রাজনৈতিক সমাজের অপরিপক্বতা রাজনীতির মাধ্যমেই অতিক্রম করতে হবে। দেশের প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক কোনো কাজে লাগানো হলেও অবশ্যই তা হতে হবে ক্ষণস্থায়ী। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার, তবে সেনাশাসন দরকার নেই।

‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, সংবাদপত্র সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে ইউনিটি ফর বাংলাদেশ ও মিডল সি ফোরাম।

সভায় আলোচকেরা বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই গোয়েন্দা সংস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার হয়। যার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সংস্কার প্রয়োজন। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামরিক বাহিনীকে যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

এই আলোচনা সভায় সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সিভিল–মিলিটারির একটা অংশীদারত্বের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এটা দেশের সম্পদ।

সিভিল–মিলিটারি সম্পর্ক যেন সুস্থ রাখা যায়, সে জন্য তিনটি জায়গায় সতর্ক থাকতে হবে বলেও মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, একটি হচ্ছে সেনাশাসনের ধারণা। বাংলাদেশে সরাসরি সেনাশাসনের আগ্রহ ওই অর্থে সেনাদের মধ্যে নেই।

সেনাবাহিনীর অতিমাত্রায় অর্থনৈতিক খাতে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনী ইকোনমিক অ্যাক্টর (অর্থনৈতিক শক্তি) হয়ে গেলে তারা নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। পাকিস্তানে যে রকমটা হয়।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সংস্কার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকা উচিত বলেও মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই গোয়েন্দা সংস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া উচিত।

সামরিক বাহিনী যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার না হয়

এই আলোচনা সভায় দুটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। তার মধ্যে একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.

) মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামরিক বাহিনীকে যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য নিরাপত্তানীতি তৈরি করতে হবে। নিরাপত্তানীতি সবার ওপরে থাকবে। তার নিচে থাকবে প্রতিরক্ষানীতি, বিদেশনীতি, খাদ্যনীতি, বিদ্যুৎ–নীতি ইত্যাদি। নিরাপত্তানীতি এখনো হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রতিরক্ষানীতির গোপনীয় নয় এমন অংশ শ্বেতপত্র হিসেবে ২০২২ সালে প্রকাশ করা হয়েছে উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান বলেন, যাতে জনগণ সামরিক বাহিনীর কার্যপরিধি জানতে পারে। আর বাহিনী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজে ব্যবহৃত হলে জনগণ যেন আওয়াজ তুলতে পারে।

মাহফুজুর রহমান বলেন, সিভিল–মিলিটারি সম্পর্ক রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত পর্যায়ে পরিষ্কারভাবে চালিত করার জন্য ‘হায়ার ডিফেন্স’ সংস্থা সন্নিবেশ করা প্রয়োজন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ নিজার আলমও আলোচনা সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাজ তুলনামূলকভাবে দুর্বল হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। ঐতিহাসিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এ অঞ্চলের মানুষেরা যুক্ত ছিলেন না মন্তব্য করে সৈয়দ নিজার আলম বলেন, ফলে সংঘাত সমাধানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক সমাজ প্রায় সময় ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যায়। ফলে এই ধরনের অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সামরিক হস্তক্ষেপ হয়। সেটা হয়তোবা ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত। এই সামরিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় তাৎক্ষণিক সংকট দূর করে, একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংকট হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, রাজনৈতিক সমাজের অপরিপক্বতা রাজনীতির মাধ্যমেই অতিক্রম করতে হবে।

দলীয়করণ আর রাজনৈতিকীকরণ দুটি ভিন্ন

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর মনে করেন, সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাজনৈতিকীকরণ হওয়া উচিত, তবে দলীয়করণ হওয়া উচিত নয়।

সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিকীকরণ করা ঠিক না—এই কথাই ঠিক না মন্তব্য করে নূরুল কবীর বলেন, যার ওপর সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে, সেই সেনাবাহিনী যদি রাজনীতি না বোঝে, তার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার ন্যারেটিভস মাথায় না থাকে, তাহলে তারা দেশের প্রয়োজনে বেসামরিক মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে পারে না। বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে একই কথা। তাকে অবশ্যই অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন একটি গোষ্ঠী হিসেবে বিকশিত হওয়া দরকার। যে দেশের জনগণ ও প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি রাজনীতিসচেতন, সেই রাষ্ট্র তত বেশি শক্তিমান।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য শক্তিমান দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দরকার উল্লেখ করে নূরুল কবীর বলেন, কিন্তু সেনাশাসন দরকার নেই।

