কাদামাটি: শিকড়ের খোঁজে এক আবেগভরা মঞ্চভ্রমণ
Published: 10th, July 2025 GMT
জাগরণী থিয়েটার সাভারের ২১তম প্রযোজনা ‘কাদামাটি’ একক কোনো প্রবাসীর কাহিনি নয়, বরং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী বাঙালির অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা ও শিকড়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষার বহুস্বরী নাট্যরূপ। অনিকেত পালের রচনায় এবং দেবাশীষ ঘোষের নির্দেশনায় নাটকটি হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে এক আবেগী মঞ্চভ্রমণ। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র অতনু; যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এক প্রবাসী বাঙালি। নিজের শৈশবের গ্রাম, মায়ের স্নেহ, বাবার মমতা, কৈশোরের প্রেম মৌরীর স্মৃতিগুলো তাঁর ভেতরে ফিরে ফিরে আসে। নিজের সন্তান যখন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বড় হয়ে উঠছে, অতনুর মনে দ্বন্দ্ব জাগে, সে কি তার শিকড় হারিয়ে ফেলছে? অতনুর আত্মকথন যেন হয়ে ওঠে সহস্র প্রবাসী বাঙালির একসঙ্গে বলা গল্প। নাটকটি আবেগ, স্মৃতি এবং বাস্তবতার মোহনায় দাঁড়িয়ে, প্রবাসী জীবনের মানসিক অভিঘাত এবং স্বদেশের প্রতি গভীর আকর্ষণকে মেলবন্ধন করেছে মাটি, মানুষ ও সময়ের প্রতীকী ভাষায়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়–মানুষ যত দূরেই যাক, তার ভেতরকার মাটি কখনও শুকায় না, বরং তা থেকে প্রতিনিয়ত জন্ম নেয় চেতনার নতুন শাখা-প্রশাখা। ‘কাদামাটি’ সেই অভ্যন্তরীণ চেতনাকেই মঞ্চে রূপ দেয়, এক নিঃসঙ্গ অথচ বহুভাষিক আত্মপরিচয়ের শিল্পিত পুনর্বিবেচনায়।
‘কাদামাটি’ নাটকের পাণ্ডুলিপি এক অন্তর্মুখী আবেগযাত্রা, যেখানে প্রবাসে বসবাসকারী এক ব্যক্তির ভেতরে লুকিয়ে থাকা শিকড়ের টান, পারিবারিক সম্পর্কের স্মৃতি ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন ঘুরেফিরে উঠে আসে। অনিকেত পালের রচনায় এই নাটক শুধুই একটি কাহিনি নয়, বরং এক ধরনের আত্মকথন; যা কখনও ব্যক্তিগত, কখনওবা গোটা প্রজন্মের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। অতনুর চরিত্রটি যেন প্রবাসী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যে নিজের অতীতকে ভুলতে পারে না, আবার সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের চেষ্টাতেও বিভ্রান্ত। এই দ্বৈত বোধ নাটকের মূল আবহ তৈরি করে এবং দর্শককে তার সঙ্গে এক মানসিক সংলাপে যুক্ত করে ফেলে।
নির্দেশনাকাণ্ডে পাণ্ডুলিপিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন নির্দেশক দেবাশীষ ঘোষ। তিনি মঞ্চে আবেগী স্মৃতিকাতরতামুখর সুদর্শন এক দৃশ্যকাব্য এঁকেছেন। পাণ্ডুলিপির সীমাবদ্ধতাকে তিনি চমৎকার করে অতিক্রম করে গেছেন।
পাণ্ডুলিপির কাঠামো মূলত স্মৃতি ও আত্মকথনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায়, নাটকটির নাট্যগত বৈচিত্র্য আনাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নির্দেশক স্মৃতি আর বর্তমান সময়ের ছায়াপথে নাটককে ভ্রমণ করিয়েছেন এমনভাবে, যেখানে দর্শক কখনও অতনুর অতীতের গ্রামে হাঁটে, আবার কখনও যুক্তরাষ্ট্রের একাকী জীবনের অলিগলি যুক্ত হয়ে যায় অনায়াসে। তিনি দৃশ্য বিন্যাস, আলো, আবহসংগীত এবং চরিত্র-বিন্যাসের সমন্বয়ে এমন কিছু মুহূর্ত তৈরি করেছেন, যা দর্শকের মনে দীর্ঘস্থায়ী আবেগ তৈরি করে।
নির্দেশকের বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি নাটকের আবেগকে কখনও অতিনাটকীয় করেননি, বরং প্রতীকী ব্যবহার দিয়ে তা ব্যক্তিগত অনুভবে রূপান্তর করেছেন। ‘কচুপাতা’, ‘জোনাকি’, ‘কাদামাটি’র গন্ধ ইত্যাদি উপাদান নাটকের অনুভবকে জাগ্রত করেছে দর্শকের মনোজগতে। একক অভিনয়নির্ভর নাটকে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা সবসময়ই কঠিন, কিন্তু দেবাশীষ ঘোষ নিজের নির্দেশনায় সেই চ্যালেঞ্জটিকে গ্রহণ করে তা পার করতে পেরেছেন শিল্পসম্মত উপায়ে। পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে যদি আবেগ-ব্যঞ্জনার ভারসাম্য, সংলাপের গতি ও নাট্যঘনত্বের দিকগুলোতে আরও যত্ন নেওয়া হয়, তাহলে ‘কাদামাটি’ শুধু একটি আবেগনির্ভর নাট্য প্রযোজনা নয়, বরং হয়ে উঠতে পারে এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আত্মপরিচয়ের নাট্যনির্মাণ।
