গান গাওয়া ও শোনার মাঝের সেতুবন্ধ ও ভাব বিনিময় ছবির মাঝেই সম্ভব। অসীম শূন্যে ধাইছে গানের কথা ও সুরের আবেশে আমি তো ছবি দেখি। এই কল্পলোকের মোহে আমাকে জড়াতে চাই। অন্তত চেষ্টা করি। যদিও ব্যাপারটা ধ্যান ও সাধনার পরিপূরক। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গানের পরিপূর্ণতা হয়ে থাকে বলে আমার ধারণা। রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যা ১৯১৫ ও ছবির সংখ্যা ২৫০০। তবে তিনি বলেছিলেন যা আমার লেখালিখিতে প্রকাশ করিনি তা ছবির মধ্যে প্রকাশ করেছি। তাঁর কোনো প্রথাগত শিল্পকলার শিক্ষা ছিল না বিধায় ছবি আঁকার যে স্বাধীনতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন, তাই তিনি এখনও সমসাময়িক শিল্পী। তদ্রূপ গানেও রাগরাগিণীর নানা রকমের মিশ্রণ ও দেশ-বিদেশের নানান সুরের সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। তিনি কোনো বাধাকেই বাধা মনে করতেন না। পরিবারের ও প্রিয়জনের ভালোবাসার সবাইকে হারিয়ে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন বিশ্বজনকে। শত সমালোচনা সহ্য করার যে ক্ষমতা বিধাতা তাঁকে আশীর্বাদস্বরূপ দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন– আমার গান কেউ ভুলে যেতে পারবে না। তিনি গানের শব্দ চয়নে ও সুরে যে স্বরলিপির মাত্রা প্রয়োগ করেছিলেন তা যথাযথ প্রণিধানযোগ্য ছিল। ভাবের যে ব্যঞ্জনা, সেই সূক্ষ্ম স্পর্শ সুরগুলো না লাগালে অনুভূতিতে আঘাত লাগে। হৃদয়ে ও মন-মাঝে বড় মাপের দাগকাটা সম্ভব না। ছবির যে ইমেজ ক্ষীণ থেকে যায়। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে যে ছবিগুলোর আভাস আমরা দেখতে পাই তা সম্পূর্ণ অন্য জগতে পশুপাখি। বাংলার রূপ ভূদৃশ্য যখন দেখি, সেখানেও এক রহস্যময় আলো-আঁধারের খেলা। মুখমণ্ডলের আদলগুলো যেন তাঁর নিজস্ব ভুবনের অতিথি। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য ছিল ছবি আঁকার মধ্যে; যেমন– রবীন্দ্রনাথের ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ছিলেন। সুনয়না দেবীও ছবি আঁকতেন। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী প্রতিমা দেবীও ছবি আঁকতেন। তাই বলা যায়, এক পরম্পরার পথ দীর্ঘদিন ধরেই চলেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর মাস্টার শিল্পীদের ছবি দেখেছেন, দেখেছিলেন নিজ মাটির ঐতিহাসিক শিল্প। তাঁর চোখ, মনের মাঝারে যে চোখ, তা দিয়ে অবলোকন করতেন। তাঁর যে অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবনা, ছবিতে ও গানের সমান্তরাল ভূমিতে পথে যেতে যেতে চলছে। এ পথের যাত্রী প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে ও চলবে। আমি বিশ্বাস করি, অধিক শিক্ষাগুরু চিবিয়ে খেলেও কিছু হবে না, যদি সে গুরুকে শ্রদ্ধায় রেখে নিজেকে চিনতে না পারে। শুনেছি রবীন্দ্রনাথ এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। গানের সুরের যে নানা বৈচিত্র্য; যেমন– গগন হরকরার গান “আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে” বাউল, কীর্তন, বিদেশি নানান সুরের মিশ্রণ লক্ষ করার মতো; যা রবীন্দ্রনাথের নিজস্বতায় পরিপূর্ণ।
তাঁর ছবি সাধারণভাবেই নিজস্ব, যেমন তাঁর গান। তিনিই ভারতবর্ষের আধুনিক ধারার সাহিত্য, গান ও ছবির প্রথম প্রবর্তক; যা বর্তমান সমসাময়িক সময়েও সমানতালে প্রভাবিত।
