বস্তায় লবণের দাম বেড়েছে ৩০০ সিন্ডিকেটকে দুষছেন ব্যবসায়ী
Published: 18th, May 2025 GMT
দেশের বড় চামড়ার মোকামগুলোর একটি নাটোর শহরের চকবৈদ্যনাথ। বর্তমানে এখানে কাঁচা চামড়ার স্বাভাবিক সরবরাহ নেই। তিন সপ্তাহ পর কোরবানির ঈদ। তখন সরবরাহ বাড়বে। এতে প্রয়োজন হবে প্রচুর লবণের। এ সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনই বাড়ছে লবণের দাম। ঈদের আগেই কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের প্রধান এ উপকরণের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
শহরে দুই শতাধিক চামড়ার ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের ভাষ্য, এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি লবণের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। বেড়েছে অন্তত ৩০০ টাকা। যদিও লবণ ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চকবৈদ্যনাথ মোকামে দেশের ৩৬ জেলা থেকে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া আসে। লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাতের পর চার মাস এসব সংরক্ষিত থাকে। এ সময়ে চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ লবণ। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্য ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। তাদের কাছে মৌসুমি ব্যবসায়ী, ঈদের কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারী এবং আড়তদার জিম্মি। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। জেলায় চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতিও রয়েছে।
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম সিদ্দিকীর ভাষ্য, গত এপ্রিল মাসে তিনি ৫০ বস্তা লবণ ১০ টাকা কেজি দরে কেনেন। ৭০ কেজির বস্তা ৭০০ থেকে ৭১০ টাকায় ছিল। গত শনিবার সেই বস্তা কিনেছেন এক হাজার টাকা দরে। ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে পাঁচ-ছয় টাকা। এক বস্তায় অন্তত ৩০০ টাকা বেড়েছে।
ঈদ সামনে রেখে কয়েকজন লবণ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে নাটোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ আব্দুল হালিমের। তারা ইচ্ছেমতো দাম বেঁধে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এ জন্য দায়ী সিন্ডিকেট। জেলায় নজরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, রাকিব ও দীলিপ চক্রবর্তী লবণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, এক মাস আগে ৭০ কেজির এক বস্তা লবণ বিক্রি হয়েছে ৬৮০ থেকে ৭২০ টাকা। বর্তমানে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের দু-একদিন আগে এ দাম এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা হওয়ার শঙ্কা চামড়া ব্যবসায়ীদের। বাজারে তেমন কাঁচা চামড়া নেই জানিয়ে ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, এখন তেমন লবণের প্রয়োজন হচ্ছে না। অথচ দাম এক হাজার টাকা করার জন্য দায়ী সিন্ডিকেটও ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর জেলায় কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা পাঁচ লাখ ১৪ হাজার। নাটোর বিসিক থেকে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে অন্তত ১৩ লাখ টন লবণের প্রয়োজন হবে। এ চাহিদার মাত্র ৬০ শতাংশ মজুত আছে।
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সায়দার খান বলেন, এক মাস আগের চেয়ে এখন লবণের দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ কোনো দুর্যোগ বা অতিরিক্ত চাহিদা নেই। সিন্ডিকেটের কারণে দুই শতাধিক ব্যবসায়ী জিম্মি। চামড়া ব্যবসায় এমনিতেই লোকসান হচ্ছে।
যদিও লবণের দাম স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি জেলার শীর্ষ লবণ ব্যবসায়ী একতা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী দীলিপ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, বস্তাপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। কোরবানির মৌসুমে নিয়মিত চামড়ার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও লবণ মজুত করেন। এতে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় দাম বাড়ে। ঈদের আগে সারাদেশেই লবণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়তে থাকে।
অতিরিক্ত দামের ব্যাপারে আরেক ব্যবসায়ী রাকিব হোসেনের কাছে প্রশ্ন করতেই তিনি আর লবণ বিক্রি করছে না বলে দাবি করেন। বিসিকের প্রমোশন অফিসার কিশোর কুমার সরকার বলেন, বাজারের ওপর চাপ কমাতে ও দাম কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে এতিমখানা ও মাদ্রাসাগুলোয় চামড়া সংরক্ষণে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল হায়াত বলেন, চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের দাম কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১০ টাকা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এটি পালন হচ্ছে কিনা, তদারকি করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: লবণ লবণ র দ ম ব যবস য় র ক রব ন র এক হ জ র স রক ষ ন লবণ লবণ ব
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রাম মেডিকেলে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট, কিনে দিতে হয় ক্যানুলা, সিরিঞ্জও
মো. নাজমুলের স্ত্রী কাজল বেগম চার দিন ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩ নম্বর প্রসূতি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। প্রতিদিনই তাঁকে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী ক্যানুলা, সিরিঞ্জ ইত্যাদি কিনতে হয়। সঙ্গে গজ–ব্যান্ডেজ, ইউরিন ব্যাগ, কিছু ওষুধপত্রও কিনতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নাজমুলের সঙ্গে কথা হয় হাসপাতালের নিচতলায় ন্যায্যমূল্যের দোকানের সামনে। এ সময় তিনি কিছু চিকিৎসাসামগ্রী কিনে প্রসূতি বিভাগে ফিরছিলেন।
নাজমুল বিল দেখিয়ে বলেন, ‘আমার স্ত্রী গর্ভপাত–সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছে। আজ ৯৭৭ টাকার ওষুধপত্র কিনেছি। গতকাল কিনেছিলাম ৮০০ টাকার। প্রতিদিনই কিনতে হচ্ছ। সামান্য সিরিঞ্জ, ক্যানুলা—সবকিছু বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীর তীব্র সংকট চলছে। মাসখানেক ধরে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সিরিঞ্জ, হ্যান্ড গ্লাভস, ক্যানুলাসহ জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী কিনে আনতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। কখনো কখনো এ নিয়ে স্বজনদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের।
আমার স্ত্রী গর্ভপাত–সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছে। আজ ৯৭৭ টাকার ওষুধপত্র কিনেছি। গতকাল কিনেছিলাম ৮০০ টাকার। প্রতিদিনই কিনতে হচ্ছ। সামান্য সিরিঞ্জ, ক্যানুলা—সবকিছু বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে।মো. নাজমুলহাসপাতাল সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে–পরে বেশ কিছুদিন সময়মতো দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। যাঁরা আগে চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করতেন, তাঁরাও সময়মতো তা দিতে পারেননি। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমান সংকটের মূল কারণ ঠিকাদারেরা কিছু সামগ্রীতে অস্বাভাবিক মূল্য দাবি করছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আগের দামের ১০ শতাংশের বেশি মূল্যে সামগ্রী কিনতে পারে না। যার জন্য চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাসামগ্রীর কার্যাদেশ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই এক মাসের বেশি সময় ধরে সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ২ হাজার ২০০ শয্যার। কিন্তু এখানে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগী থাকে। হাসপাতালে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ ক্যানুলা, ৫০ হাজার ইউরিন ব্যাগ, ৮ লাখ সিরিঞ্জ দরকার হয়। বর্তমানে চাহিদার ২৫ শতাংশের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি ওয়ার্ডেই সংকট চলছে। মেডিসিন, শিশুস্বাস্থ্য, সার্জারি, নিউরোসার্জারি, অর্থোপেডিক, প্রসূতি বিভাগে এসব সামগ্রীর ব্যবহার বেশি হয়।
বাঁশখালীর শাহীন সুলতানা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মাসখানেক ধরে অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। ভর্তির পর থেকে কিছু ওষুধপত্র হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী কিনে নিতে হচ্ছে দোকান থেকে। শাহীনের মা তাহেরা বেগম ওষুধের ব্যাগ হাতে বিভাগে ঢুকছিলেন। তিনি বলেন, দু দিন পরপর ইনজেকশন, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন ইত্যাদি কিনতে হয়। গতকাল এক হাজার টাকার ওষুধপত্র কিনেছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমান সংকটের মূল কারণ ঠিকাদারেরা কিছু সামগ্রীতে অস্বাভাবিক মূল্য দাবি করছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আগের দামের ১০ শতাংশের বেশি মূল্যে সামগ্রী কিনতে পারে না। যার জন্য চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাসামগ্রীর কার্যাদেশ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই এক মাসের বেশি সময় ধরে সংকট আরও তীব্র হয়েছে।বিষয়টি স্বীকার করে অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রসহ নানা জটিলতায় সরবরাহ ঘাটতি হলে কিছু সামগ্রী বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আবার সরবরাহ ঠিক হলে সংকট কেটে যায়।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস খালেদ জানান, তাঁদের বিভাগে ২০ ও ২২ সাইজের আইভি ক্যানুলার সংকট রয়েছে। রোগীর স্বজনদের এগুলো নিয়ে আসতে হচ্ছে।
কয়েক মাস ধরে সিরিঞ্জ আইভি ক্যানুলা ছাড়া আমরা দরপত্রের কার্যাদেশ দিচ্ছি। আমাদের শতাধিক সামগ্রী একসঙ্গে দরপত্র দিতে হয়। একক সামগ্রী দরপত্র করার উপায় নেই। তাই শতাধিক সামগ্রীর মধ্যে যেসব বেশি চলে, সেগুলোর দাম তারা (ঠিকাদারেরা) বেশি দিয়ে রেখেছে। যার কারণে আমরা নিতে পারি না। ১০ শতাংশের বেশি দরে নিলে অডিট আপত্তির মুখে পড়তে হবে।হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীনএ সংকটের কারণে হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দুটি দোকানেও ভিড় দেখা গেছে। রোগীর স্বজনেরা ওষুধ ও জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য চাহিদাপত্র (স্লিপ) নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা মাত্র সিরিঞ্জ নিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছিলেন মো. আলমগীর। তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রী কাউছার বেগম প্রসূতি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। একটা সিরিঞ্জের জন্য পঞ্চমতলা থেকে নিচে এসেছেন তিনি। এটা নিয়ে গেলে ইনজেকশন দেবে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে সিরিঞ্জ আইভি ক্যানুলা ছাড়া আমরা দরপত্রের কার্যাদেশ দিচ্ছি। আমাদের শতাধিক সামগ্রী একসঙ্গে দরপত্র দিতে হয়। একক সামগ্রী দরপত্র করার উপায় নেই। তাই শতাধিক সামগ্রীর মধ্যে যেসব বেশি চলে, সেগুলোর দাম তারা (ঠিকাদারেরা) বেশি দিয়ে রেখেছে। যার কারণে আমরা নিতে পারি না। ১০ শতাংশের বেশি দরে নিলে অডিট আপত্তির মুখে পড়তে হবে।’
হাসপাতালের পরিচালক আরও বলেন, এ কারণে সিরিঞ্জ, আইভি ক্যানুলা ছাড়া কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। তাই সংকট হচ্ছে কিছুটা। তবে এই জিনিসগুলোর দাম কম। তারপরও কীভাবে সমাধান করা যায় চেষ্টা করা হচ্ছে।