মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হননি, দেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মশার কারণে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ ঘটছে। মশার হাত থেকে সুরক্ষার জন্য কয়েল, স্প্রে, অয়েন্টমেন্ট প্রভৃতি উপকরণ রয়েছে। আবার বড় আকারে বিস্তার ঠেকাতে রয়েছে ফগার মেশিনের ব্যবহার। প্রায় সব কটি পদ্ধতিতেই রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার হয়, যা মানবশরীর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

তবে রাসায়নিক বা কীটনাশকযুক্ত ওষুধের পরিবর্তে মশা নিধনে নতুন একটি যন্ত্র বানিয়েছে থিংক ল্যাবস নামের বাংলাদেশি এক প্রতিষ্ঠান। যন্ত্রটি বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কারখানা, বিপণিবিতানসহ যেকোনো খোলা জায়গায় স্থাপন করা যায়। যন্ত্রটি স্থাপনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই ওই এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

মশার মেশিন ছাড়াও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান নিয়ে আরও কিছু যন্ত্র বানায় থিংক ল্যাবস। মাত্র ২০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে এখন পর্যন্ত চার কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করতে শুরু করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন ৪১ জন কর্মী।

থিংক ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আশিকুর রহমান তানিম। বর্তমানে থিংক ল্যাবসে তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন মালিকানা অংশীদার রয়েছেন। তানিম ২০০৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া যান। পড়ালেখা শেষে সেখানেই কয়েক বছর তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করেন। তবে বাংলাদেশে ফিরে কিছু করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেই চিন্তা থেকেই গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে বিনিয়োগ নিয়ে ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘থিংক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগ দেন একদল তরুণ বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও গবেষক। এই থিংক ল্যাবসেরই নিজস্ব আবিষ্কার ‘মশার মেশিন’। যেটি এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়েছে।

যেভাবে কাজ করে যন্ত্রটি

আশিকুর তানিম জানান, মূলত নিশ্বাসের মাধ্যমে বের হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অনুসরণ করে প্রাণীদেহের কাছে পৌঁছায় মশা। এ কারণে থিংক ল্যাবের উদ্ভাবিত মশার মেশিনের একেবারে নিচে একটি ‘ট্র্যাপ’ চেম্বার রয়েছে। তার ঠিক ওপরে বিশেষ প্রলেপ দেওয়া সাকশন ফ্যান (যা বস্তুকণা নিজের দিকে টেনে নেয়) এবং তার ওপরে একটি বিশেষ লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। মেশিনটি চালুর পর ফ্যানটি ঘুরতে থাকে। তখন প্রলেপটির সঙ্গে লাইটের আলোর একটি ফটোক্যাটালিটিক প্রক্রিয়া তৈরি হয়, যা মশার জন্য একটি শক্তিশালী ফাঁদ তৈরি করে।

মশা সাধারণত ১০০ মিটারের বেশি দূরত্বে নিজ থেকে উড়তে পারে না। স্ত্রী মশা যখন নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে আসে, তখন যন্ত্রটির মাধ্যমে তৈরি হওয়া মানুষের মতো কৃত্রিম নিশ্বাসে আকৃষ্ট হয় ও ফাঁদে আটকা পড়ে। কোনো মশা যন্ত্রটির প্রবেশপথে একবার ঢুকে গেলে সাকশন ফ্যানের কারণে সেগুলো আর বের হতে পারে না এবং সরাসরি ট্র্যাপ চেম্বারে গিয়ে আটকে যায়। সেখানে ডিহাইড্রেড (পানিশূন্যতায়) হয়ে একপর্যায়ে মারা যায়। যন্ত্রটি ভবনের অভ্যন্তরে, প্রবেশদ্বার বা যেকোনো খোলা জায়গায় যেখানে মশার উপস্থিতি বেশি, সেখানে স্থাপন করা যায়।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, থিংকের মশা মারার যন্ত্রটি অন্যতম কার্যকর একটি ট্র্যাপ (ফাঁদ)। আমরা গবেষণার জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার পাঁচটি স্থানে এই যন্ত্রের মাধ্যমে মশা সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, প্রতিটি যন্ত্রে দৈনিক পাঁচ হাজারের মতো স্ত্রী মশা (মৃত) জমা হয়। কবিরুল বাশার জানান, এই যন্ত্রের সুবিধা হলো, এটি মা মশা আটকায়। প্রতিটি মা মশা ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম দেয়। তার মানে, এই যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মশার সংখ্যা ও বংশবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।

