কায়রোর বাজারে হঠাৎ স্তব্ধতা। দোকানিরা তাঁদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন, রাস্তায় জনতার গুঞ্জন। তাঁরা শাসকের অত্যধিক করের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডেকেছেন। এই দৃশ্য মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজের একটি পরিচিত চিত্র। ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুধু ন্যায়বিচারের দাবি ছিল না, বরং এটি সমাজের গতিশীলতা ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক ছিল। এই পর্বে আমরা প্রতিবাদের বিভিন্ন কারণ—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং এর ধরন—মিছিল, ধর্মঘট, প্রতীকী প্রতিবাদ, সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করব। দেখব কীভাবে এই প্রতিবাদগুলো মুসলিম সমাজকে গড়ে তুলেছিল।

প্রতিবাদের কারণ

ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবাদের কারণগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। জনগণ শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেনি, বরং তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো রক্ষার জন্যও রাস্তায় নেমেছে। এখানে প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।

অর্থনৈতিক কারণ: অত্যধিক কর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা খাদ্যসংকট মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের অন্যতম কারণ ছিল। ৩৯৮ হিজরি সনে (১০০৭-০৮ খ্রি.

) ফাতেমীয়রা মিসরে রুটির দুষ্প্রাপ্যতা ও নিম্নমানের বিরুদ্ধে জনগণ একটি অভিযোগপত্র পাঠায়, যার সঙ্গে তারা একটি রুটিও যুক্ত করে দেয়। রুটিটি ছিল তাদের দুর্দশার প্রতীক। এই প্রতিবাদ ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিম বিআমরিল্লাহর (৯৮৫-১০২১ খ্রি.) দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি বাজারে রুটির সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশ দেন। (আল-মাকরিজি, ইত্তিআজুল হুনাফা, পৃ. ১২৫, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৭০)

রাজনৈতিক কারণ: শাসকদের নীতি, প্রশাসকদের অবিচার বা উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক প্রায়ই প্রতিবাদের কারণ হতো। উমাইয়া যুগে মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (৬০২-৬৮০ খ্রি.) তাঁর পুত্র ইয়াজিদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেন। এই সিদ্ধান্ত সাহাবাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। আবদুর রহমান বিন আবু বকর (মৃ. ৬৬৬ খ্রি.) বলেন, ‘এটি আবু বকর বা উমরের পদ্ধতি নয়, বরং রোমান সম্রাটদের পদ্ধতি।’ (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৪/১৮৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)

ধর্মীয় কারণ: ধর্মীয় বিষয়ে শাসকদের সিদ্ধান্ত বা উলামা সমাজকে নিপীড়নের কারণে প্রতিবাদ হতো। আব্বাসীয় যুগে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) কোরআনের সৃষ্টতা (মিহনা) নিয়ে খলিফা আল-মামুনের (৭৮৬-৮৩৩ খ্রি.) নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি কারারুদ্ধ হলেও তাঁর সমর্থকেরা বাগদাদে সমাবেশ করে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর মুক্তি দাবি করেন। (ইবনে আল-জাওজি, মানাকিবুল ইমাম আহমদ, পৃ. ৩১২)

সামাজিক কারণ: দাসপ্রথা বা সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের মতো সামাজিক অবিচারের কারণে প্রতিবাদ জেগে উঠত। ২৬৯ হিজরি সনে (৮৮২-৩ খ্রি.) বাসরায় জান্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) নামে একটি প্রতিবাদ হয়, যেখানে দাস ও নিম্নবর্গের মানুষ অবিচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। যদিও এই আন্দোলন পরে সহিংস হয়, তবে এর সূচনা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯/৪৫৬)

আরও পড়ুনবিরে আরিস: আংটির কুয়ার গল্প০৬ মে ২০২৫

প্রতিবাদের ধরন: সৃজনশীলতার প্রকাশ

মুসলিম সমাজে প্রতিবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এই রূপগুলো শুধু জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেনি, বরং তাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। এখানে প্রধান কয়েকটি ধরন আলোচনা করা হলো।

মিছিল: মিছিল ছিল প্রতিবাদের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। আব্বাসীয় যুগে বাগদাদে জনগণ প্রায়ই খলিফার প্রাসাদের দিকে মিছিল করত। ২২৮ হিজরি সনে (৮৪২-৩ খ্রি.) খলিফা আল-ওয়াসিকের (মৃ. ৮৪৭ খ্রি.) নীতির বিরুদ্ধে বাগদাদের বাজার থেকে একটি মিছিল শুরু হয়। এই মিছিলে উলামা, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ একত্রে অংশ নেন। তাঁরা কোরআন হাতে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের দাবি তুলে ধরেন। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০/২৮৯)

