গোল শামুকের খোল
নিদেনপক্ষে রাজবাড়ির শেষবাতিটি নিভে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা দরকার। একটি বল্লমের ধার দেওয়ার শব্দ যাদের অস্থির করে তুলে তাদের নিয়ে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা জরুরি। এটিই আপাতত আমার ধারণা। আমরা দুপুর অবধি চিন্তা করেছি, ছক কষেছি, হিসাবনিকাশের কোনো কমতি ছিল না। আমরা জানি সেটি হয়ে উঠবে না কোনো কালে। এমনকি আমরা যদি আবারও অপেক্ষা করি। আমাদের তাই সরে আসা জরুরি। অন্য কোনো কাজ, শহরের কোনো ব্যস্ত সড়কপথ বা শহরপ্রান্তের নর্দমাগুলো পরিষ্কার করে তোলার কাজ নিতে পারি আমরা। কিছু না হোক ব্যস্ততার কোনো কমতি থাকবে না। তা ছাড়া আমাদের খাওয়াবে কে, থাকার জায়গাটাই-বা কে করে দেবে। মশা, তেলাপোকা আর ইঁদুরের সঙ্গ কতদিন জানে ঠেকে। সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হবে। সময় তো এমন দশাসই বা দয়াপরায়ণ নয় যে আমাদের জন্য পোড়াবিনির খই ছিটাবে! বা শানবাঁধানো ঘাটে বিছিয়ে রাখবে কদমের তরতাজা রোয়া। সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে আজ না হোক কাল। আমরা রাজসভার পরামর্শকদের সাথে সংলাপ চালাতে পারি, বিপত্তারিণী বাহিনীর যৌথসভায় তুলে ধরতে পারি গরজের আর্জি। আমাদেরও তো একটা ইজ্জত আছে। আমরা নিশ্চয়ই খুনখারাবির মধ্যে যাব না, আর আমাদের জন্য নিজের গলা বাড়াবে কার এমন দায় পড়েছে? হয়তো তেমন একটা জুতসই নয়, একটা না একটা দাম তো আমাদের হাড়েরও আছে। রাজবাড়ির শেষ সীমানা ফলকের ছায়াগুলোকে আমার ভ্রমরার গুনগুন বলে মনে হয়, অনেকেই বলে ভ্রম। আমি ভ্রম ও ভ্রমণের ধারাবাহিকতা ভাঁজ করে জমা দিয়ে এসেছি রাজ অতিথিশালায়। আমরা চাই না এখানে কারোর কোনো নথি বা টান থাকুক যাতে সে আরও শিহরিত হতে পারে বা তার দম আটকে যেতে পারে। কোনো বেসামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এইসব নাকি নানান ঝুঁকি তৈরি করে। সিপাইবাগ এলাকায় আমাদের প্রাথমিক শর্ত ও সিদ্ধান্ত বদলের কথা আলোচিত হয়েছে। মতামত এসেছে নতুন রাজ-অভিষেকের আগেভাগেই প্রতিরক্ষা পরিষদের কাঠামো বদল করতে হবে। আমাদের দাবি ছিল প্রতিরক্ষা সৈনিকেরা আমরুল শাকের ফুলের রঙে পোশাক পরবে। সৈনিকদের জন্য নির্ধারিত ধবধবে লাল রঙের বস্ত্রনির্দেশ আমাদের অপছন্দ ছিল। সংগ্রাম পরিষদের দাবি ছিল রাজদরবারে ঝুমুর বা গেংখুলী বা শেরানজিংপালার আসর বসবে। আমরা তখনও ঘুমিয়ে যাইনি, রাতবিরেতেই আমাদের পরিবার-পরিজনের কোমর-কাছা বেঁধে রণডঙ্কা বাজিয়ে ঘর ছাড়ল, আমাদের মিনতি তারা কানেই তুলল না। বলল, চললাম আমরা রণে চললাম। ঘুম ভেঙে দেখি বসতি শূন্য করে যে যার মতো চলে গেছে রণে।
যুদ্ধের নেশা কাটাতেই হবে, প্রধান বিচারপতির শরণাপন্ন হলাম, আমার শরীরের বাকল খসে খসে আফগান যুদ্ধের পোড়া ঝাঁজ বেরুচ্ছে। কেউ যেন রণে ভঙ্গ না দেয় এই জন্য বিছিয়ে রাখা হলো ঐশ্বর্যের জাল, অমলিন ধনরত্ন, রক্তের দাগলাগা বিষণ্ণ রুমাল। তিতা শাকের ঢেকুর তুলে নিমগ্ন অমাবস্যা ক্রমশ ঘনিয়ে আসে গ্রামের করতলে। আমরা করতলের পিচ্ছিল রেখা ঘষে ঘষে ভোঁতা করে তুলছি, কারণ কেউ যাতে আঘাত না পায়, কেউ যাতে থুতনি বন্ধক না রাখে। আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সংস্থার লোকজন আমাদের সাক্ষাৎকার নিতে এলো, আমরা কেমন আছি, কার কী পুড়েছে, কত জন রক্তাক্ত, আমাদের হজমে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, এইসব। বিরক্ত ধরে গেলে, পিঠ কি পা ঝিমঝিম করে উঠল। এক বুড়ি তার পাছার কাপড় তুলে চিৎকার করে দেখাল, দেখ্ দেখ্ আমেরিকা বোমা মাইর্যা পুটকীর ছ্যান্দা কত্ত বড় করছে, যা খাই তাই খালি হাগা হয়, খালি হাগা বাইর হইয়া যায়, দে আরও খাওন দে, খাওনের বস্তা ফালাইয়া যা। ইরাক যুদ্ধের সময় বুড়ির দুই ছেলেই নিহত হয়। আমরা যুদ্ধের গান শুনি না কেমন যেন ফিনফিনা কেমন যেন আঠা আঠা। মন্ত্রিপরিষদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে রাত থাকতে থাকতেই গোলাবারুদের কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। বাতিল করা হবে আর্তনাদের ষড়যন্ত্র। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কালো রাজাকেই ভোট দেব, গেল কারগিল যুদ্ধে বিধবাদের জন্য তিনি বিশেষ মহার্ঘ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাদা রাজাকে আমরা চাই না, তিনি মিয়ানমারে স্থলমাইন পুঁতে রেখেছেন আর কাশ্মীর উপকূলে ভাসিয়ে দিয়েছেন গলগলে আগুন। যে করেই হোক আমাদের ঘোর ও চূর্ণবিচূর্ণ বিলাপ থামাতে হবে। যে করেই হোক রাজ সংসদের অভিমুখে একটা আসমান-পাতাল মাপের আয়নার ঘেরাও দিতে হবে। যাতে সবাই সবার মুখ দেখতে পায়। যাতে কেউ পিছলে না যায় বা বিনা বিচারে দম বন্ধ না করে। কিন্তু পরিবার-পরিজনকে কী করে ফেরানো যায়, যারা যে যার মতো রণে গেছে চলে। যারা শরীর থেকে রক্তের শেষ দানাগুলোও ঝরিয়ে দিয়েছে মাতৃজমির জন্য তাদের তো আর ফেরানো হবে না কোনোদিন। কিন্তু রাজপ্রাসাদে আবারও বাতি জ্বলে উঠবে, আবারও বেহায়া বারুদ পুড়িয়ে দেবে বাতাসের ঝরঝর। কাউকেই হয়তো ফেরানো হলো না আর রক্তপাতের গভীর থেকে। তরতাজা রাষ্ট্রের ভেতরে কেউ ফেরে কেউ ফেরে না কোনো কালে।
ঘুমের দানা
কিছু কিছু অভ্যস্ততা মুখস্থ হয়ে যায়। মুড়ির লাড়ুতে প্রথম কামড়ের পর দ্বিতীয় কি তৃতীয় কামড়ে লাড়ুর স্বাদ মুখ গহ্বরের মুখস্থ হয়ে পড়ে। পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়িরাও তখন চুপচাপ ঝিমায়, জানে যা নেমে আসবে তরতর তাদের স্বাদ কেমন হবে? শহরের পিঁপড়াগুলিও শহরের মতোই, চিনির কৌটার গলা থেকে পাছা সব মুখস্থ। কী বারে কখন চিনির কৌটায় নতুন চিনি ঢালা হবে, সব জানা আছে তাদের। চা বানানোর পর ঘরের কে কে দুধের ডিবির মুখ লাগাবে না, তাও হদিশে রাখে তারা। আর তখনই সব খসখস এড়িয়ে দুধ কি চিনির দানা টেনে টেনে নিতে হয় দালানের ফাঁকফোকরে। শহরে একটা না একটা ডেরা সবারই জুটে যায় তা সে চিনি বাজারের মালিক কি একটা দানাটানা পিঁপড়াই হোক। শীতের সকালে বাসি ভাত ফানা ফানা করা আঙুলেরাই জানে কত কসরত করে শহরে পেট-পিঠ টিকিয়ে রাখতে হয়। তিন মাস ধরে ভাবছি সার্কাস দলের বন্দি বানরদের নিয়ে কিছু একটা লিখব। যে গলিটাতে থাকি তার ওপাশেই সার্কাস দলের আক্কাস বাকালীর লগে খাতির হয়। সরকার থেকে সার্কাস বন্ধ করায় দলের মালিক বছর দুই হলো দল বেচে দেয়, আক্কাস বাকালীর মতো কতজনে শহরে এসে ময়লা টানার কাজ নেয়। মনে হচ্ছে বর্ষা চলে আসবে শিগগির, কিছু গুড় কিনতে হবে আটার দলায় মেশানোর জন্য। ইঁদুরগুলো আটা গুড়ের এই বিষটোপ বেশ কদর করে। শহরের ইঁদুরগুলো বজ্জাত– কোনটা ধর্মপুস্তক আর কোনটা বাজারের ফর্দ, কিছুই হিসাব করে না। আক্কাস বাকালীকে না পেয়ে গুড়ের দোকানে যাই, হয় সার্কাসের বানরদের নিয়ে লেখা না হয় বিষটোপ একটা না একটা কিছু তো করতে হবে। এইভাবে কি মানুষ ঘুমটি মেরে পড়ে থাকতে পারে? ভাবছি বিউটি ভাবির বাসায় যাব সন্ধ্যার পর। তখনই দু’ঘণ্টার জন্য মীর ভাই বাজারে যাবেন, পিটলু বাবানিদের হাউস টিউটর আসবে, আমরা দরজা বন্ধ করে নিদেনপক্ষে এক-দুইবার করতে পারব। হিসাব করে দেখেছি দুই দিন আগেই তার মাসিক বন্ধ হয়েছে, পিটলু বাবানিদেরও সামনে পরীক্ষা আর জিনিসপত্রের যা দাম! মীর ভাই ঘণ্টা তিনেকের আগে বাজার থেকে রেহাই পাবেন না। বিউটি ভাবিকে প্রতিবারই এক-দুইশ দিতে হয়, নিদেনপক্ষে একটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। শহরের কত বিউটি ভাবি যে এইসব কাজ করে, তাদের সবার মোবাইল নাম্বার তারেকের কাছে আছে। কিছু কিছু নাম্বার তারেক কি বিউটি ভাবি সবারই মুখস্থ, বাজারের ব্যাগের পেট গত সপ্তাহের মুখস্থ শাকসবজির ভারে ফুলে গেলে মীর ভাই আবারও মশার কয়েল কেনার জন্য দোতলা থেকে নামেন। আক্কাস বাকালীকে না পাওয়া গেলে বন্দি বানরদের কী হবে আমি জানি না, ভাবি শহরে তো এত গাছ নেই কিন্তু লাখ লাখ কাক তাহলে থাকে কোথায়? কাকদেরও হয়তো শহরের আসমান মুখস্থ হয়ে গেছে এতদিনে। নালার ধারে গজিয়ে ওঠা তেলাকুচা লতার চারাদের ওপর শিরশির হেমন্তকে উপচে পড়তে দেখে আমি ভিরমি খাই। যেন সব ভিরমি জমে জমে একদিন সরকারি মন্ত্রণালয়ের যন্ত্রণাময় ফেনা হয়ে উঠবে। আর ওই ফেনার ডগায় ডগায় ডুবে ভেসে আমি আমার শরীর তুলে দেব জাতীয় কয়েদখানায়। কয়েদখানার প্রবীণ শিকগুলো মুখস্থ দাসের মতো তুলে নেবে আমার ছায়া। আমি ওই ছায়ার বাকল টেনে টেনে বাতিল বাতিঘরের মতো টেনে নেব শহরের সময়-অসময়ের আজব যানগুলো। আক্কাস বাকালীরা কিছু আটা কিনে নামাবাজারের ধারে একটা ছাপরা দিয়ে বাকরখানির দোকান দিয়েছে। এখনও পনির বাকরখানি বানাবার সাহস তারা করেনি। গরুর ঝাল মাংসের ঝোলে লবণ-জিরার বাকরখানি চুবিয়ে খেতে আমার ঢের লাগে। ভেবে পাই না ঢাকায় যত বাকরখানির দোকান তার সব কারিগর কেন হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গ কি লাখাই কি মাধবপুরের? বাকরখানি কি ঢাকাইয়া না সিলেটি খাবার না এ নিয়ে বিউটি ভাবির বাসায় তুমুল বিবাদ করেছিলাম একবার। গেল চার দিন সারা শহর ঘুরেছি, চাকরিটা চলে গেছে, আরেকটা কাজের কথা আছে কিন্তু তাও মাস দুই অপেক্ষা করতে হবে। ঐ অফিসের কেউ একজন বাচ্চা হওয়ার ছুটিতে যাবে বলে চার-পাঁচ মাসের জন্য আমাকে কাজটি দেওয়া হবে। বিউটি ভাবির বাসায় হয়তো যাওয়া হবে না, একটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর টাকায় আমার এক দিন