প্রবাসমুখী তরুণ প্রজন্ম, লিভিং অ্যাপার্ট টুগেদার এবং মেধা পাচার কেন বাড়ছে
Published: 20th, May 2025 GMT
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে (চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন) নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে অনেক ধরনের কথাবার্তা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) বিবিএ প্রোগ্রামে আশিক আমার ছাত্র ছিলেন। তাই শিক্ষক হিসেবে আশিকের সাফল্যে আমি আনন্দিত। আইবিএতে আমি আশিককে একজন ভদ্র, মার্জিত ও ভালো ছাত্র হিসেবে চিনতাম। সাম্প্রতিক কালে আশিক অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করেন। আশিকের দেশে আসা ও সাফল্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আশিকের মতো বাংলাদেশের মেধাবী তরুণেরা ক্রমান্বয়ে দেশের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এতে যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষার্থীরা উন্নত শিক্ষা, চাকরি, পেশা ও জীবনযাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য যে ৭০ থেকে ৯০ হাজার ছাত্রছাত্রী বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই দেশে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছা নেই। মেধাবীরা কেন দেশ ছাড়ছেন?
মেধা মানে শুধু উচ্চাকাকঙ্ক্ষা নয়; মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন একটা উপযুক্ত আর্থসামাজিক পরিবেশ, যেখানে সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হয়। যেখানে উচিত কথাটি বলা ও সঠিক কাজটি করার জন্য কারও রোষানলের শিকার হতে হয় না; যেখানে ‘প্রভাবশালী’ অথবা ‘বিত্তবান’ অথবা ‘ক্ষমতাবান’ শুভাকাঙ্ক্ষী না থাকলেও শুধু নিজের যোগ্যতায় একজন তরুণ তাঁর পেশায় প্রাপ্য জায়গায় পৌঁছে যেতে পারেন।
দেশের কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, আমলাতন্ত্র এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এই প্রতিকূল পরিবেশে শুধু যোগ্যতা আর সততা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নতুন প্রজন্মের জন্য আসলেই একটা কঠিন কাজ।
শিক্ষা খাতের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলতে হয়, বিশ্বমানের তুলনায় দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় একেবারেই সময়োপযোগী নয়। একইভাবে যেসব কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেখানকার জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তার কোনো সমন্বয় নেই।
বিশ্বের যে ১০টি দেশ সামগ্রিক অর্থনীতির তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ করে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত ৫ বছরে জাতীয় বাজেটের মাত্র ১২ শতাংশের মতো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে। একইভাবে সামগ্রিক জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কী করতে পারেন, যেখানে চাকরির বাজারে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। যেমন একজন প্রকৌশলীর চাকরিজীবন শুরু হয় মাসিক ২৬ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে; স্থপতিরা পান এর চেয়েও কম। দেশের বাইরের সুযোগগুলোর তুলনায় এ ধরনের মাসিক ভাতা খুবই কম, যার জন্য মেধাবীরা সংগত কারণেই দেশের বাইরের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যেখানে তাঁদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি।
বাংলাদেশে শ্রমবাজারের অংশগ্রহণের হার মাত্র ৬২, যে কারণে অনেক কর্মযোগ্য তরুণ বেকারত্বে ভুগছেন। আমাদের এখানে অনুপযোগী শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবিক কর্মদক্ষতার চেয়ে পুঁথিগত বিদ্যাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর কারণে বাংলাদেশের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা বর্তমান চাকরির বাজারে চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় নিম্নপর্যায়ের হলেও বেশি বেতনের কারণে বিদেশের চাকরির প্রলোভনে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।
অনেক বছর আগে আমি যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শপ্রতিষ্ঠান এবং আরেকটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করি। দেশের বাইরে আমাদের সুনাম ও সুখ্যাতি থাকলেও দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে আমাদের মেধা ও সেবা কাজে লাগাতে পারছি না।ব্যবসা–বাণিজ্যের কথা যদি বলি, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বিনিয়োগে উচ্চ মুনাফার ‘ব্যবসা’ হলো রাজনীতি, যেখানে দলবাজি, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি করে স্বল্পতম সময়ে শতকোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। যে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে সততা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার চেয়ে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির মূল্যায়ন বেশি, সেখানে একজন আদর্শবান তরুণ কীভাবে সৎ পথে চলেন এবং নীতির সঙ্গে আপস না করে তাঁর কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন, তা বোধগম্য নয়। এতে অযোগ্য ও নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষগুলো যেভাবে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন; একই কারণে অনেক যোগ্য, সৎ ও নীতিমান তরুণ রাজনীতি, ব্যবসা এবং সর্বোপরি নিজ দেশ থেকে নীরবে সরে যাচ্ছেন।
১৯৭১, ১৯৯১ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাতি হিসেবে প্রতিবারই আমরা একটার পর একটা সুযোগ হারাচ্ছি, যত দিন না আমরা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের ভিত্তি সংশোধন না করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার মতো এমন কিছু দেশ বা জাতি দিতে পারছে না—এটাই রূঢ় এবং বাস্তব সত্য। এ ব্যাপারে আমি নিজের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
অনেক বছর আগে আমি যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শপ্রতিষ্ঠান এবং আরেকটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করি। দেশের বাইরে আমাদের সুনাম ও সুখ্যাতি থাকলেও দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে আমাদের মেধা ও সেবা কাজে লাগাতে পারছি না।
আরও পড়ুনপ্রবাসীদের মেধা ও দক্ষতাকে সরকার কীভাবে ব্যবহার করবে৩১ আগস্ট ২০২৪যেখানে জি-৭ এবং জি-২০-এর মতো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ফোরামে আমরা নিজ যোগ্যতায় নীতিনির্ধারণী ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছি, সেখানে নিজ দেশে আমরা কখনোই যোগ্যতা ও কাজের সঠিক মূল্যায়ন পাইনি। এর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, দুর্নীতি ও নীতিহীনতার সঙ্গে আপস না করার ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। এতে যতই দিন যাচ্ছে, ততই সংগত কারণে দেশের বাইরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে, যেখানে মেধা, সততা ও যোগ্যতা যথার্থ মূল্যায়ন হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেক বেশি।
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রুগ্ণ স্বাস্থ্য খাত, যুগের অনুপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ছাত্র ও তরুণসমাজ দেশের ব্যাপারে আস্থা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। রুল অব ল ইনডেক্সে (আইনের শাসনের সূচক) বিশ্বের ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম। দেশের প্রতি ১ হাজার ৫৮১ জন রোগীর জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র ১ জন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত অনুপাতের চেয়ে অনেক কম। একটি দেশের মৌলিক তিনটি খাত—স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনের শাসনের অবস্থা যদি এ রকম হয়, তাহলে তরুণেরা কিসের আশায় তাঁদের স্বপ্ন, আশা ও ভবিষ্যৎকে দেশের কাছে সমর্পণ করবেন?
বাস্তবিক অর্থে দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা কি তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সুবিচার করতে পেরেছি? দুঃখজনক হলেও সত্য, ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে গত বছরের ৫ আগস্ট যে একটি সাহসী ও সফল গণ–অভ্যুত্থান হলো, সেই আন্দোলনের পর শিক্ষার্থী সম্প্রদায়ের মৌলিক সমস্যা—যেমন মানসম্পন্ন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন—এই বিষয়গুলোর প্রতি আজ পর্যন্ত কোনো নজর দেওয়া হয়েছে কি?
আন্দোলনের ত্যাগী ও সাহসী ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকতেই পারে, কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রী যাঁরা আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিলেন, তাঁদের জন্য আন্দোলন–পরবর্তী যথাযথ দায়িত্ব কি আমরা পালন করতে পেরেছি?
যাঁরা মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের পরিবার ও সন্তানসন্তুতির জীবনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য। আজকাল অনেক দম্পতি একধরনের জীবনযাত্রা বেছে নিয়েছেন, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ল্যাট লাইভস’ (লিভিং অ্যাপার্ট টুগেদার)।
এ ধরনের সামাজিক ব্যবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে একজন উপার্জন করছেন এবং সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য বিদেশে বসবাস করছেন আর অপরজন ব্যবসায়িক বা পারিবারিক কারণে দেশ ও প্রবাসে আসা-যাওয়া করছেন। অনেকের জন্য এটা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে জীবনকে মানিয়ে নেওয়া।
যত দিন পর্যন্ত না সমাজের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে, মেধা ও যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ন হবে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের সংস্কার ও বিকাশ ঘটবে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নির্মূল হবে, তত দিন পর্যন্ত এই মেধা পাচার বা ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর তত দিন পর্যন্ত আশিকের মতো উদীয়মান তরুণ প্রতিভাদের দেশকে ধরে রাখতে পারার সম্ভাবনা কম।
পরবর্তী প্রজন্মের মেধাবী তরুণদের ধরে রাখতে হলে দেশকে তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় এই ‘নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ’ চলতেই থাকবে এবং একটা মেধাশূন্য জাতি হওয়ার পিচ্ছিল পথে ক্রমান্বয়ে অন্ধকার অতল গহ্বরের দিকে আমরা নিমজ্জিত হতে থাকব। এই শূন্যতা পূরণ করবে কারা? এ প্রশ্নের সদুত্তর যত তাড়াতাড়ি দেওয়া যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
অধ্যাপক সৈয়দ মুনীর খসরু আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গর্ভন্যান্সের (আইপিএজি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রজন ম র য গ যত র ব যবস থ র জন য আম দ র র জন ত অন ক ব হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার এক নতুন আলোচনায় এসেছে গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রস্তাব ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, সরকার যদি চায় তাহলে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে বা আলাদা দিনেও গণভোট আয়োজন সম্ভব। এজন্যই কমিশন সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগাম প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্থানীয় সরকার, তথ্য, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহনসহ ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- একদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা, অন্যদিকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ।
গণভোটের প্রস্তুতি নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “গণভোট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে এটি হবে কি না, কবে হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যদি গণভোট আয়োজনের নির্দেশ আসে, তাহলে যেন তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য প্রস্তুতি রাখা।”
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সভায় বলেন, “সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখে।”
সভায় আরো জানানো হয়, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে খসড়া ভোটকেন্দ্র তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়।
ভোটকেন্দ্র, অবকাঠামো ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
সভায় আলোচনা হয়, দেশের ৪২ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব স্থানে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
ইসির নির্দেশে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা যেন ভোটের আগে মেরামত ও প্রবেশযোগ্য হয়। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় হেলিপ্যাড সংস্কারের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে জরুরি পরিবহন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলাচলে সমস্যা না হয়।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, ভোটের দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের লজিস্টিক সহায়তা ও যানবাহন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেডিকেল টিম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। প্রতিটি টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। দুর্গম এলাকায় ইউনিয়নভিত্তিক সহায়ক টিমও থাকবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র্যাবকে যৌথভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, যিনি আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকি করবেন।
প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা
ইসি জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রেরণে এবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভোট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিভিএমএস) ব্যবহার করা হবে। এতে কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফলাফল জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা চাই ফলাফল যেন দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়। সেই জন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।”
তিনি আরো জানান, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
গণভোটের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২(১)-এর উপধারায় বলা আছে যদি সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানতে হয়, তবে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই গণভোটের বিষয়টি সামনে এসেছে।
তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সংবেদনশীল। কিছু দল মনে করছে, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চাপ বেড়ে যাবে; আবার কেউ কেউ বলছে, এতে ব্যয় কমবে ও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।
একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে, যেন সরকার যেদিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবে, সেদিনই কাজ শুরু করা যায়।”
অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও বাজেট বরাদ্দ
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন একা আয়োজনের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রায় ৮,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণভোট যুক্ত হলে ব্যয় আরো ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের সচিব বৈঠকে জানান, বাজেট সংস্থান বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে শুধু অপরিহার্য খাতে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা
ইসি সচিব বলেন, “আমরা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছি। শিক্ষক, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এতে থাকবেন।”
ইসি চায়, ভোটগ্রহণে যেন নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের তালিকা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রচার কৌশল
ভোটার সচেতনতা বাড়াতে ইসি সংসদ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এয়ারটাইম ব্যবহার করবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটাধিকার ও আচরণবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইসি যৌথভাবে এই প্রচার অভিযান পরিচালনা করবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষক ও প্রবাসী ভোটার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা ও অনুমতি প্রক্রিয়া দ্রুত করা হবে। একই সঙ্গে ইসি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম চালু করছে। আগামী ১৬ নভেম্বর এর ট্রায়াল অ্যাপ উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আখতার আহমেদ।
সরকারি সফরে সচিবদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিল ইসি
বৈঠকে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা সরকারি সফরে দেশের যেখানেই যান না কেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সরকারের পূর্ণ সহায়তা চায়। কারণ নির্বাচন কমিশন একা এই বিশাল আয়োজন করতে পারে না, সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও ঢাকা-১৪ আসনের ভোটার তৌহিদুর রহমান বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয় যে সরকার গণভোটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং ইসি চাইছে আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে যাতে কোনো অঘটন বা বিলম্ব না ঘটে।”
তিনি বলেন, “এখন অপেক্ষা সরকারের সিদ্ধান্তের। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কি একসঙ্গে হবে, নাকি আলাদা দিনে। যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই আগাম প্রস্তুতি বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”
ঢাকা/এস