ধর্মঘট: ধর্মঘট ছিল অর্থনৈতিক প্রতিবাদের শক্তিশালী মাধ্যম। ফাতেমীয় মিসরে ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অত্যধিক করের বিরুদ্ধে দোকান বন্ধ করে ধর্মঘট ডাকতেন। ৪১৪ হিজরি সনে (১০২৩-৪ খ্রি.) কায়রোর বাজারে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকে খলিফা আল-জাহিরের (মৃ. ১০৩৬ খ্রি.) কাছে তাঁদের দাবি পেশ করেন। এই ধর্মঘট শহরের অর্থনীতি স্থবির করে দেয় এবং খলিফাকে কর কমাতে বাধ্য করে। (আল-মাকরিজি, ইত্তিআজুল হুনাফা, পৃ. ১৮৭)

প্রতীকী প্রতিবাদ: প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল মুসলিম সমাজের সৃজনশীলতার প্রকাশ। রুটির প্রতিবাদ ছাড়াও আব্বাসীয় যুগে জনগণ প্রায়ই খালি পাত্র বা কালো পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ করত। ২৫০ হিজরি সনে (৮৬৪-৫ খ্রি.) বাগদাদে খাদ্যসংকটের সময় জনগণ খালি পাত্র নিয়ে মসজিদে জড়ো হয় এবং দোয়া করে। এই প্রতীকী প্রতিবাদ খলিফা আল-মুস্তাইনকে (মৃ. ৮৬৬ খ্রি.) খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে বাধ্য করে। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯/৫১২)

সমাবেশ: মসজিদে বা বাজারে সমাবেশ ছিল প্রতিবাদের আরেকটি রূপ। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের সমর্থনে বাগদাদে মসজিদে সমাবেশ এর উদাহরণ। এই সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণ ছিল এবং প্রায়ই উলামার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।

ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবাদ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে উদ্ভূত হয়েছে। মিছিল, ধর্মঘট, প্রতীকী প্রতিবাদ ও সমাবেশের মাধ্যমে জনগণ তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছে। এই প্রতিবাদগুলোর মাধ্যমে ন্যায়বিচারের জন্য মুসলিম সমাজের প্রচেষ্টাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। পরবর্তী পর্বে আমরা প্রতিবাদের ফলাফল এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে 

আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার দাবি নাগরিক কোয়ালিশনের

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দাবি জানিয়েছে নাগরিক কোয়ালিশন। শনিবার কোয়ালিশনের এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কোয়ালিশন। বিবৃতিতে এই কোয়ালিশন বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়াত সম্মেলনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। দেশের কিছু বড় ও মূলধারার রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে ভোটের প্রতিযোগিতায় তুষ্টিবাদী রাজনীতির অংশ হিসেবে আহমদিয়াদের প্রতি বিষোদ্‌গার করছে। এটি খুবই আশঙ্কাজনক ব্যাপার।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুরোধ করছি, এই সংকটকালে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন যেকোনো গোষ্ঠীর ব্যাপারে উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে; বিশেষ করে যারা ধর্মকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।’

দেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই সংবিধানে আহমদিয়াদের ধর্ম পালনের অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রয়েছে বলে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য এই অধিকার রক্ষায় আমরা অবিচল থাকব।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং ধর্মীয় পরিচয়–নির্বিশেষে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা বিষয়ে সরব থাকা। আমরা বিশ্বাস করি, এই মৌলিক সাম্যই হতে হবে জুলাই ২০২৪–পরবর্তী বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর।’

আরও পড়ুনখতমে নবুওয়তের মহাসম্মেলন থেকে ১ দফা দাবিতে বছরজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা৮ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একই দিনে নির্বাচন-গণভোট সঠিক পদক্ষেপ: হাফিজ উদ্দিন আহমদ
  • বিএনপির প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক আটকে বিক্ষোভ
  • সিলেটে মোটরসাইকেলে এসে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা
  • সিলেটে মধ্যরাতে অ্যাম্বুলেন্স ও বাসে আগুন
  • আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার দাবি নাগরিক কোয়ালিশনের
  • বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংসদে আলোচনা করে কাদিয়ানিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত: সালাউদ্দিন
  • শেখ হাসিনা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসক: মেজর (অব.) হাফিজ
  • কুতুবদিয়ায় পুকুরে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু
  • বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধানে 'মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনর্বহাল করা হবে : সালাহউদ্দিন আহমদ
  • বিদ্রূপের আরশিতে প্রতিফলিত ইতিহাস