পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) ৮২ কর্মীকে চার মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেককে দেড় লাখ রুপি জরিমানা করা হয়েছে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির একটি সন্ত্রাসবিরোধী আদালত গত শুক্রবার এ আদেশ দেন। গত বছরের ২৬ নভেম্বর সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় করা মামলায় দোষ স্বীকার করায় এ আদেশ দেওয়া হয়েছে।

দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মুক্তি দিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে গত বছরের ২৬ নভেম্বর ব্যাপক বিক্ষোভ করে পিটিআই। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ৭১ বছর বয়সী ইমরান খান ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। যার মধ্যে দুর্নীতি থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগও আছে। এর আগে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে সাবেক ক্ষমতাসীন দলটির তিন দিনব্যাপী বিক্ষোভ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে অন্তত তিনজন রেঞ্জার্স সদস্য এবং একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন।

ওই ঘটনায় ৮২ জন অভিযুক্ত বিচারকের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁরা একটি হলফনামাও দাখিল করেন, যেখানে তাঁরা বলেন, পিটিআইয়ের নেতারা বিক্ষোভে অংশ নিতে তাঁদের উসকানি দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে আর কোনো বিক্ষোভে অংশ নেবেন না, এই মর্মে আদালতকে লিখিত দেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা।

উল্লেখ্য, শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ১ হাজার ৬০৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৫৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এদিকে গত বছরের ৯ মের ঘটনায় করা মামলায় সিনেটর ইজাজ চৌধুরী এবং ফারহাত আব্বাসের জামিন মঞ্জুর করেছেন সুপ্রিম কোট। তাঁদের এক লাখ রুপির জামিন বন্ড জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি আখতার আফগানকে প্রধান করে করা তিন সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ডাকঘর: নাটকের আবেদন ছাড়িয়ে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহৎ স্রষ্টার কাছে আমরা এযাবৎ যা আশা করে এসেছি, সেই আশা এখন ভ্রান্তির চোরাবালিতে মাথা কুটে মরছে। একজন শিল্প সৃজনকারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কি বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল? সেটিই হয়তো ছিল আমাদের ভুল। তিনি বিনোদনের উৎস নন, আমাদের ব্যবহার্যতার ভিত্তি। করোনাকালে পুরোনো রবীন্দ্রবাণী উপলব্ধি করেও নতুনভাবে সংবিৎ ফিরে পেয়েছি:

কত অজানারে জানাইলে তুমি

      কত ঘরে দিলে ঠাঁই—

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,

       পরকে করিলে ভাই।

অতিমারিকালে তো আমরা তা-ই করেছি। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে গৃহবন্দী থেকেও অনেক অজানাকে জানার সুযোগ হয়েছিল। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যোগাযোগ করে দূরকে কত নিকটে নিয়ে এসেছি, এর মাধ্যমেই অনেক পর আমাদের আপন হয়েছে, যা হয়তো কোনোদিন সম্ভবই হতো না। যেটি আসলে ‘শারীরিক দূরত্ব’ সেটিকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এটিও ছিল এক পুঁজিবাদী প্রচারণা। পুঁজিবাদ তো মানসিকভাবে ভাঙনই ধরাতে চায়, মানুষ যূথবদ্ধ থাকলেই তার সমস্যা; কিন্তু রবীন্দ্রনাথে কখনো তা ছিল না, গীতাঞ্জলির তৃতীয় পঙ্‌ক্তিমালাতেই পাই:

তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর

নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর;

সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ,

               দেখা যেন সদা পাই।

করোনার আরশিতে রবীন্দ্রনাথকে খুব নিবিড়ভাবেই পাওয়া যায়। ‘ডাকঘর’ নাটকে বালক অমল বলছে, ‘আমি যদি কাঠবিড়ালি হতুম, তবে বেশ হতো। কিন্তু পিসেমশায়, আমাকে কেন বেরোতে দেবে না?’ তখন পিসে মাধব দত্ত জবাব দিচ্ছেন, ‘কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে।’ আমাদের অবস্থা তো বালক অমলের মতোই হয়ে গিয়েছিল। আবার দেখতে পাই, জনমানবহীন লোকালয়ে বন্ধনহীন প্রাণিকুল চলে এসেছিল কাঠবিড়ালির মতোই তরতর করে। নব্য এক সাফারি উদ্যানে আমরা বন্দী ছিলাম নিরুপায় হয়েই। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ চিত্র চিরকালীন হলেও রবীন্দ্রবীণায় তা আগাম বেজে উঠেছিল। 