চলে যাবে। ঘোর লাগা দুপুরে সার্কাসের বানরদের নিয়ে লিখতে শুরু করি। বাংলাদেশে সার্কাস দলে ঠিক কতগুলো বানরকে আটকে রাখা হয়েছে এর কোনো পরিসংখ্যান নাই। সার্কাস দল থেকে ছাড়া পেয়ে একটি বানর আর বানর সমাজে মিশতে পারে না। তাকে কেউ দলে রাখতে চায় না। তার অভ্যাস কি আচরণ সব পাল্টে যায়। সার্কাস দলে তাদের ঠিকমতো খাওয়া বা ঘুম হয় না তাদের জন্য জায়গাও থাকে অল্প। এমনিতে বানরদের কোনো নাম না থাকলেও সার্কাস দলে প্রতিটি বানরের নাম থাকে। আক্কাস বাকালীদের সার্কাস দলে তিনটি বানর, একটির নাম মায়া একটির নাম রাজু আর একটির নাম চন্দনা। লেখাটিতে আক্কাস বাকালীর নাম দিব কি না, এটি আমায় চিন্তায় ফেলে। ভাবি জীবনেও এই লেখা আক্কাস বাকালী পড়বে না, এমনকি বাকরখানি বেঁধে দিতে দিতে ঐ কাগজে ছাপানো তার নামটিও তার নজরে আসবে না। কারণ তার হাতও ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, আমিও হয়তো একটি চাকরি খুঁজে পাবো, বিউটি ভাবির বাসায় যাওয়ার খরচ মিলবে, মীর ভাইকে বাজারে যেতেই হবে। এইবার আমাকে উঠতে হবে, গোসল করার জন্য একটা জায়গা দরকার। সারা শহর ঘুরলে এটি আমি পেয়ে যাবোই। কেউ না কেউ ফিরিয়ে দিবে না। বন্দি বানরের হাতে গলায় বিচ্ছিরি শেকলের দাগ আর ঘা হয়ে থাকে, বর্ষা কি শীতে তাদের খুব কষ্ট, মাথার ওপর তাদেরও একটা ছাদ কি উত্তাপ দরকার। শহরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ভাবি বানরদের নিয়ে লেখা থেকে এই অংশটুকু বাদ দিয়ে দেব, গোসলের জায়গা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত হয়তো এই অংশ টুকু থাকবে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স র ক স দল দ র জন য আম দ র ত ই হব শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে হামলা যেভাবে যুদ্ধের নৈতিক যুক্তি পাল্টে দিল
গত ১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের ওপর আসন্ন হামলার আশঙ্কায় আক্রমণ চালায়। বিস্ফোরণের শব্দে ইরানের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে ওঠে। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল ইরানের ফর্দো ও নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, গবেষণাগার এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের বাসভবন। অভিযান শেষে দেখা যায় ইসরায়েল ৯৭৪ ইরানিকে হত্যা করেছে। ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারান ২৮ জন।
ইসরায়েল তাদের এ হামলাকে আগাম ‘আত্মরক্ষা’ বলে বর্ণনা করেছে। তাদের দাবি, একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে ইরান মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদন—কোথাও এমন প্রমাণ মেলেনি। এ হামলা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইরানি কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটি নতুন পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল।
সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?কিন্তু সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?
