রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুই বোনকে হত্যার ঘটনায় বাড়ির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় (সিসিটিভি) দেখা যাওয়া অপরিচিত এক ব্যক্তিকে খুঁজছে পুলিশ। তাঁদের ধারণা, ওই ব্যক্তিই দুই বোনকে হত্যা করে থাকতে পারেন। এ ছাড়া পুলিশ বাড়ি থেকে আজ শনিবার কিছু আলামত জব্দ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে।

গতকাল শুক্রবার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওই বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সাবেক কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম (৬০) ও তাঁর ছোট বোন সুফিয়া বেগমকে (৫২) ছুরিকাঘাত ও শিল–নোড়ার আঘাতে হত্যা করা হয়। রাত ১১টার দিকে পুলিশ তাঁদের লাশ উদ্ধার করে।

দুই বোন খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটনে পুলিশ বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে। এতে দেখা যায়, শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে নীল রঙের জিনস প্যান্ট ও গাঢ় নীল রঙের শার্ট পরা এক ব্যক্তি বাড়িটির দোতলায় ওঠেন। তাঁর মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক আর মাথায় ছিল কমলা রঙের ক্যাপ। পরনের কাপড় পাল্টে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ওই ব্যক্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.

সাজ্জাদ রোমন আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সিসিটিভির ফুটেজের ওই ব্যক্তির হাতে একটি কালো ব্যাগ ছিল। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দোতলা থেকে নামার সময় তিনি মাথা নিচু করে ছিলেন। হয়তো তিনি পরিবারটির চেনাজানা। তাঁকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা গেলে হত্যাকাণ্ডের কারণ বেরিয়ে আসতে পারে।

ওই বাড়িতে মরিয়ম বেগম, তাঁর স্বামী কাজী আলাউদ্দিন ও মেয়ে নুসরাত জাহান এবং মরিয়মের ছোট বোন সুফিয়া বেগম থাকতেন। ঘটনার সময় কাজী আলাউদ্দিন বরিশালে গ্রামের বাড়িতে আর নুসরাত অফিসে ছিলেন।

আজ দুপুরে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নুসরাত জাহানকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনেরা। নুসরাত মিরপুর ১১ নম্বরে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনের মতো শুক্রবার সকাল ছয়টার দিকে তিনি নিজ কর্মস্থলে যান। রাত পৌনে ৯টার দিকে বাসায় ফিরে কলিংবেল বাজালে ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাননি। পরে বিকল্প চাবি দিয়ে তালা খুলে বাসায় ঢুকে মাকে ডাইনিং রুমে আর খালাকে শোয়ার ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান।

নুসরাত বলেন, তাঁর মায়ের মাথায় ও পেটে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত হয়। খালার মাথা শিল–নোড়ার আঘাতে থেঁতলানো ছিল। ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল রক্তমাখা চাকু ও শিল–নোড়া। তিনি প্রতিবেশীদের অ্যাম্বুলেন্স আনার অনুরোধ করেন। এরই মধ্যে বাসায় পুলিশ আসে। খাবারের টেবিলের ওপর একটি মগে শরবত বানানো এবং পাশে তিনটি গ্লাস ছিল বলেও জানান তিনি।

নুসরাত বলেন, জানামতে তাঁর মা-বাবার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ বা শত্রুতা ছিল না। তাঁর মা ঢাকায় বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ে সহকারী সমন্বয় কর্মকর্তা ছিলেন। এক বছরের বেশি সময় আগে তিনি অবসরে যান। তাঁদের বাসা থেকে টাকা বা মালামাল কোনো কিছু খোয়া যায়নি। তাঁর মা ও খালার গায়ে সোনার গয়নাও খোয়া যায়নি। এখন জমিজমা নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল কি না, সেটা তাঁর বাবা ভালো বলতে পারবেন।

২০ বছর ধরে তাঁরা এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকেন বলে জানান নুসরাত। তিনি বলেন, তাঁর মা খুবই সতর্ক ছিলেন। অপরিচিত কোনো লোককে তিনি বাসায় ঢুকতে দিতেন না। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী বেশির ভাগ সময়ই ফটকে থাকতেন না। ভাড়াটেরা তালা খুলে আবার লাগিয়ে দিতেন। কোনো কারণে বাড়ির প্রধান ফটক খোলা থাকলে, যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে।

পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মাজেদুল ইসলামও একই কথা জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে বাড়ির মালিককে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি তাঁরা। পাশের বাসায় দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু কোনো শব্দ পাননি।

