পূর্ব যুগে মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ধরন
Published: 10th, May 2025 GMT
কায়রোর বাজারে হঠাৎ স্তব্ধতা। দোকানিরা তাঁদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন, রাস্তায় জনতার গুঞ্জন। তাঁরা শাসকের অত্যধিক করের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডেকেছেন। এই দৃশ্য মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজের একটি পরিচিত চিত্র। ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুধু ন্যায়বিচারের দাবি ছিল না, বরং এটি সমাজের গতিশীলতা ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক ছিল। এই পর্বে আমরা প্রতিবাদের বিভিন্ন কারণ—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং এর ধরন—মিছিল, ধর্মঘট, প্রতীকী প্রতিবাদ, সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করব। দেখব কীভাবে এই প্রতিবাদগুলো মুসলিম সমাজকে গড়ে তুলেছিল।
প্রতিবাদের কারণ
ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবাদের কারণগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। জনগণ শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেনি, বরং তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো রক্ষার জন্যও রাস্তায় নেমেছে। এখানে প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।
অর্থনৈতিক কারণ: অত্যধিক কর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা খাদ্যসংকট মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের অন্যতম কারণ ছিল। ৩৯৮ হিজরি সনে (১০০৭-০৮ খ্রি.
রাজনৈতিক কারণ: শাসকদের নীতি, প্রশাসকদের অবিচার বা উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক প্রায়ই প্রতিবাদের কারণ হতো। উমাইয়া যুগে মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (৬০২-৬৮০ খ্রি.) তাঁর পুত্র ইয়াজিদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেন। এই সিদ্ধান্ত সাহাবাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। আবদুর রহমান বিন আবু বকর (মৃ. ৬৬৬ খ্রি.) বলেন, ‘এটি আবু বকর বা উমরের পদ্ধতি নয়, বরং রোমান সম্রাটদের পদ্ধতি।’ (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৪/১৮৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)
ধর্মীয় কারণ: ধর্মীয় বিষয়ে শাসকদের সিদ্ধান্ত বা উলামা সমাজকে নিপীড়নের কারণে প্রতিবাদ হতো। আব্বাসীয় যুগে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) কোরআনের সৃষ্টতা (মিহনা) নিয়ে খলিফা আল-মামুনের (৭৮৬-৮৩৩ খ্রি.) নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি কারারুদ্ধ হলেও তাঁর সমর্থকেরা বাগদাদে সমাবেশ করে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর মুক্তি দাবি করেন। (ইবনে আল-জাওজি, মানাকিবুল ইমাম আহমদ, পৃ. ৩১২)
সামাজিক কারণ: দাসপ্রথা বা সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের মতো সামাজিক অবিচারের কারণে প্রতিবাদ জেগে উঠত। ২৬৯ হিজরি সনে (৮৮২-৩ খ্রি.) বাসরায় জান্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) নামে একটি প্রতিবাদ হয়, যেখানে দাস ও নিম্নবর্গের মানুষ অবিচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। যদিও এই আন্দোলন পরে সহিংস হয়, তবে এর সূচনা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯/৪৫৬)
আরও পড়ুনবিরে আরিস: আংটির কুয়ার গল্প০৬ মে ২০২৫প্রতিবাদের ধরন: সৃজনশীলতার প্রকাশ
মুসলিম সমাজে প্রতিবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এই রূপগুলো শুধু জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেনি, বরং তাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। এখানে প্রধান কয়েকটি ধরন আলোচনা করা হলো।
মিছিল: মিছিল ছিল প্রতিবাদের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। আব্বাসীয় যুগে বাগদাদে জনগণ প্রায়ই খলিফার প্রাসাদের দিকে মিছিল করত। ২২৮ হিজরি সনে (৮৪২-৩ খ্রি.) খলিফা আল-ওয়াসিকের (মৃ. ৮৪৭ খ্রি.) নীতির বিরুদ্ধে বাগদাদের বাজার থেকে একটি মিছিল শুরু হয়। এই মিছিলে উলামা, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ একত্রে অংশ নেন। তাঁরা কোরআন হাতে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের দাবি তুলে ধরেন। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০/২৮৯)
ধর্মঘট: ধর্মঘট ছিল অর্থনৈতিক প্রতিবাদের শক্তিশালী মাধ্যম। ফাতেমীয় মিসরে ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অত্যধিক করের বিরুদ্ধে দোকান বন্ধ করে ধর্মঘট ডাকতেন। ৪১৪ হিজরি সনে (১০২৩-৪ খ্রি.) কায়রোর বাজারে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকে খলিফা আল-জাহিরের (মৃ. ১০৩৬ খ্রি.) কাছে তাঁদের দাবি পেশ করেন। এই ধর্মঘট শহরের অর্থনীতি স্থবির করে দেয় এবং খলিফাকে কর কমাতে বাধ্য করে। (আল-মাকরিজি, ইত্তিআজুল হুনাফা, পৃ. ১৮৭)
প্রতীকী প্রতিবাদ: প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল মুসলিম সমাজের সৃজনশীলতার প্রকাশ। রুটির প্রতিবাদ ছাড়াও আব্বাসীয় যুগে জনগণ প্রায়ই খালি পাত্র বা কালো পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ করত। ২৫০ হিজরি সনে (৮৬৪-৫ খ্রি.) বাগদাদে খাদ্যসংকটের সময় জনগণ খালি পাত্র নিয়ে মসজিদে জড়ো হয় এবং দোয়া করে। এই প্রতীকী প্রতিবাদ খলিফা আল-মুস্তাইনকে (মৃ. ৮৬৬ খ্রি.) খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে বাধ্য করে। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯/৫১২)
সমাবেশ: মসজিদে বা বাজারে সমাবেশ ছিল প্রতিবাদের আরেকটি রূপ। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের সমর্থনে বাগদাদে মসজিদে সমাবেশ এর উদাহরণ। এই সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণ ছিল এবং প্রায়ই উলামার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।
ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবাদ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে উদ্ভূত হয়েছে। মিছিল, ধর্মঘট, প্রতীকী প্রতিবাদ ও সমাবেশের মাধ্যমে জনগণ তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছে। এই প্রতিবাদগুলোর মাধ্যমে ন্যায়বিচারের জন্য মুসলিম সমাজের প্রচেষ্টাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। পরবর্তী পর্বে আমরা প্রতিবাদের ফলাফল এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে
আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
১৬ বছরে যারা মজলুম ছিল, আজকে অনেকেই জালেম হয়ে উঠছে: নুরুল হক নুর
ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেছেন, ‘গত ১৬ বছরে যারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, মজলুম ছিল; আজকে অনেকেই জালেম হয়ে উঠছে। বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মানুষের ওপরে জুলুম-নির্যাতন এমনকি অন্য দলের লোক এলাকায় থাকতে হলে তাঁদের কাছ থেকে মাসোহারা নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ এটা করেছিল। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ যে পুরোনো মডেলের রাজনীতি ছুড়ে ফেলেছিল, এক বছর পর আমরা আবার সেই ফ্যাসিবাদের আলামত দেখতে পাচ্ছি।’
আজ সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরের বাটার মোড়ে গণ অধিকার পরিষদের জেলা ও মহানগর কমিটি আয়োজিত এক গণসমাবেশে এই মন্তব্য করেন নুরুল হক। সমাবেশে দলটির মহানগর কমিটির আহ্বায়ক আনোয়ার ইকবাল বাদলের সভাপতিত্বে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
সমাবেশে প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতি নিয়ে নুরুল হক বলেন, দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন আনুপাতিক হারে নির্বাচন চায়। এর মাধ্যমেই একটি কার্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ গঠন করা সম্ভব। বর্তমান পদ্ধতিতে ৩০০ আসনে ৩০০ জন এমপি নির্বাচিত হন। এই ৩০০ আসন নিয়ে হবে নিম্নকক্ষ, যাঁরা এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন। এর পাশাপাশি একটি উচ্চকক্ষ থাকবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল সারা দেশে মোট যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই হার অনুযায়ী উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধি থাকবে। এই ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোও সংসদে তাদের কথা বলার সুযোগ পাবে, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।
জুলাই সনদ প্রসঙ্গে নুরুল হক বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের কোনো কার্যকর রূপরেখা পাওয়া যায়নি। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যদি জুলাই সনদে না থাকে, তাহলে আপনাদের বিরুদ্ধেও আমরা রাজপথে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।’