নৈতিকতাবিদ ও আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা ‘প্রি-এম্পটিভ’ যুদ্ধ ও ‘প্রিভেন্টিভ’ যুদ্ধের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনেছেন। প্রি-এম্পটিভ যুদ্ধ হয় আসন্ন হুমকির প্রতিক্রিয়ায়। অপর দিকে প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ চালানো হয় ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাব্য হুমকির আশঙ্কা থেকে।
শুধু প্রথম ধরনের যুদ্ধটিই নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য। তথাকথিত ক্যারোলাইন সূত্রে দেখা যায়, প্রি-এম্পটিভ হামলা তখনই ন্যায্য হতে পারে, যদি হুমকিটি হয় ‘তাৎক্ষণিক, চরম এবং এমন অবস্থায় যে বিকল্প কোনো উপায় নেই’। কিন্তু ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ এসব পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করছিল না। কূটনৈতিক পথও পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল না। এ হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের যে ঝুঁকি ছিল (তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া), তা সামরিক প্রয়োজনীয়তার সীমা বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে।
আইন নৈতিক বিধিনিষেধের প্রতিফলন করে। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ৫১ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদটিতে কোথাও সশস্ত্র আক্রমণ হলে, তারপর আত্মরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল যে ‘পূর্বসতর্কতামূলক আত্মরক্ষা’র কথা বলেছে, সেটি একটি বিতর্কিত আইনি প্রথার ওপর দাঁড়িয়ে তারা বলছে। এটি কোনো স্বীকৃত চুক্তিভিত্তিক আইন নয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের হামলাকে ‘একটি নগ্ন আগ্রাসন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই আইন লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থার ভিতকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে। একটি রাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রি-এম্পশন বা আগাম হামলার যুক্তি দাঁড় করাতে পারে, তাহলে অন্যরাও তা করবে। যেমন চীন তাইওয়ানের কাছে টহলদারি দেখে আক্রমণ করতে পারে কিংবা পাকিস্তান ভারতের কথিত সামরিক তৎপরতাকে কেন্দ্র করে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে।
ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনকারীরা যুক্তি দিতে পারেন, অস্তিত্বের হুমকি থাকলে তখন চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করা ন্যায্য। ইরানের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন এবং নিয়মিতভাবে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন।
এখানে যে ঐতিহাসিক ক্ষত আছে, সেটা বাস্তব। কিন্তু দার্শনিকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে বক্তব্য তা যতই বিদ্বেষপূর্ণ হোক না কেন, সেটা কাজের সমান নয়। উসকানিমূলক বক্তব্য আর সশস্ত্র হামলার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। যদি শুধু কথাটাই যুদ্ধ শুরুর ন্যায্যতা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে যেকোনো দেশই অপছন্দের বক্তৃতাকে অজুহাত বানিয়ে আগাম হামলা চালাতে শুরু করতে পারে। ফলে বিশ্ব ‘আদিম রাষ্ট্রের’ দশায় ঢুকে যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত যুদ্ধ শুরুর অজুহাত হয়ে দাঁড়াবে।
ড্রোন নজরদারি আর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাগুলো যখন প্রতিদিনের ভূরাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তখন যুদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাভাবিক বিষয়। আর শান্তি হয়ে যায় ব্যতিক্রমী ঘটনা।
● হোসেইন দাব্বাঘ নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি লন্ডন–এর দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত