৪৪ বছর পর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া মা কেন কোরীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলেন
Published: 25th, May 2025 GMT
১৯৭৫ সালের মে মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে নিজেদের বাড়িতে মেয়েকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন হান তে-সুন। মেয়ে কিয়ং-হা তখন শিশু। বয়স মাত্র চার বছর।
সেদিনের কথা মনে করে হান তে–সুন বলেন, ‘আমি বাজারে যাচ্ছিলাম। কিয়ং-হাকে বললাম, তুই চল না? কিন্তু সে জবাব দিল, “না, আমি বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাচ্ছি।” ফিরে এসে দেখি ও নেই।’
এরপর চার দশকের বেশি কেটে যায়। হান আর মেয়েকে খুঁজে পাননি। অবশেষে ২০১৯ সালে মা-মেয়ের পুনর্মিলন হয়। তবে তত দিনে বয়স বেড়ে মধ্যবয়সী নারীতে পরিণত হয়েছেন কিয়ং-হা। তিনি তখন মার্কিন নাগরিক হিসেবে পরিচিত। তাঁর কিয়ং–হা নামটিও নেই। সেটি বদলে রাখা হয়েছে লরি বেন্ডার।
হানের অভিযোগ, মেয়ে কিয়ং-হাকে তাঁদের বাড়ির কাছ থেকেই অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর তাঁকে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেন সেখানকার একটি পরিবার তাঁকে লালন–পালন করতে পারে। তিনি গত বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মেয়ের অবৈধ দত্তক প্রক্রিয়া ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে এ মামলা করেছেন তিনি।
শুধু হান নন—সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত মানুষ দক্ষিণ কোরিয়ার বিতর্কিত বিদেশি দত্তক কর্মসূচির বিরুদ্ধে ভয়ানক সব অভিযোগ এনেছেন। এর মধ্যে আছে জালিয়াতি, অবৈধ দত্তক, অপহরণ ও মানব পাচারের মতো অভিযোগ।
হানের অভিযোগ, মেয়ে কিয়ং-হাকে তাঁদের বাড়ির কাছ থেকেই অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর তাঁকে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেন সেখানকার একটি পরিবার তাঁকে লালন–পালন করতে পারে। হান গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।এত দীর্ঘ সময় ধরে এবং এত বিপুল সংখ্যায় শিশুদের বিদেশে দত্তক দেওয়ার নজির বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। ১৯৫০-এর দশকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ শিশুকে বিদেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিশুকে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঠানো হয়।
চলতি বছরের মার্চ মাসে এক তদন্তে দেখা যায়, যথেষ্ট নজরদারি না করে দক্ষিণ কোরিয়ার একেকটি সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। তারা নজরদারি না করায় বেসরকারি সংস্থাগুলো শিশুদের গণহারে বিদেশে পাঠিয়েছে। লাভের আশায় শিশুদের পণ্যের মতো করে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ তদন্তের ফলাফল দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলার পথ খুলে দিতে পারে। হান আগামী মাসে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ মামলা দুটি যুগান্তকারী মামলার একটি। হান হলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম কোনো জন্মদাতা অভিভাবক, যিনি তাঁর সন্তানকে বিদেশে দত্তক পাঠানোর ঘটনায় দেশটির সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাইছেন। এর আগে ২০১৯ সালে দত্তক শিশু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া এক ব্যক্তি দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিদেশে দত্তক হওয়া কারও পক্ষ থেকে মামলা করার ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিবার–পরিজনকে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণায় ভোগা ব্যক্তিদের প্রতি সরকার গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করছে।
সরকার আরও বলেছে, তারা হানের মামলাকে ‘গভীর অনুশোচনাবোধের’ সঙ্গে বিবেচনা করছে। মামলার রায়ের ভিত্তিতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
৭১ বছর বয়সী হান বিবিসিকে বলেন, সরকারকে এ ঘটনার দায় নিতে হবে।
হান বলেন, ‘আমি ৪৪ বছর ধরে মেয়েকে উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে ফিরেছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ কি একবারও আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে? না, একবারও না।’
আমি ৪৪ বছর ধরে মেয়েকে উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে ফিরেছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ কি একবারও আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে? না, একবারও না। —হান তে–সুন, দক্ষিণ কোরীয় মাকয়েক দশক ধরে হান তে-সুন ও তাঁর স্বামী মেয়ের খোঁজ পেতে থানায় থানায় ছুটেছেন, অনাথ আশ্রমে গেছেন, মেয়ের সন্ধান চেয়ে শহরের অলিগলিতে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়েছেন, এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমেও নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে তথ্য চেয়েছেন।
হান বলেন, তিনি দিনের পর দিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মেয়েকে খুঁজেছেন। এতটাই হেঁটেছেন যে পায়ের নখগুলো খসে পড়েছিল।
১৯৯০ সালে এক টিভি অনুষ্ঠানের পর এক নারী হানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যাঁকে দেখে হান মনে করেছিলেন এটাই তাঁর মেয়ে কিয়ং-হা। তিনি সেই নারীকে কিছুদিন নিজের বাড়িতে এনে রাখেন। পরে সেই নারী স্বীকার করেন, তিনি আসলে হানের মেয়ে নন।
