সারাবছরই কমবেশি রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ বিক্রি হয়। তবে বছরের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ ঘিরে। পুরো বছরের মোট বিক্রির অর্ধেকের কাছাকাছি বিক্রি হয় ঈদুল আজহার আগে-পরে। এবার ঈদে প্রায় ১২ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রির আশা করছে কোম্পানিগুলো।
একসময় বিলাসী পণ্য হিসেবে পরিচিতি ছিল ফ্রিজ। ব্যবহার হতো উচ্চ বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। সময়ের পরিক্রমায় এটি হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গিক পণ্য। দেশে উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার কারণে এখন তা নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাছেও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ফলে শহর কিংবা গ্রামে সাধারণ আয়ের পরিবারেও এখন ছোটখাটো একটা ফ্রিজ থাকে।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। দেশীয় কোম্পানি ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করায় দামও অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। তা ছাড়া কিস্তিতে কেনার সুযোগ রয়েছে। ফলে শখের পরিবর্তে ফ্রিজ এখন পরিণত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে। দিন দিন চাহিদা বাড়তে থাকায় বড় হচ্ছে ফ্রিজের বাজার, বিশেষ করে কোরবানির সময় এর চাহিদা বেড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে বিক্রেতারা নানা ছাড় ও উপহার ঘোষণা করেন, যা বিক্রিকে আরও চাঙ্গা করে তোলে।
তবে তারা বলছেন, দেশি উৎপাদনকারীদের বছরভিত্তিক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। নানা সংযোজন-বিয়োজন করে প্রতিবছরই নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এ কারণে বাড়তি সময় ও নতুন অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, যা ব্যবসার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই প্রতিবছর নীতি পরিবর্তন না করে দীর্ঘ সময়ের জন্য বহাল রাখা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ১০ বছরের করহার নির্ধারণ, কাস্টমস নীতি এবং নীতিতে কতটুকু ছাড় দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করা দরকার। এতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং ব্যবসার পরিকল্পনা করা সহজ হবে।
ফ্রিজের বিক্রি কখন কত শতাংশ হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে উৎপাদন ও বাজারজাতকারী সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। এর মধ্যে মোট বিক্রির ৬০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ লাখ ইউনিট বিক্রি হয় রমজান ও কোরবানি ঈদে। তবে এ দুই ঈদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কোরবানি ঈদকে ঘিরে। এ সময় বিক্রি হয় প্রায় ৬৫ শতাংশ ফ্রিজ।
ফ্রিজের ব্যবহার একসময় শহরে ছিল। প্রান্তিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে যাওয়ার কারণে এখন গ্রামের চেয়ে শহরে চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। ফলে এখন বছরে মোট যে পরিমাণ বিক্রি হয়, তার ৭০ শতাংশই যায় গ্রামে। সাধারণত সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা দামের ফ্রিজ রয়েছে। তবে গ্রামে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ফ্রিজের চাহিদা বেশি।
এ বিষয়ে ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
বাজারের আকার ১২ হাজার কোটি টাকা
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে দিন দিন বাড়ছে ফ্রিজের বাজারের আকার। বর্তমানে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ফ্রিজের বাজারের আকার ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। দেশে ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যান নেই। তবে জার্মানভিত্তিক বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের
‘কুলার’ বিবেচনায় নিলে এর বাজার ছিল ১৫৩ কোটি ডলারের, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার। গত সাত বছরে বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৩ কোটি ডলার বা ৩০ হাজার কোটি টাকার। স্ট্যাটিস্টার পূর্বাভাস হচ্ছে, ২০২৯ সাল নাগাদ ফ্রিজের দেশীয় বাজার হতে পারে ৩৬ হাজার কোটি টাকার। স্ট্যাটিস্টার হিসাবে বাসাবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পে ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ফ্রিজ ও কুলারজাতীয় যন্ত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০৩০ সাল নাগাদ উৎপাদন দাঁড়াবে ৩২ লাখ ইউনিট
গত দেড় দশকেই দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে ফ্রিজের বাজার। চাহিদা বাড়ার কারণে উৎপাদন বাড়ছে। বাড়ছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও। প্রতিবছর দেশের অভ্যন্তরে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। যদিও কারও কারও মতে, এ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হতে পারে। দেশে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে।
দেশে উৎপাদনে ১৩টি প্রতিষ্ঠান
দেশে বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফ্রিজ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করছে ওয়ালটন। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশই তাদের। এ ছাড়া ভিশন, ইলেক্ট্রা, র্যাগস, মিনিস্টার, ট্রান্সকম, ভিসতা ইলেকট্রনিকস, ওরিয়ন ও যমুনা গ্রুপ উল্লেখযোগ হারে ফ্রিজ উৎপাদন করছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্র্যান্ড স্যামসাং, সিঙ্গার, ওয়ার্লপুল, সনি-স্মার্ট ও কনকার কারখানাও গড়ে উঠেছে। আগে যারা আমদানি করত, তাদের প্রায় সবাই এখন দেশে কারখানা স্থাপন করেছেন।
মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপের ফ্রিজ উৎপাদন বিভাগের প্রধান মনিরুল হাসান স্বপন বলেন, ফ্রিজের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই বর্তমানে পূরণ হয় দেশীয় কোম্পানির মাধ্যমে। বাকি ১০ শতাংশ আমদানির ওপর নির্ভর করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ফ্রিজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। সরকারের নীতি-সহায়তা ও অনুকূল শুল্ক কাঠামো থাকায় দেশে উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করে এনবিআর।
মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত বিদেশি ব্র্যান্ড। এরপর পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। স্থানীয় শিল্পের প্রসারে সরকারের নানা সহায়তায় দ্রুত বড় হতে থাকে এ খাত। বর্তমানে ফ্রিজের বাজার দেশীয় ব্র্যান্ডের দখলে।
রপ্তানি বাজার বাড়ছে
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে দেশীয় ফ্রিজ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানি হয়েছে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ইরাক, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রিয়াসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ ৪০টির বেশি দেশে ফ্রিজ ও এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ রপ্তানি হচ্ছে। তবে সবেচেয় বেশি রপ্তানি হয় ভারতে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফ্রিজ রপ্তানি করে বাংলাদেশ ১৭৫ কোটি টাকা আয় করেছে। দেশের শীর্ষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন জানিয়েছে, গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানি করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে তিন লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া আগামী বছর ইলেক্ট্রো মার্ট রপ্তানি শুরু করবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ এক কর্মকর্তা।
প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে বিনিয়োগ দরকার
বিশ্বে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটছে। উৎপাদনকারীদেরও সেদিকে মনোনিবেশ হতে হবে বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রযুক্তি ও ফিচারের পণ্য উদ্ভাবনে গবেষণা, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণে জোর দেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা জোহেব আহমেদ সমকালকে বলেন, বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে এ খাতে অটোমেশন, গবেষণা ও উদ্ভাবনে জোর দিচ্ছে ওয়ালটন। এসব খাতে প্রতিনিয়ত তারা বিনিয়োগ করছে।
ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আফছার বলেন, ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন করলে বিনিয়োগকারীরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পের বিকাশে এ খাতে আগামী ১০ বছরের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। যাতে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করার পরিকল্পনা নিতে পারেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল খ ইউন ট ফ র জ উৎপ দনক র ব যবহ র ক রব ন ব যবস দরক র বছর র ত বছর
এছাড়াও পড়ুন:
জিমেইল ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করতে নতুন কৌশল
জিমেইল ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করতে নতুন কৌশলে প্রতারণা করছে সাইবার অপরাধীরা। জিমেইল ব্যবহারকারীদের বোকা বানাতে প্রথমে গুগলের পরিচয়ে ভুয়া ই–মেইল পাঠিয়ে থাকে তারা। ই–মেইলের ভাষা হুবহু গুগলের নিরাপত্তা সতর্কবার্তার মতো। তাই অনেক ব্যবহারকারী ই–মেইল প্রেরকের পরিচয় যাচাই না করেই ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেন, যার ফলে তাঁদের গুগল অ্যাকাউন্ট ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
ভুয়া ই–মেইলে দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার গুগলকে একটি আইনি সমন পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সব জিমেইল ব্যবহারকারীর গুগল ফটো, গুগল ম্যাপসহ অ্যাকাউন্টে সংরক্ষিত সব তথ্য হস্তান্তর করতে হবে। বার্তাটিতে ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগের কথা বলা হয় না। ভুয়া ই–মেইলে ব্যবহারকারীর গুগল অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং সহায়তা রেফারেন্স নম্বর থাকায় অনেকেই বার্তাটি গুগলের পাঠানো বলে মনে করেন।
আরও পড়ুনজিমেইলে কয়েক বছর আগের ই-মেইল খুঁজে পাবেন যেভাবে০২ জানুয়ারি ২০২৫গুগল জানিয়েছে, সাইবার হামলা থেকে জিমেইল ব্যবহারকারীদের রক্ষায় নতুন নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। নতুন ধরনের এই সাইবার হামলা থেকে নিরাপদ থাকতে ব্যবহারকারীদের দুই স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও পাসকি ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুনজিমেইল অ্যাকাউন্টের জায়গা খালি করবেন যেভাবে৩০ আগস্ট ২০২৪সাইবার নিরাপত্তা–বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ কোনো অজানা বা অস্বাভাবিক বার্তা এলে তৎক্ষণাৎ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার নেই। বার্তাটি একাধিকবার মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত। অনেক সময় বার্তার ভাষা, তথ্য উপস্থাপন বা বানানে সূক্ষ্ম ভুল থাকে। এসব বিষয় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ভুয়া ই–মেইল থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
সূত্র: নিউজ১৮