এ ‘ডাকঘর’ ধরেই আমাদের আলোচনা ক্রম অগ্রসরমান হবে, যদিও আজ রবীন্দ্রনাথকে যে পরিচয়ে নিয়ে আসতে চাই, সেই প্রসঙ্গে আরও খানিকটা গাইতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী স্রষ্টাদের আমরা কি কেবল সৃষ্টির উপভোক্তা, কেবলই কি তার সৃষ্টিসম্ভার ব্যবহার করে দিনের পর দিন বিনোদিত হতে থাকব? অতঃপর বিনোদন অবসানে অথবা মনোরঞ্জনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো উত্তীর্ণ হয়ে গেলে সব ভুলে যাব? নাকি বিনোদনের অধিক আরও কিছু প্রত্যাশা আছে তার সৃষ্টির কাছে? গবেষকেরা যে বলে থাকেন, নন-প্রাগম্যাটিক বা অব্যবহারিক, বিষয়টি কি এমনই? নাকি আমাদের জীবনে এ সবের কোনো ব্যবহার উপযোগিতা আছে, যা জীবনকে বাঁচায় কিংবা নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয় মরণের ওপারে?

শিল্পের উপযোগিতা নিয়ে দুই কথা এখন বলাই যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু দেশপ্রেমমূলক রবীন্দ্রসংগীত ও উদ্দীপক নজরুলগীতি জাতিকে অভূতপূর্বভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুনেছি যে, দেশ বা বাড়িঘর ছেড়ে গোটা পরিবার আত্মরক্ষার্থে, আশ্রয়ের খোঁজে গমনপথে শ্রান্ত–ক্লান্ত হয়ে গতিবেগ হয়েছিল অচলিষ্ণু, পথের যে শেষ নেই—তখন দলের কেউ কেউ নজরুলের ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ গানটি অনুচ্চকণ্ঠে গেয়ে দলের মনোবলকে অটুটু রেখেছিলেন। এ হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের বাস্তব উপযোগিতা। এমনই কোনো কোনো কালজয়ী সাহিত্যের বাস্তব উপযোগিতার নজির রয়েছে। রয়েছে রবীন্দ্রনাথেও, আরও প্রবলভাবে।

কবির দীক্ষা হলো, জীবনের দীক্ষা, আর একটু সংকোচের সঙ্গে যোগ করি, মরণেরও দীক্ষা। কীভাবে আমি বাঁচব, আর, যতই পিছিয়ে দিতে চাই প্রশ্নটাকে, কীভাবে মরব, এ দুয়েরই দীক্ষা পাই রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে।পবিত্র সরকার

প্রসঙ্গত স্মর্তব্য অধ্যাপক পবিত্র সরকারের একটি আলোচনাংশ, ‘কবির দীক্ষা হলো, জীবনের দীক্ষা, আর একটু সংকোচের সঙ্গে যোগ করি, মরণেরও দীক্ষা। কীভাবে আমি বাঁচব, আর, যতই পিছিয়ে দিতে চাই প্রশ্নটাকে, কীভাবে মরব, এ দুয়েরই দীক্ষা পাই রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এ প্রশ্ন কেবল মানুষই করতে পারে, কারণ, মানুষেরই একমাত্র আছে ভাষা, আছে শিল্প, আছে নিজেকে নানা কর্মে ও সম্বন্ধে প্রকাশ করার নানাবিধ উপায়। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর এ সব প্রশ্ন নেই। আর পৃথিবীর আর কোনো স্রষ্টা এমন সর্বাঙ্গীণ উত্তর প্রস্তুত করে রাখেননি আমাদের জন্য, যেমন রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

যখন প্রশ্ন করি কীভাবে আমি বাঁচব, রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ বলেন, বাঁচো সকলের সঙ্গে, একা বাঁচার কোনো অর্থ নেই—“স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে।” “শিক্ষার মিলন” প্রবন্ধে একইভাবে তিনি বলেন, “একা মানুষ ভয়ংকর নিরর্থক। কেননা, তার একার মধ্যে ঐক্য নেই। বহুকে নিয়ে যে এক সেই হলো সত্য এক”।’