ছবি কখন কথা বলে যখন তা ছন্দ ও রঙের হারমোনির ব্যবহারে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। নির্জনতার ধ্বনি শরীরের ধমনিতে ধাক্কা দেয় ধ্যানের আদর্শে, এমনকি কোলাহলের মধ্যে ধ্বনির সুর যেমন শিল্পী শুনতে পায়। রবীন্দ্রনাথ লেখালিখি যখন তখন সব রকম পরিবেশে করতে পারতেন। মনের একান্তে গানের কথা, গানের সুর যে তাঁর মননে চলত, তা কি আমরা প্রকাশ্যে পেতাম? এটা সব শিল্পীর জন্যই এক পথ। তবে করণকৌশলের ভিন্নতায় শিল্পীর আলাদা আলাদা পথ। কেউ গান করে নেচে নেচে ছন্দে আবার কেউ ছবি আঁকে নানা কসরত করে, যার যেমন ভাবের প্রকাশ। আদিম গুহা চিত্রগুলো ইতিহাসের বর্ণনায় দেখি নৃত্যের ছন্দে পশু শিকারের ছবি। আর এখন সেটা পারফর্মিং আর্ট বলি। গান গাওয়াও মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যকর ব্যবহার, তা আমাদের সাধনা ও শিক্ষার দ্বারা আয়ত্তে আনতে হয়। ভালো গান করার প্রথম শর্ত হলো গানটা বোঝা, সুরে সুরে ভাবের সাথে গানের কথার অর্থ অনুধাবন করা। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন আমার গান সুর ও কথার মধ্যে যে সুসম্পর্ক তা যেন তোমরা মেনে চলো। আমি পরিপূর্ণভাবেই তা সাজিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমাদের গায়নশৈলীতে পরিমিত ভাবের হেরফের একটু তো হতে পারে। তাঁর যে গানের ভাব ও অর্থের ছবি, মনের দৃশ্যকল্পে কখনোই এক হবে না। আমি গান ও ছবি সুর ও ছন্দের বন্ধুত্বে বিশ্বাস করি। তাই রবীন্দ্রনাথের গান ও ছবি সবার কাছে গ্রহণীয় হতে হলে তাকে সযত্নে রাখা আমাদের এখন অতীব প্রয়োজন। “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরানসখা বন্ধু হে আমার” গানটি লিখেছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকাকালে। কুঠিবাড়ীর অদূরেই পদ্মা ও গড়াই। যখন মন চায় বজরায় সময় কাটা, ঘুরে বেড়ানোর সাথে নানান জমিদারি কাজ, কিন্তু থেমে থাকে না তাঁর লেখালিখি। কত গান, কাব্য সোনার তরীসহ চিঠিপত্র সাথে ছবি আঁকা। গানটি গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের কিন্তু এখানে বিরহের একটি প্রচ্ছন্ন ছাপ ঝড়ের অনুকূলে বইছে পরানসখার জন্য তিনি কে? প্রভু ও প্রেমিক মিলেমিশে এক অস্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ এমন কী রচনা করলেন, যা নানা মতে বিচার করা যায়। যেমন সহজ, তার চেয়েও কঠিন হলো উপলব্ধির জায়গায় পৌঁছে যাওয়া; যার সীমানাহীন গতিবিধি বন্ধনহীন। তাই তাঁর গান অমর ও অক্ষয়। গান তাঁর ছবি হয় অগোচরে, ঝড়ের হাওয়ায় অনুভূতি জাগায় মনের দৃশ্যকল্পে। ভালোবাসা ও প্রেম, সেই টানে দাঁড়ি টেনেছেন, ধরেছেন শক্তহাতে, মৃত্যুকে প্রেমে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন গানে গানে। “ওরে ভীরু, তোমার হাতে/ নাই ভুবনের ভার/ হালের কাছে মাঝি আছে/ করবে তরী পার/ ওরে ভীরু” কিংবা “এক হাতে ওর কৃপাণ আছে/ আরেক হাতে হার/ ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার”– এ রকম অসংখ্য গানের ছবি তিনি এঁকেছেন হাজার ক্যানভাসে। রবীন্দ্রনাথের প্রেম ভক্তিরসে জাড়িত। প্রকৃতিপ্রেমিক, নারীপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক, সমাজপ্রেমিক ও ধ্যানপ্রেমিক– রবীন্দ্রনাথ সবকিছু এক সুতোয় মালা গেঁথেছেন। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবির পরিচয়ে নন; তাঁর যে ফিলসফি ও ভিশন, তা হলো সব অভিজ্ঞতার সমন্বয়। ছবিতে ও গানে তা স্পষ্টরূপে প্রকাশ হয়েছে। শিল্পী চোখে দেখেন, মগজে নেন, অনুভব করেন, তারপর প্রকাশ করেন বিভিন্ন রসের অনুভবে। তাঁর নিজের ও নারীর প্রতিকৃতি কপি করেননি। এক রহস্য, ভয়, বিরহের বেদনার রূপ দেখতে পাই; যা ভারতীয় রীতি থেকে আলাদা। মোটা রং, আঁধারের যে নিজস্ব অভিব্যক্তি ও আত্মদর্শী, নির্জনতাপ্রিয় বিমূর্ত ও কায়ার ক্ষীণ প্রকাশ তার শিল্পধারার অন্যতম বলে আমি মনে করি। গহন বনে বাতাসে চুল উড়িয়ে বধূ যাচ্ছে। এতে কুঞ্জবনের নানান ফুল, লতাপাতা ও পাখির কূজনে চারিদিকে সুরের ব্যঞ্জনায় সর্বরসের ভাব ও অনুভূতি আমরা উপলব্ধি করি। দৈহিক মিলনের চেয়ে আধ্যাত্মিক প্রেমে রবীন্দ্রনাথের গানে শৃঙ্গার ও ভক্তিরস দেখতে পাই। বিচিত্রা, প্রকৃতি, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, বাউল, কীর্তন ও দেশাত্মবোধক গানে বীর, করুণ, ভক্তি ও শৃঙ্গার রসের প্রভাব দেখতে পাই। গানগুলি ভয় ও বিষাদের কোথাও কোথাও উঁকি দেয়।
“গভীর অরণ্যে বুঝি এলে আবার” ও “কে আসে যায় ফিরে ফিরে” দুটি গান দুই রসের ও ভাবের। মৃত্যু আর প্রেম রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের সঙ্গী ছিল। আবার “ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই/ ভুবনের ভার/ হালের কাছে মাঝি আছে/ করবে তরী পার/ ওরে ভীরু” ও “আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না” তাঁর প্রিয়জনদের মৃত্যুশোক তাঁকে ব্যথিত করেছে কিন্তু হতাশ করেনি। তাঁর ছবিগুলোতে ও গানের ভেতরে বাঁচার অনুসন্ধান করেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ সারাবিশ্বে শান্তি, একতা ও তাঁর ভাবদর্শন ছড়াতে পেরেছেন সার্থকতার সাথে, সেজন্য তিনি বিশ্বমানব হতে শাশ্বত বাঙালি হতে বলেছেন। তাঁর সব কর্মের মধ্যেই আমি অনুভব করি, ধারণ করি, বিশেষত গান ও ছবিতে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর প র
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বকবির গান ও ছবির সম্মিলন
গান গাওয়া ও শোনার মাঝের সেতুবন্ধ ও ভাব বিনিময় ছবির মাঝেই সম্ভব। অসীম শূন্যে ধাইছে গানের কথা ও সুরের আবেশে আমি তো ছবি দেখি। এই কল্পলোকের মোহে আমাকে জড়াতে চাই। অন্তত চেষ্টা করি। যদিও ব্যাপারটা ধ্যান ও সাধনার পরিপূরক। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গানের পরিপূর্ণতা হয়ে থাকে বলে আমার ধারণা। রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যা ১৯১৫ ও ছবির সংখ্যা ২৫০০। তবে তিনি বলেছিলেন যা আমার লেখালিখিতে প্রকাশ করিনি তা ছবির মধ্যে প্রকাশ করেছি। তাঁর কোনো প্রথাগত শিল্পকলার শিক্ষা ছিল না বিধায় ছবি আঁকার যে স্বাধীনতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন, তাই তিনি এখনও সমসাময়িক শিল্পী। তদ্রূপ গানেও রাগরাগিণীর নানা রকমের মিশ্রণ ও দেশ-বিদেশের নানান সুরের সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। তিনি কোনো বাধাকেই বাধা মনে করতেন না। পরিবারের ও প্রিয়জনের ভালোবাসার সবাইকে হারিয়ে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন বিশ্বজনকে। শত সমালোচনা সহ্য করার যে ক্ষমতা বিধাতা তাঁকে আশীর্বাদস্বরূপ দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন– আমার গান কেউ ভুলে যেতে পারবে না। তিনি গানের শব্দ চয়নে ও সুরে যে স্বরলিপির মাত্রা প্রয়োগ করেছিলেন তা যথাযথ প্রণিধানযোগ্য ছিল। ভাবের যে ব্যঞ্জনা, সেই সূক্ষ্ম স্পর্শ সুরগুলো না লাগালে অনুভূতিতে আঘাত লাগে। হৃদয়ে ও মন-মাঝে বড় মাপের দাগকাটা সম্ভব না। ছবির যে ইমেজ ক্ষীণ থেকে যায়। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে যে ছবিগুলোর আভাস আমরা দেখতে পাই তা সম্পূর্ণ অন্য জগতে পশুপাখি। বাংলার রূপ ভূদৃশ্য যখন দেখি, সেখানেও এক রহস্যময় আলো-আঁধারের খেলা। মুখমণ্ডলের আদলগুলো যেন তাঁর নিজস্ব ভুবনের অতিথি। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য ছিল ছবি আঁকার মধ্যে; যেমন– রবীন্দ্রনাথের ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ছিলেন। সুনয়না দেবীও ছবি আঁকতেন। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী প্রতিমা দেবীও ছবি আঁকতেন। তাই বলা যায়, এক পরম্পরার পথ দীর্ঘদিন ধরেই চলেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর মাস্টার শিল্পীদের ছবি দেখেছেন, দেখেছিলেন নিজ মাটির ঐতিহাসিক শিল্প। তাঁর চোখ, মনের মাঝারে যে চোখ, তা দিয়ে অবলোকন করতেন। তাঁর যে অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবনা, ছবিতে ও গানের সমান্তরাল ভূমিতে পথে যেতে যেতে চলছে। এ পথের যাত্রী প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে ও চলবে। আমি বিশ্বাস করি, অধিক শিক্ষাগুরু চিবিয়ে খেলেও কিছু হবে না, যদি সে গুরুকে শ্রদ্ধায় রেখে নিজেকে চিনতে না পারে। শুনেছি রবীন্দ্রনাথ এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। গানের সুরের যে নানা বৈচিত্র্য; যেমন– গগন হরকরার গান “আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে” বাউল, কীর্তন, বিদেশি নানান সুরের মিশ্রণ লক্ষ করার মতো; যা রবীন্দ্রনাথের নিজস্বতায় পরিপূর্ণ।
তাঁর ছবি সাধারণভাবেই নিজস্ব, যেমন তাঁর গান। তিনিই ভারতবর্ষের আধুনিক ধারার সাহিত্য, গান ও ছবির প্রথম প্রবর্তক; যা বর্তমান সমসাময়িক সময়েও সমানতালে প্রভাবিত।
ছবি কখন কথা বলে যখন তা ছন্দ ও রঙের হারমোনির ব্যবহারে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। নির্জনতার ধ্বনি শরীরের ধমনিতে ধাক্কা দেয় ধ্যানের আদর্শে, এমনকি কোলাহলের মধ্যে ধ্বনির সুর যেমন শিল্পী শুনতে পায়। রবীন্দ্রনাথ লেখালিখি যখন তখন সব রকম পরিবেশে করতে পারতেন। মনের একান্তে গানের কথা, গানের সুর যে তাঁর মননে চলত, তা কি আমরা প্রকাশ্যে পেতাম? এটা সব শিল্পীর জন্যই এক পথ। তবে করণকৌশলের ভিন্নতায় শিল্পীর আলাদা আলাদা পথ। কেউ গান করে নেচে নেচে ছন্দে আবার কেউ ছবি আঁকে নানা কসরত করে, যার যেমন ভাবের প্রকাশ। আদিম গুহা চিত্রগুলো ইতিহাসের বর্ণনায় দেখি নৃত্যের ছন্দে পশু শিকারের ছবি। আর এখন সেটা পারফর্মিং আর্ট বলি। গান গাওয়াও মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যকর ব্যবহার, তা আমাদের সাধনা ও শিক্ষার দ্বারা আয়ত্তে আনতে হয়। ভালো গান করার প্রথম শর্ত হলো গানটা বোঝা, সুরে সুরে ভাবের সাথে গানের কথার অর্থ অনুধাবন করা। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন আমার গান সুর ও কথার মধ্যে যে সুসম্পর্ক তা যেন তোমরা মেনে চলো। আমি পরিপূর্ণভাবেই তা সাজিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমাদের গায়নশৈলীতে পরিমিত ভাবের হেরফের একটু তো হতে পারে। তাঁর যে গানের ভাব ও অর্থের ছবি, মনের দৃশ্যকল্পে কখনোই এক হবে না। আমি গান ও ছবি সুর ও ছন্দের বন্ধুত্বে বিশ্বাস করি। তাই রবীন্দ্রনাথের গান ও ছবি সবার কাছে গ্রহণীয় হতে হলে তাকে সযত্নে রাখা আমাদের এখন অতীব প্রয়োজন। “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরানসখা বন্ধু হে আমার” গানটি লিখেছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকাকালে। কুঠিবাড়ীর অদূরেই পদ্মা ও গড়াই। যখন মন চায় বজরায় সময় কাটা, ঘুরে বেড়ানোর সাথে নানান জমিদারি কাজ, কিন্তু থেমে থাকে না তাঁর লেখালিখি। কত গান, কাব্য সোনার তরীসহ চিঠিপত্র সাথে ছবি আঁকা। গানটি গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের কিন্তু এখানে বিরহের একটি প্রচ্ছন্ন ছাপ ঝড়ের অনুকূলে বইছে পরানসখার জন্য তিনি কে? প্রভু ও প্রেমিক মিলেমিশে এক অস্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ এমন কী রচনা করলেন, যা নানা মতে বিচার করা যায়। যেমন সহজ, তার চেয়েও কঠিন হলো উপলব্ধির জায়গায় পৌঁছে যাওয়া; যার সীমানাহীন গতিবিধি বন্ধনহীন। তাই তাঁর গান অমর ও অক্ষয়। গান তাঁর ছবি হয় অগোচরে, ঝড়ের হাওয়ায় অনুভূতি জাগায় মনের দৃশ্যকল্পে। ভালোবাসা ও প্রেম, সেই টানে দাঁড়ি টেনেছেন, ধরেছেন শক্তহাতে, মৃত্যুকে প্রেমে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন গানে গানে। “ওরে ভীরু, তোমার হাতে/ নাই ভুবনের ভার/ হালের কাছে মাঝি আছে/ করবে তরী পার/ ওরে ভীরু” কিংবা “এক হাতে ওর কৃপাণ আছে/ আরেক হাতে হার/ ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার”– এ রকম অসংখ্য গানের ছবি তিনি এঁকেছেন হাজার ক্যানভাসে। রবীন্দ্রনাথের প্রেম ভক্তিরসে জাড়িত। প্রকৃতিপ্রেমিক, নারীপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক, সমাজপ্রেমিক ও ধ্যানপ্রেমিক– রবীন্দ্রনাথ সবকিছু এক সুতোয় মালা গেঁথেছেন। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবির পরিচয়ে নন; তাঁর যে ফিলসফি ও ভিশন, তা হলো সব অভিজ্ঞতার সমন্বয়। ছবিতে ও গানে তা স্পষ্টরূপে প্রকাশ হয়েছে। শিল্পী চোখে দেখেন, মগজে নেন, অনুভব করেন, তারপর প্রকাশ করেন বিভিন্ন রসের অনুভবে। তাঁর নিজের ও নারীর প্রতিকৃতি কপি করেননি। এক রহস্য, ভয়, বিরহের বেদনার রূপ দেখতে পাই; যা ভারতীয় রীতি থেকে আলাদা। মোটা রং, আঁধারের যে নিজস্ব অভিব্যক্তি ও আত্মদর্শী, নির্জনতাপ্রিয় বিমূর্ত ও কায়ার ক্ষীণ প্রকাশ তার শিল্পধারার অন্যতম বলে আমি মনে করি। গহন বনে বাতাসে চুল উড়িয়ে বধূ যাচ্ছে। এতে কুঞ্জবনের নানান ফুল, লতাপাতা ও পাখির কূজনে চারিদিকে সুরের ব্যঞ্জনায় সর্বরসের ভাব ও অনুভূতি আমরা উপলব্ধি করি। দৈহিক মিলনের চেয়ে আধ্যাত্মিক প্রেমে রবীন্দ্রনাথের গানে শৃঙ্গার ও ভক্তিরস দেখতে পাই। বিচিত্রা, প্রকৃতি, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, বাউল, কীর্তন ও দেশাত্মবোধক গানে বীর, করুণ, ভক্তি ও শৃঙ্গার রসের প্রভাব দেখতে পাই। গানগুলি ভয় ও বিষাদের কোথাও কোথাও উঁকি দেয়।
“গভীর অরণ্যে বুঝি এলে আবার” ও “কে আসে যায় ফিরে ফিরে” দুটি গান দুই রসের ও ভাবের। মৃত্যু আর প্রেম রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের সঙ্গী ছিল। আবার “ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই/ ভুবনের ভার/ হালের কাছে মাঝি আছে/ করবে তরী পার/ ওরে ভীরু” ও “আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না” তাঁর প্রিয়জনদের মৃত্যুশোক তাঁকে ব্যথিত করেছে কিন্তু হতাশ করেনি। তাঁর ছবিগুলোতে ও গানের ভেতরে বাঁচার অনুসন্ধান করেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ সারাবিশ্বে শান্তি, একতা ও তাঁর ভাবদর্শন ছড়াতে পেরেছেন সার্থকতার সাথে, সেজন্য তিনি বিশ্বমানব হতে শাশ্বত বাঙালি হতে বলেছেন। তাঁর সব কর্মের মধ্যেই আমি অনুভব করি, ধারণ করি, বিশেষত গান ও ছবিতে।