‘কাদামাটি’ নাটকে স্মরণ সাহা একক অভিনয়ের ভার যথাযথভাবে বহন করেছেন, যা নাটকের আবেগ ও ভাবনাকে জীবন্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর উপস্থিতি নাটকের মূল সুরের সঙ্গে দর্শকদের জুড়ে রাখে। বিশেষ করে স্মৃতিদৃশ্যগুলোতে তাঁর অভিনয় মাটির গন্ধ, শিকড়ের অনুভূতি এবং নস্টালজিয়ার আবেগ ফুটিয়ে তুলেছে। ‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি’ গান গাইতে দর্শকদের সঙ্গে তাঁর অংশগ্রহণ করানো মুহূর্তটি মঞ্চকে আরও প্রাণবন্ত করেছে এবং দর্শককে নাটকের সঙ্গে আবদ্ধ করে রেখেছে।
জাগরণী থিয়েটারের ‘কাদামাটি’ শুধু একটি একক নাট্যপ্রযোজনা নয়, এটি প্রবাসী জীবনের নস্টালজিয়া, আত্মপরিচয়ের সংকট এবং শিকড়ের সন্ধানে এক আবেগময় শিল্পভ্রমণ। অনিকেত পালের রচনায় এবং দেবাশীষ ঘোষের সংবেদনশীল নির্দেশনায় এই নাটক হয়ে উঠেছে এক ধরনের আত্মজিজ্ঞাসার মঞ্চ। স্মরণ সাহার একক অভিনয় নাটকের প্রাণ, আর পলাশ হেনড্রি সেন ও রামিজ রাজুর কারিগরি পরিকল্পনা দর্শন অভিজ্ঞতাকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ। যদিও কিছু কারিগরি ও ব্যাকরণগত দিক আরও যত্ন দাবি করে, তবু ‘কাদামাটি’নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ নাট্যউপস্থাপনা, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়–শিকড় কখনও মুছে যায় না, বরং তা হৃদয়ে থেকে যায় জীবনের সর্বত্র।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রব স জ বন র ন টক র ভ রমণ
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকায় ডিপ ফ্রিজ থেকে গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার
ঢাকার কলাবাগান এলাকায় একটি বাসার ডিপ ফ্রিজ থেকে তাসলিমা আক্তার (৪২) নামে এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পলাতক রয়েছেন তার স্বামী নজরুল ইসলাম।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালে কলাবাগান থানার অফিসার ইনচার্জ( ওসি) মো. ফজলে আশিক রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, দাম্পত্য কলহের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নিহতের স্বামী নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে প্রকৃত কারণ জানা যেতে পারে।”
এ ঘটনায় তাসলিমা আক্তারের এক স্বজন বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, খবর পেয়ে সোমবার রাতে কলাবাগান ফার্স্ট লেনের একটি ভবন থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ওই বাসায় গিয়ে তালা ভেঙে ডিপ ফ্রিজে মুখ বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ আরো জানায়, মাথায় ভারী বা ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা করা হয়েছে। ফলে মাথার হাড় ভেঙে খুলি বের হয়ে গেছে।
তাসলিমা আক্তারের মেয়ে বলেন, “বাবা আম্মুকে সন্দেহ করতেন। ভাবতেন তার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিল এবং খারাপ কাজ করে টাকা উপার্জন করতো। কিন্তু আমার মা তেমন বাইরেই যেতেন না। আমার বাবা নেশা করতো। অধিকাংশ সময় বাইরে থেকে নেশা করে ঘরে ফিরত, কখনও কখনও বাসায় এসেও নেশা করতো। বাবাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মাকে হত্যা করেছে।”
মাকে হারিয়ে তার হত্যার বিচার চেয়ে তাসলিমার মেয়ে বলেন, “আমরা চাই, বাবার ফাঁসি হোক।”
নিহতের চাচাতো ভাই বলেন, “মাঝে মাঝেই আমার বোন দুলাইভায়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো। বোনকে মারধর করত। প্রায় বাবার বাড়ি চলে যেত।”
ঢাকা/এমআর/ইভা