সকাল ১০টা বাজতেই শুরু হয়ে যায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ২০ মিনিট পর কেন্দ্রে প্রবেশ করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় পরীক্ষার্থীদের কেউ গাইড বই খুলে, কেউ মুঠোফোনে চ্যাটিজিপিটি ব্যবহার করে খাতায় উত্তর লিখছিল। পরে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে আট পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।

আজ মঙ্গলবার ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের একটি এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষাকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। গফরগাঁও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমির সালমান উপজেলার মহিলা কলেজকেন্দ্র অভিযানে গিয়ে এ পদক্ষেপ নেন।

আমির সালমান প্রথম আলোকে বলেন, গফরগাঁও মহিলা কলেজকেন্দ্রে এসএসসি ভোকেশনালের ট্রেড দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের পরীক্ষা চলছিল। সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি কেন্দ্রে ঢুকে দেখেন, গাইড বই নিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখছে শিক্ষার্থীরা। ওই অবস্থায় অসদুপায় অবলম্বন করার দায়ে তিনটি কক্ষ থেকে আট পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। তারা সবাই ছেলে শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে ছয়জনের হাতে গাইড বই ও দুজনের কাছে মুঠোফোন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, শিক্ষকেরা থাকার পরেও কীভাবে পরীক্ষার্থীরা গাইড বই বা মুঠোফোন নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকতে পারে। এ ঘটনায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলেও তাঁদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এন এম আবদুল্লাহ আল মামুন জেএম কামিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে মুঠোফোন রাখার দায়ে দুজন কক্ষ পরিদর্শককে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। এ ছাড়া ইসলামিয়া সরকারি স্কুলকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা মুজিবুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মুঠোফোন রাখা ও বোর্ডের নীতিমালা ভঙ্গ করে নিজের মেয়ে পরীক্ষার্থী হওয়ার পরেও পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করায় পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

ইউএনও এনএম আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন না করার জন্য অভিভাবকদের সহযোগিতা চাই। নকলের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ক ষ র থ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

এসএসসি পরীক্ষার সনদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া মোটেই কাম্য নয়

গত ১০ জুলাই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, ১১টি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল ১৯,০৪,০৮৬ জন, মোট পাস করেছে ১৩,০৩,৪২৬ জন, মোট ফেল করেছে ৬,০০,৬৬০ জন। দেখা যায় গড়ে ৬৮.৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, বাকি ৩১.৫৪ শতাংশ অকৃতকার্য হয়েছে। প্রায় এক–তৃতীয়াংশ পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ। ছেলেদের ফেলের হার মেয়েদের তুলনায় আরও বেশি। ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এত বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে এত বছর লেখাপড়া করার পর (কমপক্ষে ১১ বছর) তাদের জীবনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য করল। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার পর কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, এবার মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে, কেউ কেউ আবার বলছেন এবার উত্তরপত্র লিবারেলি মূল্যায়ন করার চাপ না থাকায় এ সংখ্যা বেড়েছে। এতে তাঁদের মধ্যে পুলকিত ভাবও লক্ষ করা যায়। এটাই বেশি দুঃখজনক। কারণ, তারা ভাবছেন না যে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে একটানা ১১-১২ বছর লেখাপড়া করে জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ফেল করল এবং এত বছর লেখাপড়া করার পরও তারা কোনো সনদ পেল না। এ অতি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার আগে তাদের আর সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতিপত্র বা সনদপত্র দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বা নেই। শুধু তাই নয়, এর ফলে তাদের জন্য আরও ওপরে লেখাপড়া করার পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। অনেকে বিয়ে করতে বা বিয়ে দিতে সমস্যায় পড়বে, চাকরির দরখাস্ত করা থেকে বঞ্চিত হবে। এর প্রভাব শুধু তাদের ওপর নয় বরং আরও অনেকের ওপর পড়ে। কারণ, এর সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। এসব অভিভাবককে তাঁদের এত বছরের শিক্ষার ব্যয় জোগান দিতে হয়েছে, সবারই বিপুল সময়ের অপচয় হয়েছে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকার দেখা শুরু করেছেন। এটা অনস্বীকার্য যে এসএসসি পরীক্ষা শুধু নবম-দশম শ্রেণির লেখাপড়ার জন্য সনদপত্র নয়। এ পরীক্ষায় ফেল করার ফল হলো তাদের জীবনের বড় সময়ের তথা কমপক্ষে ১১-১২ বছরের লেখাপড়ার স্বীকৃতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া। এর আগে তাদের নার্সারি বা শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতিটি শ্রেণিতে পড়াশোনা করে পাস করে আসতে হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য পরীক্ষার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ, এসএসসি পরীক্ষায় পাস হলো পুরো ১১-১২ বছরের লেখাপড়ার স্বীকৃতি, আর অন্যান্য পরীক্ষা শুধু ওই শ্রেণির সময়কালে লেখাপড়া করার স্বীকৃতি। যেমন—এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল হলো উক্ত শ্রেণির দুই বছর অধ্যয়ন করার ফল।

আরও পড়ুনহার্ভার্ডসহ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমানের, বাবা–মা’র তিন সূত্রেই বাজিমাত০৬ আগস্ট ২০২৫

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এত বড় বিপর্যয়ের কারণ বোঝার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আমার মতে এর মূল কারণ হলো আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি, আমাদের ধ্যানধারণা, শিক্ষকদের চিন্তাভাবনা, রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এক শ্রেণির শিক্ষক মনে করেন পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন করা প্রয়োজন। তাহলে মেধাবীদের সহজে বাছাই করা যাবে, মেধার সত্যিকার মূল্যায়ন হবে। তাঁরা হয়তো ভুলে যান, এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করা শুধু মেধা পরীক্ষা করার জন্য নয় বরং জ্ঞান অর্জন করার জন্য এবং একই সঙ্গে এত বছর ধরে লেখাপড়ার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য।

যেকোনো ক্লাসের পরীক্ষায় পাস ফেল বা ভালো রেজাল্ট করা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যেমন—সিলেবাস, প্রশ্নের ধরন, মান, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীদের মানসিকতা, পাঠ্যবইয়ের মান, যাঁরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন, তাঁদের মানসিকতা প্রভৃতি। অনেক শিক্ষকের উদ্দেশ্যই থাকে পরীক্ষার্থীদের কম নম্বর দেওয়া, বেশি হারে ফেল করানো এবং এতে তাঁরা গর্ববোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণত এমনটি দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকেরা সাধারণত কম নম্বর দেন না বরং তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে ক্লাসে নিয়মিত সবাইকে পাস করানো। কিন্তু এসএসসি পর্যায়ে তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এমনকি তাঁরা ইচ্ছা করেই প্রশ্ন কঠিন করে থাকেন। অনেক সময় সিলেবাসের বাইরে থেকেও প্রশ্ন করেন। তাঁদের এ ধরনের মনমানসিকতার বলি হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। অথচ এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে কমপক্ষে ১১ বছর থেকে ১৫ পছর পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে এসেছে। আর এ লেখাপড়ার মাধ্যমে তাদের জীবন থেকে এতগুলো বছর পার করে এসেছে। সেই অবস্থায় তাদের প্রতি এমন বজ্রাঘাত চিন্তা করা যায় না। অথচ যেকোনো পরীক্ষায় কঠিন প্রশ্ন করে অনেক মেধাবী এমনকি শিক্ষককেও ফেল করানো সম্ভব। কারণ, প্রশ্নকর্তা চাইলে যে কাউকে পরীক্ষায় ফেল করানোর মতো প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। আমরা নিজেরা যতই মেধাবী হই না কেন, এ কথা বাস্তব সত্য যে সবার সমান মেধা, সমান যোগ্যতা, সমান সুযোগ-সুবিধা, সমান প্রাচুর্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করার ভাগ্য হয় না। তাই বলে কম মেধাবীদের ফেলে দেওয়া যাবে না। আর এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র শুধু মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা নয়, তা এত বছর ধরে লেখাপড়া করার স্বীকৃতি দেওয়াও বটে।

প্রায়ই বলা হয় গণিতে অথবা ইংরেজিতে কম নম্বর পাওয়ার ফলে তারা ফেল করে। আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ সেগুলোতে ফেল করে না বরং তারা ফেল করতে বাধ্য হয়। কারণ, বিষয়গুলো পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে যদি যথাসম্ভব সহজভাবে উপস্থাপন করে তৈরি করে তাদের সরবরাহ করা হয় এবং ক্লাসে শিক্ষক যদি সঠিকভাবে পড়িয়ে থাকেন, তাহলে তাদের তো ফেল করার কথা নয়। বিশেষ করে গণিত বইয়ে প্রতিটি বিষয় যদি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয় এবং প্রতিটি বিষয় বাস্তবধর্মী একাধিক সহজ উদাহরণের মাধ্যমে তৈরি করে উপস্থাপন করা হয়, আর পরীক্ষায় যদি সেগুলোর আলোকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়, তাহলে এত বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফেল করার কোনো কারণ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পান বা না পান বাস্তব জীবনে তো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সবাই গণিতের হিসাব বিশেষ করে পাটিগণিতের নিয়ম অনুযায়ী জীবন যাপন করেন। সেখানে গণিত নিয়ে এত ভীতি সৃষ্টি করার তো কোনো প্রয়োজন নেই। একইভাবে ইংরেজি বইও যথাসম্ভব সহজভাবে ও বিস্তারিত উদাহরণের মাধ্যমে তৈরি করে সেগুলো শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হলে তারা প্রাইভেট টিউটর ছাড়াই আত্মস্থ করতে পারে। কিন্তু আমাদের জাতীয় টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ সে বিষয়ে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে পাঠ্যবইয়ে সহজ বিষয়কে জটিলভাবে উপস্থাপন করেন। গত কয়েক বছরে আমরা লক্ষ করেছি, সৃজনশীলতার নামে বারবার পাঠ্যপুস্তক বদলানো হয়েছে, শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হয়েছে, পরীক্ষাপদ্ধতি তুলে দেওয়ার চিন্তা করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য, তাদের সুবিধা–অসুবিধার দিক নিয়ে কেউ কোনো চিন্তা করেছেন বলে দেখা যায়নি।

প্রায় প্রতিবছরেই দেখা যায় কোনো কোনো বিদ্যালয় থেকে একজনও পাস করে না। এবারও মোট ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি। এর মধ্যে রয়েছে ৪৮টি বিদ্যালয় ও ৮৬টি মাদ্রাসা। কোনো পরিস্থিতিতেই এ রকম অবস্থা চিন্তা করা যায় না। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেলের সংখ্যা অনেক বেশি, এবং কেউ পাসই করে না—সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনপ্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা ২০২৫: প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজন প্রকাশ০৪ আগস্ট ২০২৫

মেধাবীদের মেধার মূল্যায়ন করার জন্য এত বেশিসংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীকে ফেল করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন করে নিয়মিত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাস করিয়েও প্রকৃত মেধাবীদের মেধার স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব। পরীক্ষার ফলাফলে অনেক বেশি নম্বরধারী যেমন থাকতে পারে, তেমনি কোনো মতে পাস করে তারাও থাকতে পারে। কোনো অবস্থাতেই সবার প্রাপ্ত নম্বর সমান হবে না, বরং কম নম্বর থেকে অনেক বেশি নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীও থাকবে। যারা ‘গোল্ডেন এ’ পাওয়ার যোগ্য তারা তা ঠিকই পাবে, আবার অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীও পাস করবে।

যারা এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করে তাদের অধিকাংশই গরিব ঘরের সন্তান। এ কারণেই তারা ন্যাশনাল কারিকুলামের অধীন বাংলা মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছে। বড় হয়ে তারা বাংলাদেশেই থাকবে এবং দেশের জন্য কাজ করবে। তারা বিদেশে গেলেও শ্রম দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আবার দেশেই ফিরে আসবে। তারা বিত্তশালী হলে হয়তো বাংলা মিডিয়ামে পড়ত না। বরং ইংরেজি মিডিয়ামে ‘ও’ লেভেল বা ‘এ’ লেভেলে পড়ত এবং বড় হয়ে বিদেশে চলে যেত, দেশে আর ফিরে আসত না। বিদেশে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হয়ে বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্লট, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি বিক্রি করে ডলার বানিয়ে সেখানে নিয়ে যেত। গরিব ঘরের সন্তানেরা সে গ্রুপের নয়। কাজেই তাদের প্রথমেই থামিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া কাম্য নয়। তাদের থামাতে হলে পরের স্টেজেও থামানো যাবে, কিন্তু তখন এত বড় ক্ষতি করতে হবে না। কারণ, তখন তারা মাত্র দুই বছরের লেখাপড়ার জন্য সনদপত্রের পরীক্ষা দেবে। দীর্ঘ বারো বছর লেখাপড়ার সনদপত্র সেটা হবে না।

পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর প্রায়ই প্রচার করা হয় মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ভালো করেছে, ছেলেরা খারাপ করেছে। কিন্তু ছেলেরা কেন খারাপ করল, সে ব্যাপারে কেউ খোঁজ নেন না। শুধু তাই নয়, গত ৩০ বছর যাবৎ ক্লাসে ছেলেদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। কেন কমছে, তা নিয়ে কেউ কখনো ভাবে বলে মনে হয় না। তাদের কথাবার্তায় মনে হয় শুধু মেয়েরা ভালো করলেই যথেষ্ট, ছেলেরা না পড়লে কী হবে, তা নিয়ে কেউ গবেষণা করে না। তারা লক্ষ করেন কি না, রাস্তাঘাটে যত ধর্ষণের ঘটনা হয়, সেই ধর্ষণকারীদের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক কম শিক্ষিত পুরুষ মানুষ, এমনকি তাদের অনেকে নিরক্ষর। তাদের বড় অংশ আর্থিকভাবে দরিদ্রও। এ দেশে ধর্ষণ নিয়ে আমরা খুব সোচ্চার। কিন্তু ধর্ষণকারী পুরুষদের অধিকাংশ কেন নিরক্ষর অথবা তারা কেন কম শিক্ষিত, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামান বলে দেখা যায় না। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের লেখাপড়ায় আকৃষ্ট করার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হয়, তারপর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কিন্তু ছেলেদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কোনো কিছুই করা হয় না। এ ছাড়া অনেক গরিব ঘরে শুধু ছেলেসন্তান, মেয়েসন্তান নেই। সেসব পরিবার তাদের ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরীক্ষায় অধিকসংখ্যক ছেলে পরীক্ষার্থী ফেল করার এটাও অন্যতম কারণ। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রকে উন্নত করতে হলে এবং সমাজের সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও শিক্ষিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে, তার অনেক নমুনা সমাজে ইতিমধ্যে বিরাজমান।

মনে রাখা প্রয়োজন, সব পরীক্ষার্থী শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য লেখাপড়া করে না বরং বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্যও লেখাপড়া করে থাকে। সেই উৎসাহী বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অযৌক্তিকভাবে ফেল করিয়ে থামিয়ে দেওয়া অনুচিত।

প্রায়ই নোটবই, কোচিং ব্যবসা নিয়ে সমালোচনা করতে দেখা যায়। এগুলো নিয়ে কেন এত সমালোচনা করা হয়, তা আমার কাছে তেমন বোধগম্য নয়। কারণ, যেসব বিষয় পাঠ্যবই থেকে সহজে বুঝতে পারা যায় না, সেগুলো নোটবই পড়ে বুঝতে পারলে কী সমস্যা, তা আমি বুঝি না। বিশেষ করে যারা গরিব ঘরের সন্তান, তাদের পক্ষে তো অনেক টাকা দিয়ে টিউটর রেখে প্রাইভেট পড়া সম্ভব হয় না। সেখানে তারা অল্প টাকায় নোটবই কিনে অনেক কিছু জানতে পারলে বা গ্রুপে কম টাকায় কোচিংয়ে পড়লে কী সমস্যা, তা বুঝি না। নোটবই পাঠ্যবইয়ের আলোকেই প্রণয়ন করা হয়, কোচিংও পাঠ্যবইয়ের আদলেই পরিচালনা করা হয়। তবে শিক্ষকেরা যাতে ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট পড়াতে ঝুঁকে না পড়েন, সে বিষয়ে নজর রাখা যেতে পারে এবং এ বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। বিশেষ করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে কোনো কোচিং ব্যবসা পরিচালনা করতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য নোটবই ও কোচিং পদ্ধতি একেবারে বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। কারণ, বেশির ভাগ নোটবই প্রণয়নের সঙ্গে বা কোচিং পরিচালনার সঙ্গে বেসরকারি ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন, সেগুলোর সঙ্গে স্কুল–কলেজের শিক্ষকেরা সরাসরি জড়িত থাকেন না। আমাদের এ বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে কোচিংয়ে পড়ার সুবিধা বন্ধ করে দিলে অথবা নোটবই পড়ার সুবিধা একবারে বন্ধ করে দিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা, এতে ধনী–গরিবের সুযোগ–সুবিধায় বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে যাতে ১২ বছর একটানা লেখাপড়া করার পর সন্তানদের কেউ ফেল না করে। আমি মনে করি এসএসসি পরীক্ষায় কমপক্ষে ৯০ শতাংশ প্রার্থী পাস করা উচিত। কেউ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলে তা ভিন্ন বিষয়। কারণ, যারা এত বছর ধৈর্য ধরে লেখাপড়া করে এ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে তারা প্রয়োজনীয় ন্যূনতম লেখাপড়া করে এবং যোগ্যতা প্রমাণ করেই এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ন্যূনতম পাস নম্বরও বাস্তবমুখী করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্লাসের উপস্থিতির জন্য কিছু নম্বর দেওয়া হয়। এখানেও তা রাখা যেতে পারে। কারণ, তারা এত বছর ক্লাস না করে এ পর্যন্ত আসতে পারেনি।

এসএসসি পরীক্ষায় নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাসের হার বাড়ানোর জন্য গভীরভাবে এবং বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এ উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ থেকে প্রশ্নের ধরন ঠিক করে দেওয়া, কমপক্ষে ৫০ শতাংশ প্রশ্ন খুব সহজ করা, বাকি প্রশ্নগুলো ধাপে ধাপে কঠিন করা। প্রশ্নপত্র ধাপে ধাপে কঠিন করা অধিক মেধাবীকে চিহ্নিত করার উপায়। এ উদ্দেশ্যে পরবর্তী ২০ শতাংশ প্রশ্ন কিছুটা কঠিন হতে পারে, পরবর্তী ৩০ শতাংশ ধাপে ধাপে আরও কঠিন করা যেতে পারে। তবে সব প্রশ্নই সিলেবাসের মধ্য থেকে বা ক্লাসে পড়ানোর মধ্য থেকে করা উচিত। ক্লাসে হাজিরার জন্য ৫ থেকে ১০ শতাংশ নম্বর রাখা যেতে পারে। তাহলে যারা স্কুলে নিয়মিত ক্লাস করে, তাদের পাস করতে সহজ হবে। এ পদ্ধতিতে শুধু তারাই ফেল করবে, যারা লেখাপড়ায় মোটেই মনোযোগী নয় বা আগ্রহী নয়। কিন্তু যারা এত বছর নিয়মিত লেখাপড়া করে বা নিয়মিত ক্লাস করে এ পর্যন্ত এসেছে এবং সব পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, তাদের কোনোভাবেই ফেল করানোর চিন্তা করা উচিত নয়। পরীক্ষায় অধিকসংখ্যক পাস করলেই লেখাপড়ার মান কমে যায়, এমন চিন্তা অন্তত এসএসসি লেভেল পর্যন্ত চিন্তা করা উচিত নয়। কারণ, এটি কোনো চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নয় বা কোনো উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরীক্ষা নয় যে আসনসংখ্যার তুলনায় বেশি পাস করলে সমস্যা হবে।

আরও পড়ুনইন্দোনেশিয়ায় বৃত্তিতে স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডিতে পড়াশোনার সুযোগ৭ ঘণ্টা আগে

পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস অবশ্যই সুপরিকল্পিত হওয়া প্রয়োজন। এসব সিলেবাস নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের বয়স, তাদের সামর্থ্য, পাঠ্যবইয়ের সহজবোধ্যতা, পঠিতব্য বিষয়গুলোর ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা, বাস্তবতা, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস সবকিছুই বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। সব শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যসূচির যে বিষয়গুলো জানা অতি জরুরি বা যেসব বিষয় বাস্তব জীবনের সবার জানা প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে প্রশ্ন প্রতিবছরের পরীক্ষায় রাখা প্রয়োজন। কারণ, তা না হলে সেই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অনেকে পড়া থেকে বাদ দিতে পারে। তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ভালো ফল বয়ে আনে না। সেসব বিষয়ে প্রতিবছরের পরীক্ষায় প্রশ্ন রেখে পাসের হার কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। কারণ, এ রকম হলে সব শিক্ষার্থী সেগুলো পড়তে ও জানতে বেশি আগ্রহী হবে, পরীক্ষায়ও ভালো করবে। অনেক সময় দেখা যায়, পরীক্ষায় ভুল প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলা হয়। এ বিষয়েও বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। তারা নকল করে নয় বরং সহজে লেখাপড়া করেই যেন পাস করতে পারে। অনেক শিক্ষকও নকলকে সহায়তা করেন। পরীক্ষায় নকল করা অবশ্যই দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে লেখাপড়ার মান ও ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে না।

অনেকেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার জন্য সরকার কর্তৃক শিক্ষা খাতে কম অর্থ বরাদ্দকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ বেশি করা হলেই শিক্ষার মান বাড়বে বা অধিকসংখ্যক পাস করবে, তা তার নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ, এর জন্য শিক্ষকসহ কর্তৃপক্ষের যেরূপ মনোভাব দরকার, তার সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের অনেক ধরনের সমস্যা আছে। তাঁদের বেতন–ভাতায় প্রায়ই অনিশ্চয়তা থাকে, এমনকি অনেক মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষককের আর্থিক সুবিধাদি প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় কম। তাঁরা অবসরে যাওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে অবসরজনিত সুবিধার টাকা তুলতে পারেন না। প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও কল্যাণ তহবিলের টাকা উত্তোলন করতে পারেন না। এসব বিষয়েও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, কোনো শিক্ষকের সাংসারিক অবস্থা নাজুক রেখে অথবা তাঁদেরকে দুশ্চিন্তায় রেখে তাঁদের কাছ থেকে মানসম্মত বা প্রত্যাশামতো সার্ভিস আশা করা যায় না।

এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তাদের বাকি জীবনে এ ব্যর্থতার দায় বহন করতে হয়। এর জন্য অনেকের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। এই ক্ষতি শুধু পরীক্ষার্থীর নয় বা শুধু পরিবারের নয়। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি, মানবসম্পদেরও অপচয়। এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা মানে সারা জীবনের আফসোস, সারা জীবনের বেদনা। এই ব্যথা, বেদনা ও ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আনা যায়, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের সব নীতিনির্ধারকের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। এখানে কোনো ধরনের রাজনীতি কাম্য নয়। লেখাপড়া বা শিক্ষা মৌলিক অধিকার, এটাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা বাঞ্ছনীয় এবং সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

*লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শাবিপ্রবির হিট প্রকল্পে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক লবিংয়ের অভিযোগ
  • আড়াইহাজারে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
  • এসএসসি পরীক্ষার সনদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া মোটেই কাম্য নয়
  • রাজশাহীতে দোকানে খাঁচায় বন্দী ২০০ ঘুঘু উদ্ধার, পরে অবমুক্ত
  • এসিল্যান্ড-ইউএনও-ডিসি অফিস, কোথাও মিলে না তথ্য
  • নিকলী হাওর থেকে ইংলিশ চ্যানেল জয়, সাঁতারু নাজমুলের সাহসী গল্প
  • মেয়ের বউভাত অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল বাবার
  • গফরগাঁওয়ে বজ্রপাতে ব্যবসায়ীর মৃত্যু
  • নির্বাচনের আগে লটারির মাধ্যমে এসপি-ওসির পদায়ন হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • এনসিপির প্রোগ্রামে বাধা দেওয়ায় কথা কাটাকাটি, জিডি করলেন এসিল্যান্ড