ছোট একটি গ্রন্থির বড় বিপদ আর বড় সম্ভাবনার কথা
Published: 25th, May 2025 GMT
২৫ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব থাইরয়েড দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘থাইরয়েড রোগ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের হস্তক্ষেপের ফলে যেমন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত হয়েছে, তেমনি থাইরয়েড রোগ নির্ণয়ে এর কার্যকর ব্যবহার এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচিত বিষয়।
আমাদের শরীরে গলার সামনের দিকে ছোট একটি প্রজাপতির মতো দেখতে গ্রন্থি থাইরয়েড অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে। এটি দেহের বিপাকক্রিয়া, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ এবং হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নিয়ে মানুষের সচেতনতা এখনো হতাশাজনকভাবে কম।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশেও চিত্রটি ভয়াবহ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত, কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই জানে না যে তারা এই রোগে ভুগছে। কারণ, এই রোগের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং রোগীরা তা সাধারণ ক্লান্তি বা ওজনবৃদ্ধির মতো হালকাভাবে নেয়।
বিশেষ করে নারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। নবজাতকের মধ্যে জন্মগতভাবে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জন্ম–পরবর্তী শিশুর বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়তে হলে গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা ও তা নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিশুর জন্মের পরপর থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
থাইরয়েডজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম (যেখানে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হয়), হাইপারথাইরয়ডিজম (যেখানে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হয়), গলগণ্ড বা গলার ফোলা, নডিউল এবং থাইরয়েড ক্যানসার। নডিউলগুলোর বেশির ভাগই নিরীহ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নডিউল ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশে আয়োডিন ঘাটতির কারণে এই ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি।
এত দিন পর্যন্ত এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অপারেশনই ছিল প্রধান চিকিৎসাপদ্ধতি। কিন্তু এতে থাকে জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। অপারেশনের ফলে গলায় স্থায়ী দাগ, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, ক্যালসিয়াম ভারসাম্যহীনতা এবং আজীবন হরমোন ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া—এসবই রোগীর জীবনমানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এ প্রেক্ষাপটে চিকিৎসাক্ষেত্রে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) প্রযুক্তি যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি একেবারেই ন্যূনতম হস্তক্ষেপমূলক, আধুনিক ও নিরাপদ চিকিৎসাপদ্ধতি, যা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই শুধু আক্রান্ত টিস্যু ধ্বংস করে। আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে থাইরয়েড নডিউলের অবস্থান চিহ্নিত করে সুচের মাধ্যমে তাপশক্তি প্রয়োগ করে টিস্যুকে ধ্বংস করা হয়, কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থির অবশিষ্ট অংশ অক্ষত থাকে।
এ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি মাত্র ৩০–৪০ মিনিটেই সম্পন্ন হয় এবং রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় না। গলায় কোনো দাগ পড়ে না, অপারেশনের প্রয়োজন নেই এবং অধিকাংশ রোগী পরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা অক্ষত থাকায় আজীবন হরমোন সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বিশ্বব্যাপী আরএফএ প্রযুক্তি চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমি নিজে দক্ষিণ কোরিয়ার এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক, বিখ্যাত অধ্যাপক জে এইচ বেক–এর অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং বর্তমানে রাজধানীর মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক কার্ডিয়ায়াক সেন্টার এবং ফুলবাড়িয়া এলাকায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে এই আধুনিক চিকিৎসা প্রদান করছি।
থাইরয়েড রোগ যেমন নীরবে শরীরের নানা অঙ্গকে প্রভাবিত করে, তেমনি একে উপেক্ষা করলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তবে সুখবর হলো, প্রযুক্তির আশীর্বাদ, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং আরএফএর মতো আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে এখন এ রোগকে আগেভাগেই চিহ্নিত ও কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
তাই থাইরয়েড দিবসে আমাদের বার্তা একটাই, ‘ভয় নয় আর, বদলেছে সময়, উন্নত প্রযুক্তি এখন থাইরয়েড সেবায়’।
ডা.