[বাংলাদেশ ও ভারতের যুগ্ম উদ্যোগে উদ্‌যাপিত রবীন্দ্রনাথের সার্ধ জন্মশতবর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা]

মৃত্যু এমন এক সত্য, যে সত্যে কোনো আপেক্ষিকতা নেই; কিন্তু এই সত্যকে আমরা সহজে মেনে নিই না। সব সত্যে আস্থাশীল হলেও মৃত্যু-সত্যে অনাস্থা দেখায় না, এরূপ মনুষ্য বিরল। সংসারের প্রপঞ্চে, মায়ায় জড়িয়ে প্রিয়জনের মৃত্যুতে কেবল ভাষা পায় চোখের জল। মৃত্যুকে কেউ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শেখে না বলে। মনীষী ব্রুনো বেথেলহাম কয়েছিলেন, ‘সব শেষে প্রত্যেককে মৃত্যুর দূতকে প্রশান্তভাবে গ্রহণ করাটা শিখতে হবে।’ ‘ডাকঘর’ শীষর্ক রবীন্দ্রনাট্যের নাটকজুড়েই সেই প্রস্তুতি চলে (দ্রষ্টব্য—মাধবদত্তের সংলাপ: ছিঃ বাবা কেবলই এমন যাই যাই করতে নেই)।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে হিটলারের নাৎসি অধিকৃত পোল্যান্ডের ওয়ারশর দোম সিয়োরেতে দুশো ইহুদি ছেলেমেয়ের একটি অনাথ আশ্রম চালিয়েছিলেন ডা. হেনরিক গোল্ডস্মিথ। নাৎসিরা এসেই প্রথম অনাথ আশ্রমটিকে তুলে নিয়ে গেল এক ইহুদি গ্রেটোতে। গোল্ডস্মিথ এটির অর্থ ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার, প্রতিরোধ যে ছিল না। কে কথা কইবে ঘৃণিত একনায়কের বিরুদ্ধে? সে সময় তিনি একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দ্য পোস্ট অফিস’ নাটকটি বেছে নিলেন এই ছেলেমেয়েদের অভিনয়ের জন্য।

এই যে বলা হলো মৃত্যুর প্রস্তুতি, তার একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে হিটলারের নাৎসি অধিকৃত পোল্যান্ডের ওয়ারশর দোম সিয়োরেতে দুশো ইহুদি ছেলেমেয়ের একটি অনাথ আশ্রম চালিয়েছিলেন ডা. হেনরিক গোল্ডস্মিথ, তাঁকে ‘ইয়ানুস কোর্কজাক’ বলেও লোকে জানত। তাঁর ভাবমূর্তি ছিল অনেকটা বাংলাদেশের মধুপুরের বিদেশি ডাক্তার ভাইয়ের মতো, যিনি আজীবন মানবসেবা করে ক–বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। ওয়ারশর তিনিও সে রকম এক ডাক্তার বাবু ছিলেন। নাৎসিরা এসেই প্রথম অনাথ আশ্রমটিকে তুলে নিয়ে গেল এক ইহুদি গ্রেটোতে। এটি (গ্রেটো) ছিল রাজধানী শহরের এক ইহুদি আবাসিক ডিস্ট্রিক্ট। ওখানে গিয়ে তাঁরা যে খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। কারণ, মাত্র এক বর্গমিটার স্পেসে নয়জনের অধিক লোককে রাখা হতো, যাঁদের মরণের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। তাঁদের জানানো হয়েছিল, আগস্টের শুরুতে সবাইকে ত্রেবলিংকার মারণ-শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে। ডা. কোর্কজাক এটির অর্থ ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার, প্রতিরোধ যে ছিল না। কে কথা কইবে ঘৃণিত একনায়কের বিরুদ্ধে? 

সে সময় তিনি একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দ্য পোস্ট অফিস’ নাটকটি বেছে নিলেন এই ছেলেমেয়েদের অভিনয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথ এই নাটক লিখেছিলেন বহু আগে, ১৯১১ সালে যখন তার বয়স ৫০, অর্থাৎ ঠাকুর তখন এক পরিপক্ব মানব। আবার এই নাটক নাকি গোয়েবলসের ফতোয়ায় নিষিদ্ধও হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। কিন্তু ওই দেশের বিচক্ষণ বুড়ো ডাক্তার যে এটি মঞ্চস্থ করেছিলেন সেটি আমাদের জানা সম্ভব হতো না, যদি না শ্লোমি দোরোন নামের সেই স্কলার মেয়েটি এক গবেষণা পরিচালনা করত। তিনি গবেষণাটি করেছিলেন ইসরাইলের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্লোমি জানিয়েছেন, ১৯৪২ সালের ৮ জুলাই আশ্রমের রান্নাঘরের হলে আমন্ত্রিত দর্শকদের সামনে নাটকটি অভিনীত হয়েছিল। শ্লোমি বিষয়টি আমাদের অনুধাবনে সহায়তা করেছেন এই মন্তব্য করে, ডাক্তার বাবু নাটকটিকে ব্যবহার করেছেন ‘সারভাইভাল টুল’ হিসেবে, মৃত্যু যে তত ভয়ংকর কিছু ছিল না, তা বোঝানোর জন্য। তাঁর সাথে আমাদের একমত না হয়ে উপায় থাকে না যে নাটকে মহড়ার হইহুল্লোড়, হট্টগোল, হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েরা হয়তো মৃত্যুর চেহারা তাদের চৈতন্যে গ্রহণ করবে, এটাই কোর্কজাক আশা করেছিলেন, যেমনটি আশা করেছিলেন ‘ডাকঘর’ নাটকের ঠাকুরদা। উভয়েই কি তখন আশা করেছিলেন বালক-বালিকাদের ট্রমাবিহীন অবশিষ্ট জীবন?

ওই দেশের বিচক্ষণ বুড়ো ডাক্তার যে ডাকঘর নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন সেটি আমাদের জানা সম্ভব হতো না, যদি না শ্লোমি দোরোন নামের সেই স্কলার মেয়েটি এক গবেষণা পরিচালনা করতেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৪২ সালের ৮ জুলাই আশ্রমের রান্নাঘরের হলে আমন্ত্রিত দর্শকদের সামনে নাটকটি অভিনীত হয়েছিল। শ্লোমি বিষয়টি আমাদের অনুধাবনে সহায়তা করেছেন এই মন্তব্য করে, ডাক্তার বাবু নাটকটিকে ব্যবহার করেছেন ‘সারভাইভাল টুল’ হিসেবে, মৃত্যু যে তত ভয়ংকর কিছু ছিল না, তা বোঝানোর জন্য।

ত্রেবলিংকা নাৎসি শিবিরে ছেলেমেয়েদের নেওয়া হয়েছিল একটি মাত্র উদ্দেশে, গ্যাস চেম্বারে হত্যা করার জন্য। এই শিবির অভিমুখে ছেলেমেয়েদের মৃত্যু-মিছিলের দুটো বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল।

এটি বর্ণনা দিয়েছিলেন ইয়োশুয়ো পার্লে—‘সেদিন উমশ্লাকপ্লাটসের মোড়ে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। দুই শ শিশুর একটিও কেঁদে উঠল না। মৃত্যুর জন্য চিহ্নিত দুশো নিষ্পাপ শিশুর কেউ চোখের জল ফেলল না।’ পোলান্ডের এই উমশ্লাকপ্লাটসে পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ওয়ার মেমোরিয়াল স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায়। 

আর একটি বর্ণনা আছে ভ্লাদিস্লাভ স্পিলমানের দ্য পিয়ানিস্ট উপন্যাসে। এটি জগৎ–কাঁপানো এক স্মৃতিচারণামূলক উপন্যাস। বেঁচে থাকার সংগ্রামমুখর আত্মজৈবনিক এ উপন্যাসটি ১৯৩৯-৪৫ সালে রচিত হয়েছিল, যা প্রকাশ পায় ১৯৪৬ সালে। ভ্লাদিস্লাভ স্পিলমান ছিলেন এক পোলিশ-ইহুদি পিয়ানিস্ট ও কম্পোজার। তাঁর বর্ণনা তো ছিল একেবারেই অতলস্পর্শী, ‘আমি যখন গেশিয়া স্ট্রিটে তাঁদের দেখি, বাচ্চারা হাসছে, সকলে গলা মিলিয়ে গান গাইছে, আর বেহালাবাদক ছেলেটি তাঁদের গানের সঙ্গে প্রাণপণে বাজনা বাজিয়ে চলেছে। কোর্কজাক দুটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চলেছেন, তারাও হাসছে। আমি নিশ্চিত যে, যখন গ্যাস চেম্বারে জাইক্লন বি গ্যাস বাচ্চাদের দম বন্ধ করে ফেলছে, আশা নয়, মৃত্যুর আতঙ্ক তাদের বুকে, তখনো ওই ডাক্তারটি তাদের বলে চলেছেন, “ভয় নেই বাচ্চারা, সব ঠিক হয়ে যাবে”।’ আমরা দেখি, উপন্যাসের এই কোর্কজাকই হচ্ছেন সেই ডাক্তার, যিনি ভারতীয় কবি-নাট্যকারের ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ করে অবোধ শিশুদের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন।

যখন গ্যাস চেম্বারে জাইক্লন বি গ্যাস বাচ্চাদের দম বন্ধ করে ফেলছে, আশা নয়, মৃত্যুর আতঙ্ক তাদের বুকে, তখনো ওই ডাক্তারটি তাদের বলে চলেছেন, “ভয় নেই বাচ্চারা, সব ঠিক হয়ে যাবে”।’ আমরা দেখি, উপন্যাসের এই কোর্কজাকই হচ্ছেন সেই ডাক্তার, যিনি ভারতীয় কবি-নাট্যকারের ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ করে অবোধ শিশুদের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন।

আমরা সাধারণ মানুষ জীবনকে স্বাগত জানিয়ে বলতে পারি, হে মহাজীবন, কখনো কি বলতে পারি হে মহামরণ? তাই ডাক্তার কোর্কজাকের এই মানবিক উদ্যোগে অধিকাংশই কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাব না। দুঃখ–ক্লেশ ও মরণভীত অতি সাধারণ প্রাণী আমরা, এত সহজে বলতে পারি না—মরতে মরতে মরণটাকেই শেষ করে দেব। একমাত্র রবীন্দ্রনাথই তাঁর মতো করে আমাদের দর্শন করতে বলেন জীবনকে, জগৎকে। তাঁর শিল্পের সাধনাতেই আছে অনুসন্ধান যেখানে মানুষের জীবন আর মরণ দুটি পর্যায় মাত্র। তাই মরণকে স্বাগত জানিয়ে হে মহামরণও বলতে পারি (স্মরণযোগ্য রবীন্দ্রবাণী: মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান)। 

পরে দ্য পিয়ানিস্ট উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে যেটির নির্মাতা রোমান পোলানস্কি। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। গণহত্যার ওপর এতটা মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র আর হয় না! বড় ঔৎসুক্য নিয়ে অবলোকন করেছি এ সেলুলয়েড নির্মিতি, উদ্দেশ্য ছিল সেই বুড়ো খ্যাপা ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না। দেখলাম পোলানস্কি এই অংশ যথার্থই চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন (হয়তো না জেনেই, ঔপন্যাসিক স্পিলম্যান নিজেও হয়তো জানতেন না কোর্কজাকের মানবিক উদ্যোগ–সংক্রান্ত পশ্চাতের এ ঘটনা), যে দৃশ্যটিতে আছে রবীন্দ্রনাথের শিকড়ের স্মৃতি।

গত তিন বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে দেশের ৬৪ জেলায় নির্মিত হয়েছিল ৬৪টি গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার। সে সবের একটির নির্মাণযজ্ঞে, নরসিংদী জেলার ‘জলে ডাঙ্গার একাত্তর’ নাটকের নির্মাণ পর্যায়ে কুশীলবদের বলা হয়েছিল তারা যেন আবশ্যিকভাবে পোলানস্কির ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ চলচ্চিত্রটি দেখে নেয়। অস্থির এ সময়ে, ভবিষ্যতেও গণহত্যার কোনো শিল্প নির্মাণে যেন কেউ নির্দেশনা দেন, এ কারণে যে এতে কেবল স্পিলমান এবং পোলানস্কিকে পাওয়া যাবে না, এর অতল গভীরে আমরা খুঁজে পাব বাংলার জীবন-নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও, যিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি বা ভারতীয়দেরই নন, সমগ্র মানবজাতির।

সম্পর্কিত নিবন্ধ