেদন বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি, তাই শুধু খোলা চোখে বড় দাগে, এই অধ্যাদেশের সীমাবদ্ধতাগুলো দৃশ্যমান হয়।
পাস হওয়া দুটি অধ্যাদেশই অতিমাত্রায় বিধি বা প্রবিধি–নির্ভর এবং যেহেতু এদের বিধানগুলো—সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া—অবিলম্বে কার্যকর হবে, তাই এদের বিধান কতটুকু বাস্তবায়িত হবে বা করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ করাই যায়। যারা অধ্যাদেশগুলো প্রণয়ন করেছেন, তাঁদের জানার কথা যে, যে ইউরোপিয়ান জিডিপিআরের সূত্র তাঁরা ব্যবহার করেছেন, এটির যাত্রা শুরু হয়েছে ঠিক ১৯৯০ সালে, যা কাঠামোবদ্ধ হয় ১৯৯৫ সালে এবং যাকে উন্নত করা হয় ২০১৬ সালে এবং তারপরও সবাইকে প্রস্তুত হতে দুই বছর সময় দেওয়া হয় এবং ২০১৮ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সরকারের উচিত ছিল এ ব্যাপারে অন্তত একটি সমীক্ষা করা এবং যারা যারা ব্যাপক হারে ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়া করে, তাদের পরিমাণ, গুরুত্ব, ধরন বা ঝুঁকি, ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রথমে অল্প কিছু সেক্টরকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা এবং ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়ানো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একেবারে প্রথম থেকেই সবাইকে একসঙ্গে এই আইনে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
আইনের বিধান এক আইনে এবং এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরেক আইনে রাখার বিষয়টি একটি দৃষ্টিকটু উদ্ভাবন এবং এটি আইনের প্রয়োগকে জটিল করবে মনে করি। পাশাপাশি অধ্যাদেশের বিধান বাস্তবায়নের জন্য যে কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না, তা আমার আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে পারি।
যদিও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে (ধারা ২৭), আবার বলা হয়েছে, কোনো জটিলতার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার দিকনির্দেশনা দেবে (ধারা ২৫ ও ২৬)। আবার যে সাত সদস্য বিশিষ্ট কর্তৃপক্ষের কথা বলা হয়েছে, সেখানে মাত্র একজনকে ব্যক্তিগত তথ্য দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যদিও কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কমিটি গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কমিশনের তহবিল আসবে বিভিন্ন অনুদান থেকে; অর্থাৎ তহবিল না থাকলে লোক নিয়োগ হবে না। যে কর্তৃপক্ষ বা বাছাই কমিটির সদস্যদের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের যোগ্যতায় কোথাও আইন বা মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি; বরং বলা হয়েছে যে সবাই কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন হবেন।
এ থেকেও এই উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে সরকার তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাকে এক করে দেখছেন, যদিও দুটি ভিন্ন বিষয়—একটি কারিগরি, অন্যটি আইনগত। এই অধ্যাদেশগুলো সরকার এবং সরকার নিয়োগকৃত কর্তৃপক্ষকে দায়দায়িত্বের নামে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং এক অধ্যাদেশে কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দিয়ে অন্য অধ্যাদেশে দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে (ধারা ৬৪)। ব্যাপারটিও খুব দৃষ্টিকটু।
জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ শিরোনামে যে অধ্যাদেশটি করা হয়েছে, সেটি অন্যান্য দেশে তথ্য আদান–প্রদান বা বিনিময় (ডেটা শেয়ারিং) আইন নামে প্রচলিত। সে ধরনের আইনে শুধু সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসমূহের তথ্য আদান–প্রদানসম্পর্কিত বিধান থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই একই অধ্যাদেশের বিধান দিয়ে সব অধিবাসীর ব্যক্তিগত তথ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আমাদের মতো দেশে সরকারের কথা বা কাজকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার মতো আস্থা আমাদের গড়ে ওঠেনি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ বা যাচাই করার সক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আছে কি না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বর্তমান সময়ে তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বস্তু হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোন বিশ্বাসে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য-উপাত্ত দেবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর প্রস্তাবনায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে সেখানে স্পষ্টভাবে জাতীয় নাগরিক ডেটা কমিশন বলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যার দায়িত্ব হবে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও বিতরণ। এর সঙ্গে সারা বিশ্বে কাজ করা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের কাজের কোনো মিল বা সম্পর্ক নেই। এসব দিক দেখে নীতিনির্ধারকদের অস্থিরতা বা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
আগে করা খসড়াগুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও মাঝেমধ্যে কিছু দরকারি বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেগুলো আবার কোনো কারণ না বলে পরের খসড়াতে বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন গোপনীয়তার প্রভাব মূল্যায়ন (প্রাইভেসি ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) বা সর্ববস্থায় গোপনীয়তার ধারণা (প্রাইভেসি বাই ডিজাইন ও প্রাইভেসি বাই ডিফল্ট) সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। পাস হওয়া অধ্যাদেশে প্ল্যাটফর্মের দায় নিয়ে বলা হয়েছে, কিন্তু এর কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। অনলাইন বা ইলেকট্রনিক মার্কেটিং সম্পর্কে কোনো বিধান নেই। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে যে পরিমাণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে পরিমাণ বিধান রাখা হয়েছে বা যতবার ব্যবহার করা হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও এই দুই অধ্যাদেশে দেখা যায়নি। অথচ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের কিছু ক্ষেত্রে ভারতের আইনের প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু ভারতের আইনেও ভিন্ন কর্তৃপক্ষের বিধান আছে এবং তাদের আইনের বিভিন্ন ধারাতে মানুষের বোঝার সুবিধার্থে ব্যাখ্যা ও উদাহরণ যোগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বেলায় তেমন কিছু করা হয়নি। এ ছাড়া অধ্যাদেশে বেশ কিছু স্ববিরোধী বিধান রয়েছে [ধারা ১৫(৪)]।
আমি মনে করি, এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তবে অধ্যাদেশগুলো চূড়ান্ত করার আগে এর বিভিন্ন বিধান নিয়ে অবশ্যই আরও গভীরভাবে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। অধ্যাদেশগুলো এভাবে পাস হলে নতুন নতুন মামলার জোয়ার দেখা যাবে, এগুলোর বিধানের স্বেচ্ছাচারী বা ঐচ্ছিক প্রয়োগ হবে এবং এগুলোর যথাযথ প্রয়োগে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ছিটকে যাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে।
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা-গোপনীয়তা, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আইন-নীতি ইত্যাদি পড়ানোর পাশাপাশি এসব বিষয়ে তিনি গবেষণা করেন।
*মতামত লেখকের নিজস্ব