এম কে আজাদ জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড হরম ন থ ইরয় ড গ রন থ
এছাড়াও পড়ুন:
ছোট একটি গ্রন্থির বড় বিপদ আর বড় সম্ভাবনার কথা
২৫ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব থাইরয়েড দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘থাইরয়েড রোগ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের হস্তক্ষেপের ফলে যেমন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত হয়েছে, তেমনি থাইরয়েড রোগ নির্ণয়ে এর কার্যকর ব্যবহার এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচিত বিষয়।
আমাদের শরীরে গলার সামনের দিকে ছোট একটি প্রজাপতির মতো দেখতে গ্রন্থি থাইরয়েড অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে। এটি দেহের বিপাকক্রিয়া, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ এবং হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নিয়ে মানুষের সচেতনতা এখনো হতাশাজনকভাবে কম।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশেও চিত্রটি ভয়াবহ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত, কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই জানে না যে তারা এই রোগে ভুগছে। কারণ, এই রোগের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং রোগীরা তা সাধারণ ক্লান্তি বা ওজনবৃদ্ধির মতো হালকাভাবে নেয়।
বিশেষ করে নারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। নবজাতকের মধ্যে জন্মগতভাবে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জন্ম–পরবর্তী শিশুর বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়তে হলে গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা ও তা নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিশুর জন্মের পরপর থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
থাইরয়েডজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম (যেখানে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হয়), হাইপারথাইরয়ডিজম (যেখানে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হয়), গলগণ্ড বা গলার ফোলা, নডিউল এবং থাইরয়েড ক্যানসার। নডিউলগুলোর বেশির ভাগই নিরীহ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নডিউল ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশে আয়োডিন ঘাটতির কারণে এই ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি।
এত দিন পর্যন্ত এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অপারেশনই ছিল প্রধান চিকিৎসাপদ্ধতি। কিন্তু এতে থাকে জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। অপারেশনের ফলে গলায় স্থায়ী দাগ, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, ক্যালসিয়াম ভারসাম্যহীনতা এবং আজীবন হরমোন ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া—এসবই রোগীর জীবনমানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এ প্রেক্ষাপটে চিকিৎসাক্ষেত্রে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) প্রযুক্তি যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি একেবারেই ন্যূনতম হস্তক্ষেপমূলক, আধুনিক ও নিরাপদ চিকিৎসাপদ্ধতি, যা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই শুধু আক্রান্ত টিস্যু ধ্বংস করে। আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে থাইরয়েড নডিউলের অবস্থান চিহ্নিত করে সুচের মাধ্যমে তাপশক্তি প্রয়োগ করে টিস্যুকে ধ্বংস করা হয়, কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থির অবশিষ্ট অংশ অক্ষত থাকে।
এ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি মাত্র ৩০–৪০ মিনিটেই সম্পন্ন হয় এবং রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় না। গলায় কোনো দাগ পড়ে না, অপারেশনের প্রয়োজন নেই এবং অধিকাংশ রোগী পরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা অক্ষত থাকায় আজীবন হরমোন সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বিশ্বব্যাপী আরএফএ প্রযুক্তি চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমি নিজে দক্ষিণ কোরিয়ার এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক, বিখ্যাত অধ্যাপক জে এইচ বেক–এর অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং বর্তমানে রাজধানীর মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক কার্ডিয়ায়াক সেন্টার এবং ফুলবাড়িয়া এলাকায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে এই আধুনিক চিকিৎসা প্রদান করছি।
থাইরয়েড রোগ যেমন নীরবে শরীরের নানা অঙ্গকে প্রভাবিত করে, তেমনি একে উপেক্ষা করলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তবে সুখবর হলো, প্রযুক্তির আশীর্বাদ, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং আরএফএর মতো আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে এখন এ রোগকে আগেভাগেই চিহ্নিত ও কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
তাই থাইরয়েড দিবসে আমাদের বার্তা একটাই, ‘ভয় নয় আর, বদলেছে সময়, উন্নত প্রযুক্তি এখন থাইরয়েড সেবায়’।
ডা. এম কে আজাদ জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা