পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ব্যয় পরিবীক্ষণ জরুরি
Published: 17th, May 2025 GMT
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার নারীর অগ্রগতি, উন্নয়ন ও নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্র নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন, নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ সরকার নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় একটি বহুস্তরীয় কাঠামো স্থাপন করেছে।
নারীর অগ্রগতি নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব কেবল মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নয় বরং এটি সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের যৌথ দায়িত্ব। নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ক.
নীতিনির্ধারণে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর অধীনে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া চালু হয়। প্রাথমিকভাবে চারটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে–মন্ত্রণালয়গুলোর বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ জেন্ডার সংবেদনশীল কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ, নারী-উন্নয়ন ও নারী-পুরুষের সমতার অর্জনে সুনির্দিষ্ট বাজেট-বরাদ্দ এবং বাজেট বাস্তবায়নের ফলাফল ও প্রভাব সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে এই বাজেট বরাদ্দ শুরু হয়ে, ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ৩৪.৩৭ শতাংশ এবং জিডিপির ৫.২৩ শতাংশ জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ হয়। জেন্ডার বাজেট কার্যকর করতে এর সুষ্ঠু ব্যবহার, কার্যকর নজরদারি ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটিং প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত রিকারেন্ট, ক্যাপিটাল, জেন্ডার অ্যান্ড পভার্টি (আরসিজিপি) মডেল পরবর্তী সময়ে আইবিএএস++ এর সঙ্গে একীভূত করা হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইবিএএস++ এর আওতায় নতুন জেন্ডার ফাইন্যান্স ট্র্যাকিং মডেল প্রবর্তিত হয়েছে, যাতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক বাজেট থেকে জেন্ডার সম্পর্কিত বরাদ্দ পৃথক করা যায়। মডেলটি প্রযুক্তিগতভাবে প্রশংসিত হলেও এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন এখনও সম্পন্ন হয়নি।
জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটিং এখনও অনুমিত মানবণ্টনের ওপর নির্ভরশীল, যার ফলে বাজেট বরাদ্দে অসামঞ্জস্য ও বিশ্লেষণে বিভ্রান্তি হতে পারে। মানবণ্টনের মানসম্পন্ন পদ্ধতি না থাকায় মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যাখ্যায় অসংগতি দেখা দেয়। নারী-পুরুষ বিভাজিত তথ্যের অভাবে বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি করে।
অনেক মন্ত্রণালয় জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটিংকে শুধু প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক বা দায়সারা পদক্ষেপ হিসেবে দেখে। সংশোধিত বাজেটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেটের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল ব্যয় না হওয়া বা কমে যাওয়া একটি সাধারণ বিষয়। যেমন– ২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ২৫৯,৬৯০.৯০ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট কমে দাঁড়ায় ২,৩৮,১৮৮ কোটি টাকায়– যা প্রায় ৮ শতাংশ কম। সংশোধিত বাজেটে জেন্ডার বাজেটের অর্থ অন্য খাতে স্থানান্তরিত হওয়ায় জেন্ডার সংবেদনশীল কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারী অধিকার সংগঠনগুলো বাজেটের প্রকৃত ব্যয় অনুসরণের দাবি জানালেও অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবে জেন্ডার বাজেটিংয়ের অংশ হিসেবে ব্যয়ের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে সুপারিশ করেছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় জানা গেছে যে, আইবিএএস++ সিস্টেমে প্রয়োজনীয় কোড প্রবর্তনের মাধ্যমে এ ধরনের ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব।
পরিশেষে, জেন্ডার বাজেটকে অর্থবহ করতে হলে এটিকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। খাতুন, নওরিন, কবির ও নীলর্মী (২০২৩) প্রস্তাব করেছেন যে বর্তমান জেন্ডার বাজেট কাঠামোতে চারটি মূল স্তম্ভ অন্তর্ভুক্ত করে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। এগুলো হলো– লিঙ্গ বিভাজিত তথ্যের ব্যবহার, বাজেটসংক্রান্ত বিষয়ে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাজেট ব্যয়ের উন্নত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং বর্ধিত অর্থ সংগ্রহ ও যথাযথ ব্যবহার। এ চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে বাজেটের প্রক্রিয়া ও ব্যবহার হবে নারীবান্ধব ও ফলপ্রসূ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ন ড র স ব দনশ ল ব জ ট প র ষ র সমত ন শ চ ত কর ব যবহ র বর দ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রযুক্তি ব্যবহারে আজও পিছিয়ে নারীরা
তথ্যপ্রযুক্তির প্রায় সব বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে। এর মধ্যে নারীর অবস্থান আরও পেছনে। দেশে পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে ৫৮ শতাংশ, সেখানে নারীর মাত্র ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা মাত্র ২৪ শতাংশ। গ্রামের নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত না করা গেলে ডিজিটাল অগ্রগতি সমাজে নতুন বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো– ‘ডিজিটাল রূপান্তরে নারী-পুরুষের সমতায়ন’।
বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস শুরুর পেছনে রয়েছে টেলিগ্রাফের সম্পৃক্ততা। ১৮৬৫ সালের ১৭ মে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ কনভেনশনের মাধ্যমে গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন’। পরবর্তী সময়ে এটি রূপ নেয় আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ)। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৭ মে আন্তর্জাতিকভাবে পালন শুরু করে আইটিইউ। দিবসটি উপলক্ষে শুক্রবার দেওয়া এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, টেলিযোগাযোগ সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারসহ ডিজিটাল রূপান্তরে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ একটি বৈষম্যমুক্ত ও আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত। নারী উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিংসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পিছিয়ে নারী
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ফাইভজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন এবং আইওটি প্রযুক্তি শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নয়ন ঘটায়নি, বরং কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাণিজ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীরা এ ক্ষেত্র অনেক পেছনে রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে এই বৈষম্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
আইটিইউর ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস ২০২৪’ অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশ পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে নারীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। এর মানে, ১৮ কোটি ৯০ লাখ পুরুষ নারীদের চেয়ে বেশি অনলাইনে রয়েছেন। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় বৈষম্য আরও প্রকট, সেখানে মাত্র ২৯ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে পুরুষদের হার ৪১ শতাংশ।
বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে এমন বৈষম্য দেখা যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর পিছিয়ে থাকার চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে, দেশে শহুরে নারীদের ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। গ্রামে এই সংখ্যা ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। যেখানে পুরুষের মোবাইল ব্যবহারের হার ৮৬ শতাংশের বেশি।
গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) ‘মোবাইল ব্যবহারে লৈঙ্গিক পার্থক্য-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেট সম্পর্কে জানলেও তা ব্যবহার করেন না। কারণ, তাদের মধ্যে শিক্ষা ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব রয়েছে।
ই-কমার্সসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ‘শি পাওয়ার’ ও ‘হার পাওয়ার’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এসব উদ্যোগ খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। সরকারি হিসাব বলছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে যারা পড়াশোনা করে, তাদের ২৯ শতাংশ নারী। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মাত্র ১২ শতাংশ নারী তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যাদের অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কর্মী। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অবস্থান ১ শতাংশেরও কম। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিতে নারী উদ্যোক্তা ২ শতাংশেরও কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নরীদের দক্ষ করে গড়ে না তোলায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী কম। প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ যত বাড়বে, বৈষম্য তত কমবে। প্রযুক্তি খাতে নারীকে এগিয়ে নিতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।