সামরিক বাহিনী যেন কারও ব্যক্তিগত বা কোনো রাজনৈতিক দলের হীন স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী। এ লক্ষ্যে ‘সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম’–এর আওতায় প্রতিটি বিষয় পরিষ্কার সংজ্ঞায়িত হওয়া প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সমাজের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক কেমন হবে, তা বুঝতে ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ টানেন নাঈম আশফাক চৌধুরী। তিনি বলেন, ভারত যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া সেনাবাহিনীকে সমাজ থেকে একরকম দূরে রেখেছে। ফলে ভারতে একদিকে গণতন্ত্র সুসংগঠিত হয়েছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের ওপর সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কখনোই হয়নি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তার বিপরীত চিত্র লক্ষ করা গেছে।

বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে উন্নত রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন ও লালন করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, যুদ্ধের জন্য একাত্তরের মতো জনগণকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এর প্রস্তুতি শান্তিকালীন থেকে শুরু করতে হবে।

সামরিক বাহিনীকে তার ক্ল্যাসিক্যাল ভূমিকা থেকে দূরে রাখলে তারা দুর্বল হতে থাকবে উল্লেখ করে নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে মিলিটারি বেসামরিক কোনো কাজে লাগানো হলেও অবশ্যই তা হতে হবে ক্ষণস্থায়ী। বিভিন্ন বড় বড় প্রজেক্ট থেকে শুরু করে ট্রাফিকের কাজেও মিলিটারিকে নিয়োজিত করা হয়েছে, যা সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে হ্রাস করেছে এবং এর ক্লাসিক্যাল ভূমিকা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’

জুলাই বিপ্লব ও তার পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, পুলিশ তার দায়িত্বভার যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণ করে মিলিটারিকে চলমান দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে সেনানিবাসে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, সামরিক বাহিনীকে যেমন বেসামরিকীকরণ করা উচিত নয়, একই রকমভাবে বর্তমান বাস্তবতায় সমস্ত সমাজকেও সামরিকীকরণ করা সম্ভব নয়।

এই সভায় আলোচক হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হওয়ার কথা ছিল সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খানের। তবে কারিগরি ত্রুটির কারণে তিনি সভায় বক্তব্য দিতে পারেননি। এই আলোচনা সভার সঞ্চালনা করেন ইউনিটি ফর বাংলাদেশের মুখপাত্র মঞ্জুর মঈন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ন জ ল ল র রহম ন র র জন ত ক ব যবহ র র জন য দরক র ত হওয়

এছাড়াও পড়ুন:

একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘‘বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত, চব্বিশ এবং আগের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। তাহলে একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করতে হবে। একই অপরাধে দুই রকমের বিচার হতে পারে না।’’

শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আরো পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন: দুলু

নৌকা ডুবেছে, শাপলা ভাসবে: এনসিপির তুষার

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘‘যদি আওয়ামী লীগের মতো একই ধরনের অপরাধে জামায়াতের বিচার না হয়, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার।’’

তিনি বলেন, ‘‘আজকে জামায়াত তাদের পোশাক-চেহারা, আচরণ পাল্টে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আক্রমণ করা। এই বহুরূপীদের চেহারা জনগণ চিনে ফেলেছে।’’

বিএনপির এই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপিই একমাত্র শক্তি। অথচ এই শক্তিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের নামে প্রক্রিয়া চালালেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আলাল আরো বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মনে করেছে, দেশের সব অনাচারের মূলে সংবিধান। কিন্তু সমস্যার মূল সংবিধান নয়—ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ। শেখ হাসিনার ১৬-১৭ বছরের শাসনে এই অন্যায়, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারই হয়েছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’’

ঢাকা/রায়হান/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ জনগণের নয়, কিছু উপদেষ্টার প্রয়োজন: হাফিজ
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
  • অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে: ফখরুল
  • সরকার নিরপেক্ষতা হারালে জনগণ মাঠে নামবে: তাহের
  • সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি অবস্থান পরিবর্তন করে
  • বিএনপি-জামায়াত দেশকে অন্য এক সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
  • জনগণের সঙ্গে এটা প্রতারণা: মির্জা ফখরুল