ব্র্যাক ব্যাংক আস্থা: ৯ লাখ গ্রাহকের স্মার্ট ব্যাংকিং অভিজ্ঞতায় অনন্য প্ল্যাটফর্ম
Published: 13th, May 2025 GMT
ব্র্যাক ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ ‘আস্থা’ এখন ৯ লাখের বেশি গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে। ডিজিটাল জ্ঞানসম্পন্ন এত বড় গ্রাহকবেসকে সেবা দেওয়া ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের অবিচল আস্থার প্রতিফলন। এটি ব্র্যাক ব্যাংকের জন্য এক অনন্য মাইলফলকও বটে।
২০২১ সালে যাত্রা শুরু করা আস্থা অ্যাপ ডিজাইন করা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বৈচিত্র্যময় লাইফস্টাইল ও আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করার লক্ষ্য নিয়ে। বর্তমানে এই অ্যাপ বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও পছন্দের ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গ্রাহকেরা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদে উপভোগ করতে পারছেন নানাবিধ ব্যাংকিং সেবা।
শুধু ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই আস্থা অ্যাপে প্রায় ১৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যা বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে মাসিক অ্যাপভিত্তিক লেনদেনে এক নতুন বেঞ্চমার্ক।
আস্থা অ্যাপটি বিশেষত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এ অ্যাপ ব্যবহারকারী ৫৩ শতাংশ গ্রাহকেরই বয়স ২১ থেকে ৩৫-এর মধ্যে, যাঁরা ব্যাংকিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য, সুবিধা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আবার আস্থা অ্যাপের লাইফস্টাইল ফিচার ব্যবহারকারীর ৬১ শতাংশই এই বয়সী তরুণ প্রজন্ম, যাঁদের কাছে এ অ্যাপ দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আস্থা অ্যাপের গ্রাহকেরা নিজেদের ব্যাংকিং লেনদেনের ৭১ শতাংশই সম্পন্ন করেন এ অ্যাপের মাধ্যমে। গ্রাহকেরা যে ‘মোবাইল ফার্স্ট’ ব্যাংকিং সলিউশনের দিকে ঝুঁকছেন, এটি তারই উদাহরণ।
আস্থা অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকেরা যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে নিজেদের দৈনন্দিন ব্যাংকিং প্রয়োজন পূরণ করতে পারছেন। এখানে প্রতিটি সেবা নেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রাহকদের জন্য অত্যন্ত সহজ। এনপিএসবি ও আরটিজিএসের মাধ্যমে অন্য ব্যাংকে রিয়েল টাইম ফান্ড ট্রান্সফার থেকে শুরু করে গ্রাহকেরা এ অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল টপআপসহ বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধও করতে পারছেন ঝামেলাহীনভাবে। এ ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার ফলে গ্রাহকদের এখন আর ব্রাঞ্চে যেতে হচ্ছে না কিংবা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। এখানে নেই কোনো ট্রানজেকশন ফি। গ্রাহকেরা হাতের নাগালেই পাচ্ছেন নিরাপদ ও সুরক্ষিত ব্যাংকিং সেবা।
গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় পরিকল্পনাও সহজ করেছে আস্থা অ্যাপ। গ্রাহকেরা খুব সহজেই আস্থা অ্যাপের মাধ্যমে এফডিআর ও ডিপিএস অ্যাকাউন্ট খোলার পাশাপাশি সেগুলো এনক্যাশও করতে পারছেন এখান থেকে। এ ছাড়া এ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকেরা পিন জেনারেট কিংবা রিসেট করা, কার্ড সাময়িকভাবে ব্লক করা, এমনকি নমিনির তথ্যও হালনাগাদ করতে পারছেন খুব সহজেই। যাঁরা দ্রুততা এবং পরিকল্পিত আর্থিক সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেন, এই সেবাগুলো তাঁদের জীবনকে করেছে আরও সহজ ও নিশ্চিন্ত।
আস্থা অ্যাপের ‘ক্যাশ আউট বাই কোড’ ফিচারের মাধ্যমে এটিএম থেকে কার্ড ব্যবহার ছাড়াই খুব সহজে টাকা উত্তোলন করা যায়, যা গ্রাহকদের জন্য উন্মোচন করেছে প্রচলিত এটিএম ট্রানজেকশনের এক আধুনিক বিকল্প ব্যবস্থা। বিকাশ, রকেট ও ইনস্যুরেন্স পেমেন্টের মতো পৌনঃপুনিক লেনদেনগুলোকে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন ফিচারের আওতায় নিয়ে আসা যায়। ফলে গ্রাহক ভুলে গেলেও বিল পেমেন্ট হয় সময়মতো। বিকাশের ‘পুল মানি’ ফিচারটির মাধ্যমে যোগ হয়েছে আরও বিশেষ সুবিধা। আস্থা অ্যাপের এ সুবিধার ফলে গ্রাহকেরা বিকাশ থেকে তাঁদের ব্র্যাক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ক্রেডিট কার্ডে সরাসরি টাকা ট্রান্সফার করতে পারছেন।
আস্থা অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া সহজ ও সুবিন্যস্ত। গ্রাহকেরা অ্যাকাউন্ট নম্বর, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর, কিংবা ডিপিএস নম্বরের মাধ্যমেই এখানে সাইন-আপ করতে পারেন। এ কারণে প্রক্রিয়াটি সবার কাছেই সহজবোধ্য। এ অ্যাপের মাধ্যমে ইকেওয়াইসিভিত্তিক অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। কার্ড ও ঋণের আবেদনও এখান থেকে সহজেই করা সম্ভব। এ ছাড়া আস্থা অ্যাপে ব্র্যাক ব্যাংকের সব এটিএম বুথ, ব্রাঞ্চ ও মার্চেন্ট লোকেশন বের করা যায়, যা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ব্যাংকিং ও লাইফস্টাইলের দারুণ সংমিশ্রণ সবার কাছে আস্থা অ্যাপকে করে তুলেছে অনন্য। এখানে গ্রাহকদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুকে একসঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। ‘আস্থা লাইফস্টাইলের’ মাধ্যমে গ্রাহকেরা বাসের টিকিট কাটতে পারেন, বিনা মূল্যে প্রথম আলোর ই-পেপার পড়তে পারেন, ‘আস্থা প্লে’র মাধ্যমে গান শুনতে পারেন, এমনকি ‘আস্থা লার্নিং’–এর মাধ্যমে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন কোর্সও করতে পারেন। ‘আস্থা ইসলামিক’-এ রয়েছে এমন সব কনটেন্ট, যেখানে একজন গ্রাহক খুঁজে পাবেন আত্মিক সন্তুষ্টি। এখনকার গ্রাহকদের দরকার ব্যাংকিংয়ের চেয়েও বেশি কিছু। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েই ব্র্যাক ব্যাংক আস্থা অ্যাপে যুক্ত করেছে দারুণ সব ফিচার।
গ্রাহকদের আর্থিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনায়ও আস্থা অ্যাপ ভূমিকা রাখছে। এ অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট, ট্যাক্স সার্টিফিকেট, চেকবুক কনফারমেশন মুহূর্তেই পাওয়া যায়। এতে আছে ‘পজিটিভ পে’, যা এসএমই গ্রাহক, স্যালারি অ্যাকাউন্টহোল্ডার ও স্বনির্ভর পেশাজীবীদের জন্য জরুরি এক ফিচার। আস্থা অ্যাপের বিল পেমেন্টের ঝামেলাহীন প্রক্রিয়ায় সহজেই ইউটিলিটি বিল এবং সরকারি বিভিন্ন পেমেন্টসহ ভূমি করের মতো পেমেন্টও করা যায়। এসব সুবিধা দেশের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গ্রাহকদের দেয় বাড়তি সুবিধা।
এই প্ল্যাটফর্ম যত বড় হচ্ছে, ততই এর প্রভাবও বাড়ছে। ৯ লক্ষাধিক ব্যবহারকারীর এ প্ল্যাটফর্ম শুধু বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যাংকিংকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িতই করছে না; বরং একই সঙ্গে দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রসার, মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যাংকিংয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিকাশ ঘটাচ্ছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা অ্যাপ সম্পর্কে ব্যাংকটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আস্থা শুধু একটি অ্যাপই নয়, এটি বাংলাদেশের কোটি মানুষের স্মার্ট ভবিষ্যতের এক নতুন দুয়ার। এ অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি উদ্ভাবন, গ্রাহককেন্দ্রিকতা এবং সহজ ব্যাংকিংয়ের প্রসারে আমাদের ব্যক্ত করা প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, স্বাচ্ছন্দ্যময়, নিরাপদ, সহজ ও স্মার্ট ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে আস্থা বাংলাদেশের মানুষের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাকে বদলে দেবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হকদ র দ প ল য টফর ম অ য ক উন ট গ র হক র ব যবহ র ল নদ ন র জন য আর থ ক সহজ ই
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-পাকিস্তান আরও বিপজ্জনক এক যুগে ঢুকে পড়েছে
(ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। আসফান্দয়ার মিরের এই নিবন্ধে সংঘাতের নতুন এই ধরনের পেছনে ভারত ও পাকিস্তান কার কতটা দায় রয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধটি যুদ্ধবিরতির আগে প্রকাশিত। এরপরও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এর বাংলা ভাষান্তর প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।)
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন সংঘর্ষ বাধে, তখন বিশ্ব সেটিকে ধর্ম ও কাশ্মীরকে ঘিরে বহুদিন ধরে চলে আসা মীমাংসাহীন দ্বন্দ্বযুদ্ধের আরেকটি নতুন পর্ব হিসেবে দেখে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যেমন এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘কাশ্মীরে তারা হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে আসছে’ এবং ‘সম্ভবত তার চেয়েও বেশি সময় ধরে’।
এই যুক্তিটা বোধগম্য। কেননা, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এবং হিন্দুপ্রধান ভারত কয়েকটি যুদ্ধ ও বহুবার সংঘর্ষে জড়ালেও দুই দেশের মধ্যকার সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির টেবিলে মীমাংসা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাতে মধ্যস্থতা করেছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে যখন ভীষণ লড়াই বেধেছে, সে সময়েও এই প্রতিষ্ঠিত প্রহরীরা দুই পক্ষকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো অকল্পনীয় জায়গায় পৌঁছাতে দেয়নি।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পরিচিত এই চক্রকে এখন অতীত বলে মনে হচ্ছে। গত মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, যাতে ২৬ জন নিহত হয়েছেন, পর দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সামরিক উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই উত্তেজনা দ্রুত সামরিক সংঘাতে রূপ পাওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ও বিপজ্জনক দিকে মোড় নিয়েছে। দুই প্রতিবেশীকে ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষে জড়ানো থেকে নিবৃত্ত রাখার মতো কূটনৈতিক তৎপরতার পরিসর সীমিত হয়ে গেছে।
এই পরিবর্তনটা দুই দেশের একেবারে ভিন্নমুখী পথচলার মধ্যে শনাক্ত করা যায়।
ভারত এখন ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতকে শুধু একটি মহান দেশ হিসেবে নয়, এক সুমহান প্রাচীন সভ্যতার এমন এক গৌরবময় উত্তরসূরি হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে চান, বিশ্বমঞ্চে যেটি কিনা তার পদচিহ্ন রেখেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিল্লির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা আপসহীন মনোভাব তৈরি করেছে।
এতে করে পাকিস্তানকে শুধু ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রতিবেশী হিসেবে নয়, বরং ভারতের ন্যায়সংগত জাগরণে বিশাল হুমকি সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, দুই দেশই তাদের নিজেদের অংশ বলে) ওপর পাকিস্তানের দাবি এবং ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সমর্থন—ভারত আর সহ্য করবে না।
অন্যদিকে পাকিস্তান তাতে করে চীনের প্রভাব বলয়ে আরও বেশি ঝুঁকে যাবে। এতে করে ২৫ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আর এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশটিই এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজে ফলাফল নিয়ে আসবে এবং ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো আরও গভীর হবে।অন্যদিকে পাকিস্তান দুই দশক ধরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসংকটে জর্জরিত। পাকিস্তানে একটি প্রতিষ্ঠানই সর্বময় ক্ষমতাধারী। দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী নীতিনির্ধারণে কর্তৃত্ব করে এবং তাদের হাতে রয়েছে উল্লেখ করার মতো প্রচলিত যুদ্ধ ও পারমাণবিক সামরিক শক্তি। বিপর্যয়ের পরও, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো রয়েছে পাকিস্তানের। কাশ্মীরের মতো বিষয়গুলো পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়, এসব বিষয়ে ইসলামাবাদ দিল্লির সঙ্গে আপস করতে রাজি নয়।
গত কয়েক দশকে, পাকিস্তানের নানা উসকানির মুখেও ভারতকে সাধারণত সংযম প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। একটা সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সেটা সহায়তা করত। এমনকি ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৬৬ জন নিহত হওয়ার পরও, ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
মোদির আমলে ভারতের আগের অবস্থানটা বদলে গেছে। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে করার কৌশল তিনি নিয়েছেন। এর পাশাপাশি গোপন অভিযান, অন্তর্ঘাত ও লক্ষ্যবস্তু করে হত্যার ঘটনাও ভারত ঘটাচ্ছে। একই সময়ে পাকিস্তান এবং নির্দিষ্ট করে দেশটির সেনাবাহিনী তাদের ঐতিহ্যের বাইরে বেরিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিল। ২০১৯ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর পাকিস্তান অনেক বেশি সংযত আচরণ করে, ২০২১ সালে যুদ্ধবিরতি পুনরায় চালু করে। কিন্তু এর পর থেকে ভারত তার পথ বদল করে।
এমনকি যদি দুই পক্ষ বর্তমান উত্তেজনা থেকে সরে আসে, এরপরও ভারত খুব স্পষ্টভাবে পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি চাপের মধ্যে রাখার কৌশল অবলম্বন করবে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেওয়া এবং শক্তির মূল কেন্দ্র সেনাবাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি করা। গত মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে, ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের চূড়ান্ত ধরনের কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তাঁরা বলেছেন, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ ও উচ্ছৃঙ্খল রাষ্ট্র। ভারতকে অবশ্যই পাকিস্তানকে ধ্বংসের পথ কার্যকরভাবে খুঁজে বের করতে হবে।
ভারতের কৌশলগত এই পরিবর্তন পাকিস্তান বুঝতে পেরেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অশুভ বিষয় হচ্ছে, এই সংঘাত সেই গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচের ওপর হুমকি তৈরি করছে, এত দিন ধরে যেটা সংঘাতের বৃত্ত তৈরি করতে বাধা দিয়ে এসেছে। গত মাসে ভারত ১৯৬০ সালের করা পানিচুক্তি স্থগিত করে। সিন্ধু নদী পাকিস্তানের পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পাকিস্তান চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে ঘোষণা দিয়ে ১৯৭২ সালের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দেয়। এই চুক্তির বলে ভাগ হয়ে যাওয়া কাশ্মীরে একটা সীমান্ত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার সংকট সমাধানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই কমে আসছে। একসময় ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের কাছেই যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী। ভারত-পাকিস্তানকে কয়েকবার যুদ্ধের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল ওয়াশিংটন। ১৯৯৯ সালে, কাশ্মীরে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ থামাতে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ২০০১ সালে ভারতের আইনসভায় সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ত্বরিত কূটনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দুই দেশের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা প্রশমনে এবং এ ঘটনার পেছনে দায়ীদের কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনতে সহায়তা করেছিল।
কিন্তু আজ সেই ‘সৎ মধ্যস্থতাকারী’ ভূমিকার সম্ভাবনা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন মূলত বেইজিংয়ের প্রভাব মোকাবিলায় নয়াদিল্লিকে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ হিসেবে পাশে পেতে চাওয়ায় ভারত-পাকিস্তান ইস্যু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানালেও, তাদের মনোযোগ সীমাবদ্ধ থেকেছে বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউক্রেন ও গাজায় সংঘাত এবং ইরানের সঙ্গে কূটনীতিতে। তদুপরি নয়াদিল্লি এখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকে পাকিস্তানের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করে এবং ইসলামাবাদও পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতায় সন্দিহান। ফলে একসময়কার কার্যকর যোগাযোগ চ্যানেলগুলোও এখন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমানে সেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয় গেছে। বাইডেন প্রশাসন দিল্লিকে প্রশান্ত রাখার জন্য ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় নিজেদের দূরে রেখেছিল। এর কারণ হলো চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওয়াশিংটন ভারতকে পাশে চেয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন নরেন্দ্র মোদির প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও তাদের মূল মনোযোগের কেন্দ্র বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ এবং ইরানের সঙ্গে কূটনীতি।
এ ছাড়া তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকে ভারত আর স্বাগত জানাবে না, কারণ সেটাকে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত বলে মনে করবে। ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ককে পাকিস্তান অবিশ্বাসের চোখে দেখে। ফলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমটাও (যেটা একসময় গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করত) এখন অকেজো হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে এখন এটা বুঝতে হবে যে তার গুরুত্বপূর্ণ একটা স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এশিয়াতে আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে এটা সত্য। মার্কিন প্রশাসনের কেউ কেউ হয়তো ভারতকে আরও একপাক্ষিকভাবে সমর্থন দেওয়ার এবং পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি গুটিয়ে নেওয়ার অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু চীনের সঙ্গে ভারসাম্য, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তায় বড় অবদানকারী এবং বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ভারতের কার্যকারিতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে; যদি ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যয়বহুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনন্তকাল ধরে আটকে থাকে।
অন্যদিকে পাকিস্তান তাতে করে চীনের প্রভাব বলয়ে আরও বেশি ঝুঁকে যাবে। এতে করে ২৫ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আর এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশটিই এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজে ফলাফল নিয়ে আসবে এবং ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো আরও গভীর হবে।
আসফান্দয়ার মির যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ফেলো।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে