পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আরও বেশি চালাক ব্যক্তিদের নিয়োগের পরামর্শ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের
Published: 24th, May 2025 GMT
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থনীতি যে পরিমাণ সৃষ্টিশীল সে তুলনায় অনেক সময় পেরে উঠতে পারছে না বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাজার খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি চালাক, অন্তত নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আরও বেশি চালাক ব্যক্তিদের দায়িত্ব না দিলে বাজারের অনিয়ম ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
আজ শনিবার ঢাকার নিকুঞ্জে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কার্যালয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার: দর্শন ও অনুশীলন' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধকার হিসেবে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
নির্ধারিত আলোচক ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো.
দেশের পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা বুঝতে ইতিহাসের দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ বাজারে যত কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের মাধ্যমে। ২০১০-১১ সময়ে এ বাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বিদেশে। অথচ এর কোনো উপযুক্ত বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণ হচ্ছে, তখন যেভাবে মামলা করার দরকার ছিল সেভাবে তা হয়নি। তখন মামলার প্রক্রিয়াই করা হয়েছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না দেওয়াটাকেই সমস্যার মূল বলে মনে করেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, শাস্তি না হলে দুর্নীতি রোধ করা যায় না। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শেয়ারবাজারে অনিয়ম হয়েছে। তখন হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়। তখনো কোনো বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণে ২০১০-১১ সময়ের পরও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যাঁরা অনিয়ম করেছেন তাঁদের কেউ কেউ এখন জেলে। যদিও তা অন্য কারণে। পুঁজিবাজারে অনিয়মের কারণে কেউ শাস্তি পাননি। এটা ছিল পাপের সূত্রপাত। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সঞ্চয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, বিনিয়োগ ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুঁজিবাজার- এটাই বিশ্বে চলে আসছে; কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সে ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, পুঁজিবাজারে যাঁদের যে ভূমিকা তা তাঁরা পালন করেননি। দেবপ্রিয়র প্রশ্ন, ‘তাঁরা কি সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছেন? আমার দৃষ্টিতে পারছেন না।’
শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে চাঁদা (আইপিও) সংগ্রহ বন্ধ। সূচকে হয়েছে বড় ধরনের পতন। ফলে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দুর্বল হয়েছে পুঁজিবাজার এবং ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, পুঁজিবাজার দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান। দিন এনে দিন খাওয়া—এটা এ প্রতিষ্ঠানের চরিত্র না। সামনে বাজেট। টোটকা ওষুধ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এখন সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বড় উদ্যোগ নেওয়া এবং সর্বজনস্বীকৃত একটি প্যাকেজ দরকার।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক: ভিয়েতনাম কেন শূন্য শুল্ক দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে, বাংলাদেশের গরজ কতটা
বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে কোন দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো, রপ্তানি-নির্ভর দেশগুলো। এ পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হবে, চীন অনেক আগেই তা অনুমান করতে পেরেছিল। সে কারণে তারা অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে আসছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।
সেদিক থেকে বাংলাদেশ একধরনের সুবিধাজনক পর্যায়ে আছে। বাস্তবতা হলো, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পণ্য ও বাণিজ্যিক সেবা রপ্তানির শতকরা হিসাবে গত কয়েক বছর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের সারিতে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। ২০১০ সালের পর আমরা মাত্র এক ধাপ এগিয়েছি।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ অনুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি জিডিপির অনুপাত ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি সত্ত্বেও ২০১০ সালের পর এই অনুপাত কমেছে। জিডিপিতে বাণিজ্যিক পরিষেবা রপ্তানির হিস্যা শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হলেও পণ্য রপ্তানি ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।
গত ৯ জুলাই ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কযুদ্ধের বিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাঠামোগত চুক্তি করতে পেরেছে; বাংলাদেশ পারেনি। ফলে গত সোমবার ট্রাম্প যে কয়টি দেশের শুল্ক পুনর্নির্ধারণ করে চিঠি দিয়েছেন, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।
বিশেষ করে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। তারা কেন চুক্তি করতে পারল, বাংলাদেশ কেন পারল না। বাস্তবতা হলো, ভিয়েতনামের রপ্তানি বছরে ৪০০ বিলিয়ন বা ৪০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা রপ্তানি করি মাত্র ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের। ভিয়েতনাম কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি করে ১১০ বিলিয়ন বা প্রায় ১১ হাজার কোটি ডলারের। এটি মোট রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ। আমাদের মাত্র ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। যা মোট রপ্তানির ১৭ শতাংশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আর রপ্তানি ভিয়েতনামের জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে তারা শূন্য শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাজারে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে ২০ শতাংশ। যে বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের পুরোপুরি মিল নেই, যদিও রপ্তানি কমে গেলে অর্থনীতি ধাক্কা খাবে, তা নিশ্চিত।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ অনুসারে, ভিয়েতনামের জিডিপি রপ্তানির অনুপাত প্রায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ৯০ শতাংশই আসছে রপ্তানি থেকে। এ অনুপাত অনেক বেশি। ফলে রপ্তানির বাজার তাদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের জিডিপি বা অর্থনীতি রপ্তানি দিয়ে চলে না; বরং আমাদের আমদানি বেশি। অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের চেয়ে সেবা খাতের অবদান বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিসেবা রপ্তানির মতো জটিল পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।
অর্থনৈতিক যুক্তি থেকে দেখা যাচ্ছে, এ চুক্তি করতে ভিয়েতনামের যতটা গরজ, বাংলাদেশের গরজ ততটা হবে না। সে কারণে ভিয়েতনাম অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে তৎপর। বাংলাদেশ বরং গত ২ এপ্রিলের পর তৎপর হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় ঘাটতি ছিল।
রপ্তানি খাতের অবদান একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। তবে রপ্তানি খাতের অবদান কত থাকা উচিত—এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট একক বা সর্বজনীন মান নেই। এটি নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো, উৎপাদন ক্ষমতা, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের ওপর।
ভিয়েতনামের অর্থনীতি মূলত রপ্তানি–নির্ভর