বর্তমানে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী, সাভারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও খোলা জায়গায় থিংক ল্যাবসের এই মশা মারার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, কুমিল্লা, কক্সবাজার, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় গ্রাহকেরা যন্ত্রটি কিনে বসিয়েছেন। বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, সেনানিবাস, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচ তারকা হোটেলেও মশা নিধনে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়েছে।

যন্ত্রটি ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখতে হয়। তবে এতে বিদ্যুৎ খরচ খুব কম। পুরোপুরি মেটাল কাঠামোতে বানানো যন্ত্রটি ঝড়বৃষ্টিসহ নানা ধরনের ঝুঁকি থেকেও মুক্ত। অত্যধিক ওজনের কারণে কারও পক্ষে এটি চুরি করে নেওয়াও কষ্টকর। তা ছাড়া কিছু মডেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক সেন্সর লাগানো রয়েছে। সব মিলিয়ে এই যন্ত্রটি পাঁচ বছরের বেশি সময় স্থায়ী হবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে তিনটি আকারে যন্ত্রটি পাওয়া যায়। আকারভেদে দাম ৩১ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মশার মৌসুমের ওপরে নির্ভর করে মাসে গড়ে ৩০টি যন্ত্র বিক্রি হয়। তানিম বলেন, প্রভাব বিবেচনায় ও এককালীন স্থায়ী বিনিয়োগ হিসেবে যন্ত্রটির দাম খুব বেশি নয়। আর আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে—এটির যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি, কর্মী সব দেশীয়। ফলে বলতে পারেন, এটি শতভাগ দেশীয় পণ্য, যা বাংলাদেশিদের জন্যই বানানো।

আরও যেসব কাজ করে থিংক

মূলত গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান তৈরি করে দেয় থিংক ল্যাবস। মশার মেশিন ছাড়াও এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন৵ বেশ কিছু পণ্য তৈরি করেছে তারা। যেমন বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির জন্য নয়েস মনিটরিং ডিভাইস তৈরি করেছে থিংক। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য ভ্যাকসিনের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের তারহীন সেন্সর বানিয়েছে তারা। আবার গ্যাসের সরবরাহ লাইনের তদারকি, জেনারেটরের ডিজেল পরিমাপ, হাইড্রোফোনিক উদ্ভিদের স্বয়ংক্রিয় তদারকি প্রভৃতি কাজের জন্য সেন্সর যন্ত্র বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

আশিকুর তানিম বলেন, ‘আরঅ্যান্ডডি নিয়ে কাজ করতে অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে আমাদের জন্য বিনিয়োগের চেয়েও সরকারের নীতিসহায়তা বেশি প্রয়োজন। দেশীয় প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার বাড়ালে ও আমদানি নিরুৎসাহিত করলে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র ক জ কর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ভুয়া এআই ভিডিও তৈরির টুল দিয়ে ম্যালওয়্যার ছড়াচ্ছে হ্যাকাররা

ভুয়া এআই ভিডিও তৈরির ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে নতুন এক তথ্য চুরির ম্যালওয়্যার ‘নুডলোফাইল’। আকর্ষণীয় ভিডিও তৈরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য, পাসওয়ার্ড ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেটের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে এই ক্ষতিকর সফটওয়্যার।

সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান মরফিসেক সম্প্রতি জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভুয়া ওয়েবসাইটের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ওয়েবসাইটে বলা হয়, ব্যবহারকারী তাঁর পছন্দের ছবি, ভিডিও বা লেখা প্রকাশ করলেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি হবে স্বয়ংক্রিয় ভিডিও। তবে বাস্তবে এসব সাইটে আপলোডের পর ব্যবহারকারীকে একটি জিপ ফাইল দেখানো হয়। যার ভেতরে ‘ভিডিও ড্রিম মেশিনএআই.এমপিফোর.এক্সই’ নামে একটি ফাইল থাকে। অনেক ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে ফাইল এক্সটেনশন দেখা না যাওয়ায় এটি দেখতে একটি ভিডিও ফাইলের মতো মনে হয়।

এ কৌশলে ব্যবহারকারীদের সন্দেহ কমে যায় এবং কিছু অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারও একে ম্যালওয়্যার হিসেবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ফাইলটি চালু করার পর একাধিক ধাপে একটি সংক্রমণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে একটি ব্যাচ স্ক্রিপ্ট চালু হয়ে উইন্ডোজের ‘সার্টইউটিল’ নামের বৈধ টুল ব্যবহার করে একটি পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রার ফাইল ডিকোড করে। এটি একটি পিডিএফ ফাইলের মতো মনে হয়। একই সময়ে উইন্ডোজ রেজিস্ট্রিতে একটি নতুন কি সংযোজন করা হয়। যার মাধ্যমে ম্যালওয়্যারটি কম্পিউটার চালুর সময় নিজে থেকেই সক্রিয় হতে পারে। পরবর্তী ধাপে ‘এসআরসিএইচওএসটি.এক্সই’ নামে একটি ফাইল চালু হয়। যা একটি নির্দিষ্ট সার্ভার থেকে ‘র‍্যান্ডমইউজার২০২৫.টিএক্সটি’ নামে একটি পাইথন স্ক্রিপ্ট ডাউনলোড করে এবং সরাসরি মেমোরিতে চালায়। এই স্ক্রিপ্টের মাধ্যমেই ‘নুডলোফাইল’ নামে ম্যালওয়্যার সক্রিয় হয়।

কম্পিউটারে যদি অ্যাভাস্ট অ্যান্টিভাইরাস চালু থাকে, তাহলে ম্যালওয়্যারটি ‘আরইজিএএসএম.এক্সই’ ফাইলের মধ্যে প্রবেশ করে ‘পিই হোলোয়িং’ কৌশল ব্যবহার করে। আবার ‘শেলকোড ইনজেকশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে এটি মেমোরিতে সক্রিয় থাকে। নুডলোফাইল মূলত ওয়েব ব্রাউজারে সংরক্ষিত লগইন তথ্য, পাসওয়ার্ড, সেশন কুকি, টোকেন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেটের সংবেদনশীল ফাইল চুরি করতে ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজনে এটি দূর থেকে যন্ত্রে ঢোকার (অ্যাকসেস) সুবিধাও দিতে পারে, অর্থাৎ হ্যাকার আক্রান্ত কম্পিউটারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

মরফিসেক জানিয়েছে, ম্যালওয়্যারটি এখনো কোনো পাবলিক নিরাপত্তা ডেটাবেজে নথিভুক্ত নয়। এটি ‘গেট কুকি ও পাসওয়ার্ড’ নামে একটি সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘ম্যালওয়্যার-এ-সার্ভিস’ আকারে ডার্ক ওয়েবের বিভিন্ন ফোরামে বিক্রি হচ্ছে। গবেষকদের ধারণা, এর সঙ্গে ভিয়েতনামি ভাষার একটি সাইবার অপরাধী চক্র যুক্ত।

চুরি করা তথ্য ‘টেলিগ্রাম’ মেসেজিং অ্যাপের একটি বটের মাধ্যমে হ্যাকারদের কাছে পাঠানো হয়। বটটি কার্যত একটি ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ সার্ভার হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে হ্যাকাররা তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীর তথ্য গ্রহণ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নুডলোফাইলের সঙ্গে যুক্ত থাকে ‘এক্সওয়ার্ম’ নামে আরেকটি দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ ট্রোজান। যার মাধ্যমে তথ্য চুরির পাশাপাশি আক্রান্ত কম্পিউটার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব হয়।

সূত্র: ব্লিপিং কম্পিউটার

সম্পর্কিত নিবন্ধ