২০১৯ সালে হান ‘৩২৫ কামরা’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। সংগঠনটি বিদেশে দত্তক হিসেবে পাঠানো কোরীয় সন্তানদের ডিএনএ মিলিয়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের কাজ করে। আর এতে হানের জন্য নতুন এক পথ খুলে যায়।
ডিএনএ পরীক্ষায় লরি বেন্ডারের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়, যিনি ক্যালিফোর্নিয়ার একজন নার্স। কয়েক দফায় হানের সঙ্গে ফোনালাপের পর লরি কোরিয়ায় আসেন। সিউলের বিমানবন্দরে ঘটে মা-মেয়ের আবেগঘন পুনর্মিলন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হান তাঁর চুলে হাত বোলাতে থাকেন।
এই মামলা দুটি যুগান্তকারী মামলার একটি। হান হলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম কোনো জন্মদাতা অভিভাবক, যিনি তাঁর সন্তানকে বিদেশে দত্তক পাঠানোর ঘটনায় দেশটির সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাইছেন। এর আগে ২০১৯ সালে দত্তক শিশু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া এক ব্যক্তিও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।হান বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে চুল কাটার কাজ করি। চুল ছুঁয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারি, এটা আমার মেয়ের চুল কি না। আমি একবার ভুল করে ভেবেছিলাম তাঁকে পেয়েছি। তাই এবার তাঁর চুল স্পর্শ করে নিশ্চিত হতে চেয়েছি।’
মেয়েকে দেখে হানের প্রথম কথাই ছিল, ‘আমি অনেক দুঃখিত।’
হান বলেন, শৈশবে তাঁর মেয়ে যে বাড়িতে থাকতে পারেনি, সে জন্য নিজেকে তাঁর দোষী মনে হয়। মেয়ে তাঁর মাকে কতটাই না খুঁজে বেড়াচ্ছে তা নিয়ে ভাবতেন তিনি। এত বছর পর মেয়েকে দেখে মনে হলো, মায়ের জন্য কতটাই–না ভালোবাসা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছিলেন।
বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া আগের এক সাক্ষাৎকারে হান মেয়েকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে তৈরি হওয়া একটি ফুটো সেরে গেছে। এখন আমি নিজেকে পরিপূর্ণ একজন মানুষ মনে করছি।’
পুনর্মিলনের পর মা-মেয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন যে ১৯৭৫ সালের মে মাসে নিখোঁজ হওয়ার দিনটিতে আসলে কী ঘটেছিল।
ঘটনার দিন কিয়ং-হা বাড়ির কাছে খেলছিলেন। অপরিচিত এক নারী তাঁর কাছে এসে বলেন যে তিনি তাঁর মাকে চেনেন। ওই নারী কিয়ং-হাকে আরও বলেন যে তাঁর মায়ের আর তাঁকে দরকার নেই। এরপর ওই নারী কিয়ং হা-কে একটি রেলস্টেশনে নিয়ে যান। নারীর সঙ্গে ট্রেনে করে একটি গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তাঁকে সেখানে ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠায়। কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় এক দম্পতির কাছে দত্তক শিশু হিসেবে পাঠানো হয়।
অনেক বছর পর কিয়ং-হা জানতে পারেন, তাঁর নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে তাঁকে পরিত্যক্ত অনাথ হিসেবে দেখানো হয়—যার মা–বাবার পরিচয় জানা নেই।
এর আগে সাক্ষাৎকারে কিয়ং-হা এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘এটা যেন এক মিথ্যা জীবন কাটানো, যা কিছু জানা ছিল, তার কিছুই সত্য নয়।’
তবে শুধু কিয়ং-হার ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেনি, দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন ঘটনা আরও দেখা যায়।
এশিয়া থেকে পশ্চিমে ‘শিশু ব্যবসা’
দক্ষিণ কোরিয়ার বৈদেশিক দত্তক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫০-৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশটিতে তখন আনুমানিক এক লাখ শিশু অনাথ ও বাস্তুচ্যুত ছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন সমাজে দত্তক নেওয়ার প্রবণতা খুব কম থাকায় সরকার তখন ‘মানবিক উদ্যোগ’ হিসেবে বৈদেশিক দত্তক কার্যক্রম শুরু করে।
এ কর্মসূচি পরিচালনার পুরোপুরি দায়িত্ব ছিল বেসরকারি দত্তক সংস্থার হাতে। যদিও তখন সরকারিভাবে এসব সংস্থার ওপর নজরদারি ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আইনগত সুবিধার ভিত্তিতে সংস্থাগুলোর ক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যায়।
চার দশকের বেশি সময় ধরে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে বেড়িয়েছেন হান তে-সুন.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব র দ ধ র সরক র র ২০১৯ স ল হ ন বল ন পর ব র ন র পর প রথম র একট একব র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ঠুমরির জলসা’তে নজরুলকে নিবেদন
ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবন মিলনায়তনে এক সুরেলা সন্ধ্যার আবাহনে অনুষ্ঠিত হলো সংগীতানুষ্ঠান ‘ঠুমরির জলসা’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থার এই আয়োজন যেন হয়ে উঠেছিল এক নিটোল শ্রদ্ধার্ঘ্য। নজরুলের সংগীতভান্ডার থেকে বাছাই করা ঠুমরি ও রাগভিত্তিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শ্রোতারা পেলেন সুর ও বাণীর এক অপার অনুভব।
কাহারবা তালের একটি ঠুমরি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সন্ধ্যার আসর শুরু করেন মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া। এরপর দাদরা তালে নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন ঐশ্বর্য সমদ্দার। কাহারবা তালে মোহি খানের কণ্ঠে ‘পরান প্রিয়! কেন এলে অবেলায়/ শীতল হিমেল বায়ে ফুল ঝরে যায়’ গানটি শ্রোতামনে সঞ্চার করে এক বিষণ্ন আবহ। রাগ পাহাড়ি ঠুমরি আঙ্গিকের একটি গান পরিবেশন করেন টিংকু শীল।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থার এই আয়োজন যেন হয়ে উঠেছিল এক নিটোল শ্রদ্ধার্ঘ্য। আয়োজকদের সৌজন্যে