সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ পর্যটক। এ ঘটনায় পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে নয়াদিল্লি। হামলার বদলা নিতে হুমকি-ধমকির একপর্যায়ে বুধবার রাতে দেশটিতে আক্রমণ চালায় ভারত। এতে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত এবং আহত হয় আরও অনেকে। জবাবে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তানও। এতে ১৫ ভারতীয়র প্রাণহানি ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের ফলে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাম্প্রতিক উত্তেজনা ক্রমেই যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। ফলে শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পুরো দক্ষিণ-এশিয়া পড়তে যাচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে।
বুধবার রাতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে ২০১৯ সালের তুলনায় বড় পরিসরের উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক সংঘাতের সূত্রপাত কীভাবে?
গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীরা হামলা চালায়। এতে ২৫ ভারতীয় ও এক নেপালি নাগরিক নিহত হয়। এ সময় আহত হয় বেশ কয়েকজন পর্যটক। মূলত এ হামলার পর থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। হামলার সঙ্গে পাকিস্তান সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করে মোদি সরকার। তবে শেহবাজ শরীফের সরকার তা অস্বীকার করে।
তথ্য বলছে, ২০০৮ সালে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার মুম্বাইয়ে হামলার পর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা। ওই হামলায় ১৬৬ জন মানুষ নিহত হয়েছিল।
কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতা উস্কে দেওয়ার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে ভারত। আজ বুধবার দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পেহেলগাম হামলায় অংশ নেওয়া বন্দুকধারীদের সঙ্গে পাকিস্তানের যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে নয়াদিল্লি। লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট এই হামলার পেছনে কাজ করেছে। যদিও রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নাগরিকরা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ জারি রেখেছে। তারা স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়া দাবিতে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের দমাতে অঞ্চলটিতে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি মোতায়েন ভারত সরকার।
নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ২০১৯ সালের আগস্টে কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইন্টারনেট বন্ধ রাখার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অঞ্চলটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও গত মাসেই ঘটে গেল ভয়াবহ হামলার ঘটনা।
পাকিস্তানের কোথায় হামলা চালিয়েছে ভারত?
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা পাকিস্তানের ৯টি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে কোনো সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। তবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মতে, ছয়টি স্থানে ২৪টি হামলা চালিয়েছে ভারত। এগুলো হলো- পাকিস্তান ভূখণ্ডের পূর্ব আহমেদপুর, মুরিদকে ও শিয়ালকোট এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কোটলি, বাগ ও মুজাফ্ফরাবাদ।
পাকিস্তানের নেতারা এই হামলাকে ‘যুদ্ধের উস্কানি’ বলে নিন্দা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বলেছেন, এই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার দেশের ‘সমুচিত জবাব দেওয়ার’ অধিকার রয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধান সামরিক মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বুধবার স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ফ্রান্সের তৈরি যুদ্ধবিমান রাফায়েলও রয়েছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সেখানে দেখা যায়, একটি যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়া উঠছে। কর্মকর্তারা দাবি করেন, এটি বিধ্বস্ত বিমানগুলোর একটি। তবে বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ভারত সরকারের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি।
কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ কী?
কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। ওই সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় উপমহাদেশ হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়।
উপমহাদেশের প্রায় ৮৫ হাজার ৮০০ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত এই পার্বত্য অঞ্চলটি নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। বিভিন্ন চুক্তির ফলে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে প্রতিটি দেশ কাশ্মীর বা এর কিছু অংশের মালিকানার দাবিতে এখনো প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
বিভাজনের আগে এই অঞ্চলটি জম্মু ও কাশ্মীর নামে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য ছিল। পরবর্তীতে স্বাধীনতার জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা সত্ত্বেও, রাজ্যের হিন্দু নেতা ভারতে যোগ দিতে রাজি হন। যদিও অধিকাংশ নাগরিক এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিল। একপর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। পরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ‘যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর হয় এবং রাজ্যটিকে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত বৃহত্তর অংশে বিভক্ত করা হয়। উভয়ের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সীমান্তকে নিয়ন্ত্রণ রেখা বলা হয়। আর ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর থেকে কাশ্মীরের পূর্ব অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ভারত ও পাকিস্তানের কাছে কী কী পারমাণবিক অস্ত্র আছে?
ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ফলে কাশ্মীর নিয়ে তাদের বিরোধ যখনই তীব্র হয়, তখন এটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, পাকিস্তান ও ভারতের প্রত্যেকের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পাকিস্তানের তুলনায় প্রতিরক্ষা খাতে নয় গুণ বেশি ব্যয় করেছে ভারত। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে, ভারত তার প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে, যেখানে পাকিস্তান ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি বরাদ্দ দিয়েছে।
সেনাসংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে ভারত। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের মতে, ভারতের মোট সক্রিয় সৈন্য সাড়ে ১৪ লাখের কিছু বেশি, অন্যদিকে পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের কিছু বেশি। রিজার্ভ সেনা বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর ক্ষেত্রেও এগিয়ে ভারত।
স্থলভাগের শক্তি বিবেচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ভারত। তবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি ও মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর বা রকেট লঞ্চারের সংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি সংখ্যা ৬৬২, ভারতের ১০০। পাকিস্তানের মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর ৬০০, ভারতের ২৬৪।
অন্য বেশ কিছু দিকে সংখ্যায় এগিয়ে ভারত। ভারতের ট্যাংক সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি, সাঁজোয়া যান ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৪টি, টোওড আর্টিলারি বা টেনে নেওয়ার কামান ৩ হাজার ৯৭৫টি। পাকিস্তানের ট্যাংক রয়েছে ২ হাজার ৬২৭ টি, সাঁজোয়া যান ১৭ হাজার ৫১৬টি, টোওড আর্টিলারি ২ হাজার ৬২৯ টি।
দুই দেশের কেউই জাতিসংঘের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘নয়া মানুষ’
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রান্তিক চরের মানুষের জীবনযাপন, মানবিকতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের চিত্র নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’। প্রশংসিত এই চলচ্চিত্র জায়গা করে নিয়েছে ‘কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর পঞ্চম আসরে। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে আজ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের এই আলোচিত চলচ্চিত্রটি।
৭ দিনব্যাপী এ উৎসবে মিসর, জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ভারতের নির্বাচিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রদর্শিত হবে ‘নয়া মানুষ’, যা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছে উৎসবে।
আরো পড়ুন:
দুই গায়িকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, দ্বন্দ্ব চরমে
সমালোচনা নিয়ে মুখ খুললেন ভাবনা
২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘নয়া মানুষ’ দর্শক ও সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ায়। আ. মা. ম. হাসানুজ্জমানের লেখা ‘বেদনার বালুচরে’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেন মাসুম রেজা।
চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, মৌসুমী হামিদ, আশীষ খন্দকার, ঝুনা চৌধুরী, শিখা কর্মকার, নিলুফার ওয়াহিদ, বদরুদ্দোজা, মাহিন রহমান, নাজমুল হোসেন, স্মরণ সাহা, সানজানা মেহরান ও শিশুশিল্পী ঊষশী।
উৎসবে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গল্পকার ও অভিনেতা আ. মা. ম. হাসানুজ্জমান বলেন, “আমি যখন গল্পটি লিখি, তখন এত কিছু ভাবিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রটি দর্শক দেখার পর যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তা সত্যিই অকল্পনীয়। ‘নয়া মানুষ’ ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করছে, শান্তির বার্তা দিচ্ছে, ধর্মের প্রকৃত দর্শন তুলে ধরছে—এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
চলচ্চিত্রটির নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি বলেন, “আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিচ্ছে—এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। কাশ্মীর ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ‘নয়া মানুষ’ অংশ নিচ্ছে, যা দেশের চলচ্চিত্রের জন্যও একটি বড় সাফল্য।”
চাঁদপুরের দুর্গম কানুদীর চরে চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটির। চিত্রগ্রহণ পরিচালনা করেছেন কমল চন্দ্র দাস। সিনেমাটির সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাউল শফি মণ্ডল, চন্দনা মজুমদার, বেলাল খান, অনিমেষ রয়, মাসা ইসলাম ও খাইরুল ওয়াসী। সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী, মুশফিক লিটু ও শোভন রয়।
মানবতার বার্তা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও জীবনবোধের অনন্য মেলবন্ধন নিয়ে ‘নয়া মানুষ’ এবার বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিচ্ছে শান্তি ও সহমর্মিতার বার্তা।
ঢাকা/রাহাত/শান্ত