ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে সন্তুষ্ট নয় আছিয়ার মা
Published: 17th, May 2025 GMT
মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় তিন আসামি খালাস পাওয়ায় রায়ে সন্তুষ্ট নন শিশুটির মা। আজ শনিবার (১৭ মে) সকালে রায় ঘোষণার পর আদালত চত্ত্বরে এ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।
মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য তিন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার সময় আসামিদের পাশাপাশি মামলার বাদী শিশুটির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আছিয়ার মা বলেন, ‘‘আমি খুশি না। এই মামলায় তিন আসামি খালাস পেল? ওরা তো এ কাজে সহযোগিতা করিছে। আমার বড় মেয়েরে হুমকি দেছে। তারে মারধোর করছে, মুখ আটকায় রাখছে। ওরাও দোষী, ওদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।”
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯/২ ধারায় ধর্ষণের কারণে মৃত্যুর অপরাধ, শিশুটির বোনের স্বামী ও ভাশুরকে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার দ্বিতীয় অংশ ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ অভিযোগ গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘‘মূল আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে অন্য তিনজনকে কেন খালাস দেওয়া হয়েছে, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমরা জানতে পারব। সেটা পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
এদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী (লিগ্যাল এইড অফিস থেকে নিয়োগ দেওয়া) সোহেল আহম্মেদ।
তিনি বলেন, ‘‘তিন আসামিকে যে খালাস দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা খুশি। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হয়নি। মূল আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।”
এটি একপেশে বিচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মেয়ে। তিনি বলেন, ‘‘এখানে কোনো উকিল আমাদের পক্ষে দাঁড়াতে চায়নি। লিগ্যাল এইড থেকে একজন উকিল দেওয়া হইছিল, সে আমাদের কথা আদালতে ভালোভাবে বলেনি। আমরা কয়েকজন সাক্ষী দিতে চাইছিলাম। আইনজীবী বলে, এ সাক্ষী দেওয়া যাবে না। আমার আব্বার ফাঁসি দিয়ে যদি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, হোক। কিন্তু যা হলো, তা একপেশে বিচার।”
তিনি জানান, ঘটনার পর তার বাবার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে তার দাদি অন্যের বাড়ির বারান্দায় রাত কাটান। এ ঘটনার বিচার কে করবে? এ প্রশ্নও করেন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিটু শেখের মেয়ে।
চলতি বছরের ১ মার্চ শিশুটি বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। ৬ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে অচেতন অবস্থায় মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ওই দিন রাতেই শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। পরে ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়।
ওই দিন সামরিক হেলিকপ্টারে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় আনা হয়। দুই দফা জানাজা শেষে শ্রীপুরে গ্রামের বাড়ির একটি কবরস্থানে শিশুটির মরদেহ সমাহিত করা হয়।
এর আগে ৮ মার্চ শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন।
গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো.
এস/শাহীন/এস
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার ফলে দলটির পক্ষে প্রচার, সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি দলটির খবর প্রচার করলেও ব্যক্তি ও গণমাধ্যম দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির আওতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশকে কোনোভাবেই রুদ্ধ করা ঠিক না।
আইনজ্ঞদের মতে, অধ্যাদেশের কিছু বিষয় ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে চাপে রাখবে। এ ধরনের চাপ সংবিধান পরিপন্থি। কেউ কেউ বলছেন, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। নতুন যে শঙ্কা তৈরি করা হয়েছে, তা আইনগতভাবে প্রশ্নের মুখে পড়লে টিকবে
না। আবার কেউ কেউ বলছেন, আইন বা অধ্যাদেশে যা-ই থাকুক, সরকারের প্রেস উইং থেকে ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নেই বলে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটিই প্রযোজ্য হবে এবং অনুসরণ করা হবে। কোনো সমস্যা তৈরি হলে তখন বিবৃতিটি দালিলিক তথ্য-প্রমাণ হিসেবে আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টরা এসব কথা বলেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের পক্ষে যায় এমন মতামত, আলোচনা, বিশ্লেষণ বর্তমান পরিস্থিতিতে নিষেধ। অথচ আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির অপকর্ম ও অপরাধের ফিরিস্তি গত ৯ মাস ধরেই অবিরামভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে, এত কিছুর পরও দেশের লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগের অনুসারী। তাদের পছন্দের দল যদি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।’
শাহ্দীন মালিকের মতে, আওয়ামী লীগের অপকর্ম ও অপরাধ সম্পর্কে জানার পর সম্ভবত খুব বেশি নাগরিক তাদের পক্ষে ভোট দেবে না। কিন্তু দলকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভিযাত্রা সাফল্যমণ্ডিত হবে না। এক নেতার এক ঘণ্টার আলটিমেটামে সরকার যেভাবে আওয়ামী
লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে ত্বরিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, সেটি সরকারের এবং আলটিমেটাম প্রদানকারী উভয়ের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা মলিন করতে যথেষ্ট।
বিশিষ্ট এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘অপকর্ম করেছে আওয়ামী লীগ। মতাপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে খেসারত দিতে হচ্ছে গণমাধ্যম ও জনগণকে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে এটি মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিয়ে তর্কবিতর্ক বন্ধ করা যাবে না। শুধু গণমাধ্যম নয়, ব্যক্তিরও মতপ্রকাশের সুযোগ রুদ্ধ করা যাবে না। পৃথিবীজুড়ে নিষিদ্ধ বই, নিষিদ্ধ সংগঠন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়। ব্যক্তির মতপ্রকাশের বিষয়ে প্রেস উইং থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়টি আইনেও স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।’
রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, ‘ফেসবুকসহ সাইবার জগতে নিষিদ্ধ সংগঠন বা দল কার্যক্রম চালাতে পারবে না– এটি হয় বা হতে পারে। জনমতকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। ব্যক্তির মত, দ্বিমত ও ভিন্নমতের পরিসর নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম এবং জনগণ অবশ্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেবে; তর্কবিতর্ক করবে। একে রুদ্ধ করা যাবে না।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। নতুন যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, সেটি স্পষ্টত সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধান গণমাধ্যমের পাশাপাশি সভা-সমাবেশ, সংগঠন করা ও ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, তাদের বিচার হবে এবং তার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তার আগে দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ব্যক্তি ও গণমাধ্যমে মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ করা সংবিধানসম্মত নয়।’
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, যে প্রক্রিয়ায় দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তাকে ‘প্রেশার ল’ বলা যেতে পারে। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারই বলেছিল– আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শাহবাগে কিছু দল ও সংগঠনের দাবির মুখে সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সর্বজনীন নয়। তাঁর মতে, অধ্যাদেশ দুটি জারির পর আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচনার মুখে পড়েছে। নাগরিকরা কথা বলতে পারলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। গণমাধ্যম এতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। ফলে জনগণ গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে কোনো বাধা নেই। বাধা যদি আসেও, তাহলে সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে এবং সেটি টিকবে না। প্রেস উইং থেকেও বিবৃতির মাধ্যমে নিষিদ্ধ দলের (আওয়ামী লীগ) প্রচার ও সমর্থন বিষয়ে ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের করণীয় স্পষ্ট করা হয়েছে। তাই আইনের কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে প্রেস উইংয়ের বিবৃতিটি সহায়ক হবে। তাঁর মতে, অধ্যাদেশে নিষিদ্ধ সত্তা ও সমর্থনকারী সত্তাকে বোঝানো হয়েছে। এটি দল ও এর সহযোগী সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।