সড়কের ওপর জনতার ভিড়। পাশের বিলের মধ্যে নানা বয়সী নারী-পুরুষের জটলা। সেখান থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ হচ্ছে—‘নোনাপানির পক্ষে যারা, উপকূলের শত্রু তারা’। নারীরা ঝাড়ু উচিয়ে ধরে বলছেন, ‘নোনাপানি তুলতে এলে মুখে দেব ঝাঁটার বাড়ি।’ গতকাল সোমবার সন্ধ্যার দিকে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা নয়ানী গ্রামের সড়কের পাশের বিলের মধ্যে এমন চিত্র দেখা যায়।

ঘটনা সম্পর্কে জানতে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই আমজাদ গাজী নামের একজন এগিয়ে এসে বললেন, কয়েক দিন ধরে এখানে বেশ উত্তেজনা চলছে। এই বিলে মোট ২ হাজার ৪০০ বিঘা জমি আছে। পুরো জমিতে প্রায় ২৫ বছর নদীর নোনাপানি তুলে চিংড়িঘের হয়েছে। তবে গত বছর থেকে জমির মালিকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নোনাপানির ঘের বন্ধ করে ধান চাষ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে অল্প কিছু লোক পুনরায় নোনাপানির ঘের করতে চাচ্ছেন। তাঁরা বহিরাগত কিছু মানুষ ডেকে এনে ঘেরের জন্য মাটির খননকাজ শুরু করায় এলাকার মানুষ প্রতিবাদ করতে এসেছেন।

নয়ানী গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মনি শঙ্কর রায় বলেন, ‘এলাকার লোকজন আবার কৃষিকাজ করতে চান। এ কারণে আমরা লোকালয়ের মধ্যে নোনাপানি তোলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। তারপরও এলাকার অল্প কয়েকজন বাঁধ কেটে আবারও নোনাপানি তোলার পাঁয়তারা করছে। অথচ এক বছর আগে জমির মালিকেরা লবণপানি না তোলার লিখিত অঙ্গীকারপত্র জমা দিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদে। এখন অল্প কয়েকজন মিলে পুনরায় ঘের চালু করতে চাচ্ছেন।’

সড়ক থেকে নেমে বিলের মধ্যে মানুষের জটলার কাছে গিয়ে বোঝা গেল, স্থানীয় বাসিন্দারা বেশ উত্তেজিত। ফিরোজ হোসেন নামের একজন বলেন, ‘গত ২৫ বছরের মধ্যে ধানের মুখ চোখে দেখিনি। গত বছর থেকে নিজেদের জমিতে ধান দেখে চোখ জুড়িয়েছি। এখন এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করে ভেকু মেশিন (এক্সকাভেটর) দিয়ে মাটি কেটে পুনরায় নোনাপানির ঘের তৈরির পাঁয়তারা করছে কিছু মানুষ। আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে দিনভর বিলের মধ্যে অবস্থান নিয়েছি। গ্রামের নারী-পুরুষের প্রতিবাদের মুখে ঘের তৈরির জন্য আনা খননযন্ত্র বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বহিরাগত লোকজন। আমরা জান দেব, তবু এই কৃষি জমিতে আর নোনাপানি তুলতে দেব না।’

এলাকার লোকজন আবার কৃষিকাজ করতে চান। এ কারণে আমরা লোকালয়ের মধ্যে নোনাপানি তোলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। তারপরও এলাকার অল্প কয়েকজন বাঁধ কেটে আবারও নোনাপানি তোলার পাঁয়তারা করছে।মনি শঙ্কর রায়, নয়ানী গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য

গ্রামীণ চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার সরদার নামের একজন বলেন, ‘লবণের বিরুদ্ধে এবার সবাই এক ছিল। আমরা আবার ফসলের স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু এলাকার কৃষিজমিতে বহিরাগত কিছু মানুষ নদী থেকে নোনাপানি লোকালয়ে ঢুকিয়ে চিংড়িঘের করতে চেষ্টা করছেন। এলাকার মিঠাপানির খালেও লোনাপানি তোলা হয়েছে। চলতি বছরে ওই খালের পানি দিয়ে আমরা কৃষিকাজ করেছি। আমরা সাধারণ মানুষ নোনাপানি থেকে বাঁচতে চাই।’

সরেজমিনে কয়রার নয়ানী গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কয়রা নদী। নদী পেরোলেই সুন্দরবন। নদীর তীর ধরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বেড়িবাঁধের রাস্তা। রাস্তার পাশে বিশাল বিলজুড়ে ধান লাগানো হয়েছিল বলে গাছের গোড়ার অংশ পড়ে আছে। বেড়িবাঁধের রাস্তা ধরে সামনে অগ্রসর হলে চোখে পড়ে বাঁধ ছিদ্র করে বসানো কয়েকটি পাইপ। পাইপের মুখ মাটি দিয়ে আটকে দেওয়া। এক বছর আগে যখন বিলে চিংড়িঘের ছিল, তখন ওই পাইপ দিয়ে নদীর লোনাপানি ঢুকানো হতো ঘেরে।

স্থানীয় বাসিন্দা লিপিকা জোয়ার্দার, শুলতা মণ্ডল, চিন্তা বাইন, দেবলা বৈদ্যসহ কয়েকজন জানান, বেড়িবাঁধ কেটে ও পাইপ বসিয়ে নদী থেকে চিংড়িঘেরে লবণপানি তোলার ব্যবস্থা করেন ঘেরমালিকেরা। এতে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ে। অল্প জোয়ারেও বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এর আগে লবণপানি খেয়ে গবাদিপশুও মারা গেছে। এই নোনাপানির ঘেরের কারণে লবণাক্ততা বাড়লে মানুষ পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। এ জন্য তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে বিলের মধ্যে এসেছেন।

সুন্দরবন–সংলগ্ন নয়ানী গ্রামটি কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের আওতাধীন। ওই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, ‘আমাদের এলাকার ৯৭ শতাংশ মানুষ নোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ চায় না। চিংড়িতে লাভ নেই। তাই সবার প্রতিশ্রুতিতে নোনামুক্ত সবুজ পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি। কিন্তু বহিরাগত প্রভাবশালীরা তাদের লাভের জন্য হাজার হাজার মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। সম্প্রতি তাঁরা নদীর বেড়িবাঁধ কেটে ঘেরে নোনাপানি ঢুকানোর চেষ্টা করলে স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দিয়েছেন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অল প ক এল ক র কজন ব

এছাড়াও পড়ুন:

দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা

সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।

আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’

তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’

আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’

ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।

ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’

পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।

গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।

তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।

জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।

দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স
  • নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির