ঢাকার নগরজীবনে অনেকের দিনটাই নাকি শুরু হয় যানজট ঠেলে। আবার দিন শেষেও সেই ক্লান্তিকর ঠেলাঠেলি—ভিড়ভাট্টা পাশ কাটিয়ে বাড়ি ফেরা। তবে যানজট ঠেলা সকাল-বিকেলকে বিদায় জানিয়েছেন বৃহত্তর মিরপুর ও উত্তরার বাসিন্দারা। ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজে যাওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরার পরেও এই দুই অঞ্চলের বাসিন্দাদের হাতে জমছে বাড়তি সময়। সেই সময় কাজে লাগাচ্ছেন অনেকে। মেট্রোরেলে চলাচল করে ফেলছেন স্বস্তির নিশ্বাস।

এমনই একজন কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনসংলগ্ন বউবাজার এলাকার তরুণ রিয়েল দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করি। সংগঠনের কাজের এরিয়া (অঞ্চল) পুরান ঢাকা, রমনা এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। মেট্রো হওয়ায় এখন আমি ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজে যাই, নির্দিষ্ট সময় বাসায় ফিরি। অনেকটা সময় পাই। অবসরে গিটার শিখছি।’

মেট্রোরেল কর্মজীবী নারীদের নাগরিক যাপনকে সহজ ও সুন্দর করেছে। অনেকে চাকরি হারানোর শঙ্কা থেকে পেয়েছেন মুক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মী ফাতেমা ফাজরিন ও মিলি আক্তার উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে থাকেন। মেট্রোর জন্য গত ২৪ এপ্রিল উত্তরা উত্তর সেন্টারে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা জানান, বৃহত্তর উত্তরার কর্মজীবী নারীদের জীবনকে সহজ-সুন্দর করেছে মেট্রোরেল। তীব্র যানজটের কারণে কর্মজীবী নারীদের উত্তরা থেকে মতিঝিলে অফিস করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। মেট্রোরেল আসায় বৃহত্তর উত্তরার কর্মজীবী নারীরা এখন ঠিক সময় বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। চাকরি ছাড়ার শঙ্কা থেকেও মুক্ত হয়েছেন তাঁরা।

মেট্রোরেল নগরবাসীকে মানসিক চাপ থেকেও মুক্তি দিচ্ছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সগীর আহমেদ। তিনি প্রায় এক যুগ ধরে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে আছেন। উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল মেট্রো পথের নিয়মিত এই যাত্রী বললেন, ‘মেট্রোরেল আমাকে নিদারুণ মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। কখন বাড়ি ফিরব—এমন মানসিক চাপ নিয়ে মতিঝিল থেকে যাত্রা করতাম। এখন ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে ও বাড়ি ফিরতে পারি।’

‘ওয়ারী থেকে অফিস করি’

উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশনের নিচের প্রশস্ত সড়কটির পশ্চিম পাশ ঘেঁষে চা ও খাবারের দোকানের সারি‍। একটি চায়ের দোকানে বসে চা চাইছিলেন পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা শোভন রুদ্র। একটি বেসরকারি ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা রুদ্র বললেন, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করেছে মেট্রোরেল। আমি ওয়ারী থেকে আবদুল্লাপুর নিয়মিত অফিস করছি।’

শোভন রুদ৶ ওয়ারীর বাড়ি থেকে ৭টা ৪৫ মিনিটে অফিসের উদ্দেশে বের হন। এরপর রিকশায় করে মতিঝিল। মতিঝিল থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশন পৌঁছাতে ৩৩ থেকে ৩৪ মিনিট সময় লাগে তাঁর।

সাংস্কৃতিক সেতু

কথা হচ্ছিল পল্লবী আবাসিক এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা চারণিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, যানজটের কারণে নতুন শতকের শুরু থেকেই শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র বৃহত্তর রমনা এলাকার সঙ্গে মিরপুর এলাকার একটা ছেদ ঘটেছিল। কিন্তু মেট্রোর ফলে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যে শিল্পকলা এলাকা, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কাঁটাবন, নীলক্ষেতে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। মেট্রোরেল নগরের শিল্প-সংস্কৃতির ভাঙা সেতু জোড়া লাগিয়েছে। কিন্তু মিরপুর ডিওএইচএস, পল্লবী, রূপনগর, আরামবাগ, আলুব্দী আবাসিক এলাকাকে কেন্দ্র করে মিরপুর ১২ চত্বর বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

স্বস্তির নাম বিজয় সরণি

বিজয় সরণি মেট্রো স্টেশন ছুটির দিন ছাড়া প্রতিটি দিন বেশ ফাঁকা থাকা। গত ২৪ এপ্রিল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে দেখা যায় সুনসান প্ল্যাটফর্মে অল্প কয়েকজন যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

এ রকম একজন ফাতেমা অন্তরা। তরুণ ব্যারিস্টার। থাকেন আগারগাঁওয়ে। পেশাগত প্রয়োজনে প্রায়ই মতিঝিল-সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় যেতে হয়। তিনি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আগারগাঁও থেকে বিজয় সরণি আসেন। এরপর গাড়ি ছেড়ে মেট্রো ধরে মতিঝিল কিংবা সচিবালয় স্টেশনে নামেন।

ফাতেমা অন্তরা আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত প্রতিটি দেশের মেট্রোতে চড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে আমাদের মেট্রো বেশ ভালো মানের। বিজয় সরণি মেট্রো স্টেশন ও এর আশপাশের এলাকা আমাকে স্বস্তি দেয়।’

বাড়িভাড়া নাগালের বাইরে

মেট্রোর এত এত সুবিধার উল্টো চিত্রও আছে। মেট্রোরেলের কারণে মিরপুরজুড়ে বেড়েছে বাড়িভাড়া, জানালেন তানভীর আহমেদ ও তানজিনা তাসনিম দম্পতি। দুজনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সদ্য বিয়ে করেছেন। তাঁরা জানান, মেট্রোরেলের আশপাশের আবাসিক এলাকায় ছোট দুই কক্ষের বাসা ভাড়ার জন্য ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আর তিন রুমের ফ্ল্যাটের জন্য সার্ভিস চার্জসহ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। বাজেটে কুলাচ্ছে না বলে তাঁরা মেট্রো স্টেশন থেকে বেশ দূরে মিরপুর-২ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। এখানেও তিন কক্ষের বাসাভাড়া মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ৬, ৭, ১০, ১১, ১২ এবং পল্লবী, রূপনগর, আরামবাগ, ইস্টার্ন হাউজিং আবাসিক এলাকায় বাড়িভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে, যা ক্রমেই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

‘মেট্রো ম্যানার’

ঢাকা উত্তরা উত্তর স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম বেশ পরিচ্ছন্ন। যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মের মেট্রো এন্ট্রির প্রতিটি ফটকে লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন। কথা হয় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুলফিকার আলীর সঙ্গে। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরে থাকেন। মেট্রোতে করে তিনি প্রতিদিন সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছান। জুলফিকার আলী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মেট্রো সেবার মান ভালো। তবে যাত্রী হিসেবে আমাদের আরও সভ্য হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মেট্রোতে উঠেই উচ্চ স্বরে কথাবার্তা, ফোনালাপ, অযাচিত তর্কবিতর্ক প্রতিদিন লক্ষ করি। সহযাত্রীর অসুবিধা হয়—এমন কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এল ক র মত ঝ ল র জন য এল ক য় য নজট

এছাড়াও পড়ুন:

নভেম্বরে বৃষ্টি ফসলের জন্য কতটা ক্ষতির

বাড়ির সামনে ১৫ শতক জমিতে সবজি আবাদ করেছেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা গ্রামের কৃষক শাম্মত আলী (৬০)। পালংশাক, মুলা, ডাঁটা ও মরিচের বীজ বুনেছেন তিনি। মরিচের বীজ বোনার দুই দিন পর বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে বীজ পচে গেছে। নভেম্বরে অসময়ের বৃষ্টিতে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ইতিমধ্যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় আমন ধান কাটতে শুরু করেন কৃষকেরা। এ ছাড়া শীত মৌসুমকে সামনে রেখে কৃষকেরা সবজি চাষ শুরু করেছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলগুলোতে বিপুল পরিমাণ সবজির আবাদ হয়। তবে নভেম্বরের শুরুতে টানা বৃষ্টি এসব ফসলের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রভাব বাজারেও পড়তে পারে।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার ১৩টি ‍উপজেলায় চলতি আমন মৌসুমে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এবার শর্ষে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে শর্ষে আবাদ করা যাচ্ছে না। ২১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। বৃষ্টির কারণে বাঁধাকপি, ফুলকপি, করলা, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়ার কিছুটা সমস্যা হতে পারে। বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।

নভেম্বরের বৃষ্টি ফসলের জন্য কতটা ক্ষতির জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. পারভেজ আনোয়ার বলেন, নিম্নচাপের কারণে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বরে এমন বৃষ্টি অপ্রত্যাশিত। ইতিমধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকেরা ধান শুকাতে সমস্যায় পড়বেন। যাঁরা কাটতে পারেননি, তাঁদের জমিতে পানি ওঠায় ধানের অপচয় বেশি হবে। রবি ফসলের ক্ষেত্রে ভুট্টা, ডাল-জাতীয় শস্য ও শর্ষে লাগানো দেরি হয়ে যাবে। ফসল লাগাতে দেরি হলে পরে বোরো ফসল লাগাতেও দেরি হয়ে যাবে।

অধ্যাপক পারভেজ আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালীন সবজি যাঁরা দেরিতে লাগাচ্ছেন, তাঁদের চারা নষ্ট হয়ে যাবে। আগাম যাঁরা আবাদ করেছেন, অতিবৃষ্টির কারণে পচে যাবে এবং রোগবালাই ও পোকার আক্রমণও বাড়বে। সব মিলিয়ে ধান, রবি শস্য ও শীতকালীন সবজি—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে অসময়ের বৃষ্টির কারণে।

কৃষক শাম্মত আলী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে মরিচ বুনছিলাম। বৃষ্টিতে সব পইচ্চা গেছে। আমার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সব গাইব হয়ে গেছে। আষাঢ় মাসেও এমন বৃষ্টি হয় না, যে বৃষ্টি হইছে। এমন বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছিন না। এমন সময়ে ছিডাছাডা বৃষ্টি হইলেও এমন বৃষ্টি আর কখনো হয় নাই।’

গতকাল শনিবার রাত আড়াইটা থেকে রোববার সকাল ৬টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলায় ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ময়মনসিংহ আবহাওয়া কার্যালয়ের উচ্চ পর্যবেক্ষক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৪টা ২৫ মিনিট থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

ময়মনসিংহ শহরের দীঘারকান্দা এলাকার লাল মিয়া বলেন, ‘২ কাডা জমিতে শাকসবজি করছিলাম। বৃষ্টিতে সব ক্ষতি হইয়া গেছে। এমন টাইমে তো বৃষ্টি হয় না।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বর মাসের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় সবজি লাগানো কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে। শর্ষে আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বৃষ্টির কারণে লাগাতে দেরি হলে অর্জন কিছুটা কম হবে। এখন শর্ষে আবাদের ভালো সময়। এ সময় শর্ষের বীজ বুনতে না পারলে আবাদ কমে যাবে। বৃষ্টি কয়েক দিনের মধ্যে থেমে গেলে তেমন ক্ষতি হবে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