ঘটনার সময় মরিয়মের স্বামী বন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী আলাউদ্দিন বরিশালের দেহেরগতিতে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতা বা জমিজমা নিয়েও কোনো বিরোধ ছিল না। তিনি স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকাকে সুস্থ রেখে গ্রামের বাড়িতে যান। আলমারির ড্রয়ারের কাগজপত্র এলোমেলো ছিল বলে তিনি শুনেছেন। সেগুলো কী ধরনের কাগজপত্র, তা দেখার পর বুঝতে পারবেন।

মরিয়ম ও সুফিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে হিমঘরে রাখা হয়েছে। কাজী আলাউদ্দিন বলেন, তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ইশরাত জাহান যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সে এলেই তার মা–খালাকে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে।

আজ দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ওই বাসা থেকে কিছু আলামত জব্দ করে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। মিরপুর থানার ওসি সাজ্জাদ রোমন বলেন, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাঁকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। হত্যার তদন্ত চলছে।

দুপুরে এই প্রতিবেদক ওই বাড়িতে ঢোকার সময় প্রধান ফটকটি খোলা পান। জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী বলেন, পুরো বাড়ি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁর ওপর। এ কারণে তিনি সব সময় প্রধান ফটকে থাকেন না। এ ছাড়া পাশে তাঁর পানের দোকান আছে, সেখানেও বসেন।

আরও পড়ুনরাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুই বোনকে হত্যা২১ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক কর মকর ত ব দ কর ওই ব ড় র ওই ব র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

এবার কি বড়াল নদের অবমুক্তি সম্ভব হবে

১.

উত্তরবঙ্গের বড়াল একটি ব্যতিক্রমী নদ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ–নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে বড়াল মূলত পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় গঙ্গা (পদ্মা) থেকে উৎপত্তি হয়ে এই নদ নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণমুখী অগ্রসর হয়ে হুরসাগর নদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাঘাবাড়ীর কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

বড়ালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পদ্মা ও যমুনার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী নদ; অন্তত আগে তা–ই ছিল। এই নদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি রাজশাহী বিভাগের বিশাল চলনবিলের প্রধান নদ।

উত্তর থেকে প্রবাহিত প্রায় সব নদ–নদী, যেমন আত্রাই, নাগর, শিবা, বারনাল, করতোয়া, গুমানী, হুরসাগর আলাদাভাবে কিংবা অন্য নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড়াল নদের সঙ্গে মিশেছে। ফলে চলনবিলকে বিশাল সংরক্ষণ জলাধার হিসেবে ব্যবহার করে পদ্মা-যমুনার প্রবাহের উচ্চতার ভারসাম্য রক্ষাকারী নদ ছিল বড়াল।

একদা প্রমত্ত এই নদ দিয়ে পালতোলা বড় বড় সওদাগরি নৌকা চলাচল করত। বড়াল গোটা চলনবিল এলাকাকে সজীব রাখত, কৃষির জন্য পানি জোগাত এবং বহু প্রজাতির মাছের আধার হিসেবে কাজ করত। শুধু রাজশাহী বিভাগের জন্য নয়, গোটা পদ্মা-যমুনা অববাহিকার জন্যই বড়ালকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

২.

নদ–নদীর বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভ্রান্ত নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে এই নদকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যেতে পারে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ১৯৮৪ সালে; যখন বড়ালের উৎসমুখে মাত্র তিন কপাটবিশিষ্ট একটি স্লুইসগেট নির্মিত হয়, যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩০ ফুটের মতো। মুক্তাবস্থায় বড়ালের মুখের প্রশস্ততা ছিল ৫০০ ফুটের মতো এবং তা দিয়ে বর্ষাকালে পদ্মার গড়ে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক পানি বড়াল নদে প্রবেশ করত।

স্লুইসগেট নির্মাণের পর এর পরিমাণ দ্রুতই গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেকে হ্রাস পায়। স্বল্প প্রশস্ততার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই স্লুইসগেটের পাটাতনের উচ্চতা, যা ছিল ১০ দশমিক ২ মিটার (পিডব্লিউডি)। ফলে পদ্মার পানি উচ্চতার কারণেও বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং স্লুইসগেটের মুখে পলিপতন ঘটে। অচিরেই পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শুধু চারঘাটে স্লুইসগেট বানিয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, ১৯৯৫ সালে তারা আটঘরিতে (যেখানে বড়াল নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে নন্দকুজা নামে একটি শাখানদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয় সেখানে) আরও দুটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। তার মধ্যে পাঁচ কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নন্দকুজার দিকে এবং এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট মূল বড়ালের দিকে। একটি নদীর ওপর এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নির্মাণ করা যায়, তা ভাবতেও অবাক লাগে এবং দেখলে কান্না পায়!

এসব স্লুইসগেট বড়াল হত্যার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করে। আটঘরি থেকে বড়াইগ্রাম পর্যন্ত বড়াল নদ সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় এবং সেখান থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদের ওপর মাটির অনেকগুলো আড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, যার ফলে নদটি কতগুলো বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়।

এভাবেই এককালের জীবন্ত বড়াল একটি ‘মৃত’ নদে পরিণত হয়। জনগণে এটাকে নাম দেয় ‘মরা বড়াল’।

বলা বাহুল্য, নদ হত্যার এ প্রক্রিয়ায় পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহযোগী হয় স্থানীয় অসাধু রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা, যারা এই সুযোগে নদের জমি দখল করে, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত নদে মাছ ধরার ইজারা নেয় এবং বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ থেকে মুনাফা অর্জন করে।

৩.

নদের এ ‘অকালমৃত্যু’র পর বড়ালপারের সাধারণ জনগণের মনে ক্ষোভ আর দুঃখের সীমা থাকে না। তাঁরা ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং অন্যান্য পরিবেশ ও নদী রক্ষা সংগঠন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।

তাদের প্রচেষ্টায় বড়াল নদের বিষয়টি সরকারের নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সের আলোচ্যসূচির (এজেন্ডা) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। টাস্কফোর্সের সভাপতিসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা একাধিকবার বড়াল এলাকা পরিদর্শ করেন। জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা স্থানীয় জনগণকে বড়াল নদ অবমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

২০১৩ সালে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’-এর উদ্যোগে বড়ালের পাড় ধরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৯ সালে সরকারকে ‘বড়াল নদের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার’ আদেশ দেন।   

উচ্চ আদালতের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মরা’ বড়ালের ওপর নির্মিত মাটির চারটি আড়িবাঁধ অপসারণ করে সেখানে সেতু নির্মিত হয়। কিন্তু সমস্যার উৎস, তথা চারঘাট ও আটঘরির স্লুইসগেটগুলো অপসারিত হয় না।

পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পদ্মার সঙ্গে বড়ালের উৎসমুখে ১ হাজার ৮০০ মিটার দীর্ঘ মাটি খনন করে। কিন্তু চারঘাটের স্লুইসগেটের কারণে এই মাটি খনন কোনো স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারে না। এর কারণ, পলিপতনে খনন করা অংশ পুনরায় ভরাট হয়ে যায়। 

নদী রক্ষা করতে চাওয়া সংগঠনগুলো বড়াল নদসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের সভায় চাপ সৃষ্টি করে। এরপর পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আমলাতান্ত্রিক কূটবুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তারা যুক্তি দেখায়, স্লুইসগেটগুলো অপসারণ করার আগে এর অভিঘাত কী হতে পারে, তা নির্ণয়ের জন্য সমীক্ষা সম্পাদন প্রয়োজন।

এভাবে বড়াল অবমুক্তকরণের গোটা প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জানানো হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) দ্বারা এরূপ একটি সমীক্ষা সম্পাদন করবে।

৪.

প্রায় ১০ বছর পর ২০১৮ সালে আইডব্লিউএম ‘বড়াল অববাহিকার পানিসম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাতের মূল্যায়নসহ বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’র প্রতিবেদন পেশ করে।

এ সমীক্ষায় জানানো হয়, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি বড়ালে প্রবাহিত করার প্রয়াস সমীচীন নয়। কারণ, ফারাক্কার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিসীমা অত্যন্ত নিচে নেমে যায়।

এ রকম অবস্থায় আইডব্লিউএমের মূল সুপারিশ হলো শুধু পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ আরও বেশি হারে বড়ালের দিকে প্রবাহিত করা। তবে এটা করার জন্য আইডব্লিউএম এক অভিনব সুপারিশ করে। সেটা হলো, চারঘাটের বর্তমান স্লুইসগেটের পাশে আরেকটি দুই কপাটের রেগুলেটর নির্মাণ করা।

বড়াল অববাহিকার জনগণের দাবি হলো স্লুইসগেট অপসারণ এবং এই দাবির জন্য তাঁরা প্রায় ২০ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন। এর চেয়েও
বড় কথা, উচ্চ আদালত যেখানে বড়ালের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে আইডব্লিউএমের সুপারিশ হচ্ছে আরও স্লুইসগেট বানাও!

লক্ষণীয়, আইডব্লিউএম জানায়, বড়ালের বিষয়ে সুপারিশে পৌঁছানোর জন্য ১০টি সম্ভাব্য পরিস্থিতি শনাক্ত করা হয় এবং এগুলোর মধ্যে ৮ নম্বর পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভালো মনে করা হয়। কিন্তু এই ১০টি পরিস্থিতির মধ্যে একটিতেও চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

মূল যেটা জানার বিষয় ছিল (চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণ করার অভিঘাত কী হবে), সেটাই এই সমীক্ষায় পরীক্ষা করা হয়নি। তা না করে আইডব্লিউএম পাউবোর জন্য ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে দিয়েছে।

এ অর্থের একটি বড় অংশ নির্ধারিত হয়েছে নদী খননের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে ‘মরা’ বড়ালের ১১০ কিলোমিটার খনন। তার সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছে মুসাখান ও নারদ নদের আংশিক খনন। কিন্তু খননের সুফল স্থায়ী হবে না, যদি না বড়াল নদে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।

লক্ষণীয় হলো, নদের মুখ যদি পর্যাপ্তরূপে উন্মুক্ত করা না যায়, তাহলে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ বড়ালে পৌঁছাবে না। তার জন্য প্রয়োজন চারঘাটের স্লুইসগেট অপসারণ করে নদের আদি প্রস্থভিত্তিক (কমপক্ষে ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের) সেতু নির্মাণ।

আরও যা লক্ষ করার মতো বিষয়, আইডব্লিউএম প্রস্তাবিত নতুন রেগুলেটরের পাটাতনের উচ্চতা হবে ৯ দশমিক ২ মিটার। ফলে এটাও বড়ালের প্রবেশদ্বারে পলিপতন ঘটাবে এবং বড়ালের সমস্যার নিরসনে কোনোই অবদান রাখবে না।

৫.

আইডব্লিউএম বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে যদি চারঘাটে কোনো রেগুলেটর না থাকে, তাহলে ২৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে। এটা দ্বারা আইডব্লিউএম বাংলাদেশের পানি সমস্যার মূল চরিত্র অনুধাবনে ব্যর্থতার স্বাক্ষর দিয়েছে এবং ওলন্দাজদের দ্বারা আরোপিত পোল্ডার পন্থার অন্ধ অনুকরণ করছে।

এই ‘পোল্ডার পন্থা’ গোটা চলনবিলকে বিপর্যস্ত করেছে। এই পন্থার অনুসরণে চলনবিলের উত্তর ভাগে আত্রাই ও বারনাই নদের অববাহিকায় নির্মিত পোল্ডার এ, বি, সি এবং ডি চলনবিলের স্বাভাবিক চরিত্রকে বিনষ্ট করেছে। দক্ষিণে পাবনা সেচ প্রকল্পের নামে বড়াল অববাহিকার দক্ষিণ ভাগকে ইছামতী নদীসহ অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ডান তীর রক্ষা বাঁধের নামে আটটি নদীর সংযোগ রুদ্ধ করার মাধ্যমে চলনবিলের দিকে যমুনার প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে।

পোল্ডার পন্থাভিত্তিক এই সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে চলনবিল আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে (বাংলাদেশের জন্য ওলন্দাজদের পোল্ডার পন্থার অসারতা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন লেখকের সাম্প্রতিক বই বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বর্তমান ধারার সংকট ও বিকল্প পথের প্রস্তাব এবং ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার)।

বর্ষাকালে বিল প্লাবিত হবে—এটাই প্রত্যাশিত এবং প্রয়োজন। জনগণ এই প্লাবনের পক্ষে এবং সে জন্যই তাঁরা চারঘাটের রেগুলেটরের অপসারণ চান। পরিতাপের বিষয়, এই সহজ যুক্তি আইডব্লিউএমের গবেষকেরা বুঝতে সক্ষম হননি! 

৬.

নদী বা পানিসম্পদের বিষয়ে আসলে যুক্তির চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে যে কেউ বলতে পারেন, পাউবো এবং আইডব্লিউএম পরস্পরের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষায় ‘যত্নবান’। পাউবো আইডব্লিউএমকে বিরাট বাজেটের সমীক্ষা প্রণয়নের কাজ দেয়। বিনিময়ে আইডব্লিউএম এমন সব সুপারিশ ‘উপহার’ দেয়, যা পাউবোকে বিরাট বাজেটের প্রকল্প প্রণয়নের সুযোগ করে দেয়। বৈষয়িক স্বার্থের এই বেড়াজালে নদী ও জনগণের স্বার্থ তাই গৌণ হয়ে যায়।

ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এ বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আসবে। জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে বড়াল রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সুহৃদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অন্তর্ভুক্তি বড়াল অববাহিকার জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এরপরও বড়ালের অবমুক্তি বিষয়ে গত ৯ মাসে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। তাহলে আমাদের আশা কি শেষ পর্যন্ত দুরাশায় পরিণত হবে?

ড. নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চারদিন পর কাপ্তাই হ্রদে স্পিডবোট চলাচল শুরু
  • এবার কি বড়াল নদের অবমুক্তি সম্ভব হবে