১৯৪৮ সালের মে মাসে আমার দাদি খাদিজা আম্মার শেষবারের মতো বেইত দারাসে তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একাকী যাত্রা শুরু করেছিলেন। যদিও তাঁর সঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বেরিয়ে পড়েছিল, যারা ইহুদিবাদী মিলিশিয়াদের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে তাদের প্রিয় বাড়িঘর ও জমিজমা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের দিকে চোখ ফেরানোর মতো পৃথিবীতে কেউ ছিল না। তারা একসঙ্গে ছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ একা। আর তাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মতো কোনো ভাষা ছিল না।
সময়ের বিবর্তনে ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালের মে মাসের ঘটনাগুলো নকবা বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে নকবা শব্দটির ব্যবহার আরেকটি ‘বিপর্যয়’ হলোকাস্টের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বকে বলছিল, ইউরোপে ইহুদিদের ওপর যে বিধ্বস্ত পরিস্থিতি নেমে এসেছিল, তার মাত্র তিন বছর পরে আমাদের মাতৃভূমি ফিলিস্তিনে একটি নতুন বিপর্যয়ের উদ্ভব ঘটে, যা খুব আলাদা হলেও কোনোভাবে কম বেদনাদায়ক ছিল না।
দুঃখজনকভাবে আমাদের বিপর্যয় কখনও শেষ হয়নি। আমার দাদির নির্বাসনের ২৭ বছর পরও তারা এখনও আমাদের পিছু ছাড়েনি। আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজ জমিতে বাস করা কিংবা সেখানে ফিরে যেতে তাদের অনুমতি চাওয়ার কারণে এখনও আমাদের হত্যা ও অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
যেহেতু এটি কখনও শেষ হয়নি, তাই নকবা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে স্মরণ করা সব সময়ই কঠিন ছিল। কিন্তু আজ আমরা যখন নকবা বোঝা ও আলোচনা বা স্মরণ করার চেষ্টা করছি তখন আমাদের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা এখন নতুনভাবে ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি আর কেবল ৭৭ বছর আগে শুরু হওয়া ভয়াবহতার ধারাবাহিকতায় সীমাবদ্ধ নেই।
আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নকবা ‘সরাসরি প্রচারিত গণহত্যা’র রূপ নিয়েছে বলে তুলে ধরেছে। এই সহিংসতা আর আর্কাইভে লুকানো কিংবা বেঁচে যাওয়াদের স্মৃতিতে চাপা নেই। কেননা, আমাদের ডিভাইসের স্ক্রিনে ব্যথা, রক্ত, ভয়, ক্ষুধা– সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাই ‘নকবা’ শব্দটি আজ আমার জনগণ এবং আমার মাতৃভূমির সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা বর্ণনা করার জন্য উপযুক্ত বা যথেষ্ট নয়। নতুন ভাষা বা পরিভাষার প্রয়োজন পড়েছে, যা ফিলিস্তিনি বিপর্যয়ের এই নতুন পর্যায়ের বাস্তবতা সঠিকভাবে তুলে ধরে। আমাদের এমন এক নতুন শব্দের প্রয়োজন, আশা করি যা ফিলিস্তিনের ওপর বিশ্বের দৃষ্টি ফেলতে সাহায্য করবে।
এই উদ্দেশ্যে অনেক শব্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি নিজেই বেশ কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ডেমোসাইড, মেডিসিড, ইকোসাইড, কালচারিসাইড, স্পেসিও-সাইড, গাজাসাইড ও স্কলাস্টিসাইড। নিঃসন্দেহে এই শব্দগুলোর প্রতিটিই ফিলিস্তিনে আজ যা ঘটছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করে।
একাডেমিক হিসেবে আমার কাছে একটি শব্দ বিশেষভাবে শক্তিশালী মনে হয়, তা হলো ‘স্কলাস্টিসাইড’। এটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফিলিস্তিনি জ্ঞানকাণ্ড মুছে ফেলার কর্মযজ্ঞ তুলে ধরে। গাজার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯০ শতাংশ স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও জাদুঘর বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। অধ্যাপক ও ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। মেধাবী শিক্ষাবিদ কারমা নাবুলসি প্রণীত স্কলাস্টিসাইড শব্দটি কেবল ফিলিস্তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত কাঠামো ধ্বংসের কথা বলে না; আমাদের স্মৃতি, কল্পনা এবং আদিবাসীদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর চালিত যুদ্ধকেও বর্ণনা করে।
আরেকটি শব্দ যা আমার কাছে উদ্দীপক ও অর্থবহ বলে মনে হয়, সেটি হলো ‘গাজাসাইড’। রামজি বারুদ এ শব্দটি জনপ্রিয় করে তুলেছেন। এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের এই নির্দিষ্ট অঞ্চল লক্ষ্য করে নির্মূল, বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার শতাব্দীব্যাপী কর্মকাণ্ড বোঝায়। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলের অপরাধ শনাক্ত করার ক্ষমতার মধ্যেই এই শব্দের শক্তি নিহিত। গাজাসাইড সরাসরি গাজাকে গণহত্যায় যুক্ত সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নামকরণ করে।
ঘাদা এজিল: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক; আলজাজিরা
থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েল ‘জলদস্যুর কাজ’ করেছে: এরদোয়ান
ইসরায়েলের গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌযান আটককে ‘জলদস্যুর কাজ’ আখ্যায়িত করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। নিজের দল একে পার্টির এক সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় এ ধরনের পদক্ষেপ প্রমাণ করে, এই গণহত্যাকারীরা গাজায় নিজেদের অপরাধ ঢাকতে পাগল হয়ে গেছে।
এরদোয়ান আরও বলেন, ‘গণহত্যাকারী (ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন) নেতানিয়াহু সরকার শান্তির ন্যূনতম সুযোগ আসুক, সেটাও সহ্য করতে পারে না। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আবারও বিশ্ববাসীর সামনে গাজায় নির্মমতা ও ইসরায়েলের খুনি চেহারা তুলে ধরেছে। আমরা আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের ছেড়ে যাব না। যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমরা আমাদের সব ক্ষমতা দিয়ে কাজ করে যাব।’
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভেঙে সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। এই নৌবহরে ৪০টির বেশি বেসামরিক নৌযান অংশ নেয়। এ বহরে প্রায় ৪৪টি দেশের ৫০০ মানুষ যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক আছেন।
গত ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে ছেড়ে আসা এই নৌবহর বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে গাজার কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছায়। ২০০৭ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরের ওই জলসীমা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। গতকাল মাধ্যরাতে নৌবহরের জাহাজে জাহাজে উঠে ত্রাণ নিয়ে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা অধিকারকর্মীদের আটক করে নিজেদের দেশের বন্দরে নিয়ে গেছে ইসরায়েলি সেনারা।
আরও পড়ুনগ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার একটি বাদে সব নৌযান আটক করেছে ইসরায়েল৩ ঘণ্টা আগেইতিমধ্যে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার একটি বাদে বাকি সব জাহাজ আটক করার কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করা বা আইনসম্মত নৌ অবরোধ লঙ্ঘন করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুনসুমুদ ফ্লোটিলার ২৪ জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে, একটি গাজার জলসীমায়: দেখুন লাইভ ট্র্যাকারে৮ ঘণ্টা আগে