জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ‘জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানবতার জন্য একটি অস্তিত্ব সংকট’—এই সত্যটা কি আমরা উপলব্ধি করছি? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং গবাদি প্রাণীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে।

জলবায়ু পরিবর্তন গবাদি প্রাণীর জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে, যা খাদ্যনিরাপত্তা এবং কৃষি অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং পরিবেশগত পরিবর্তন গবাদিপশুর স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা এবং প্রজননক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব ফেলে। দুগ্ধজাত গবাদি প্রাণীর ওপর জলবায়ুগত প্রভাবের ফলে যেসব সাধারণ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তা হলো—খাদ্য গ্রহণ হ্রাস, দুধ উৎপাদন ও দুধের চর্বি হ্রাস, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং প্রজননক্ষমতা হ্রাস।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রাণীদের দেহে হিট স্ট্রেস হয়, যা তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। খাদ্য গ্রহণ কম হওয়ার কারণে প্রাণীরা পর্যাপ্ত শক্তি পায় না, ফলে কাজ করার ক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া গর্ভধারণের হার কমে যায় এবং জন্মানো বাছুরের শরীরের ওজন কম হয়। পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে প্রাণীদের দুধ বা মাংসের পুষ্টিমান কমে যায়। শারীরিক স্ট্রেসের কারণে প্রাণীরা কম পরিমাণে দুধ উৎপাদন করে বা মাংসের গুণগত মান কমে যায়। অতিরিক্ত তাপের সরাসরি প্রভাবে ৬৫ শতাংশ দুধ উৎপাদন কমে যায়। এ ছাড়া দুধে প্রোটিনের পরিমাণ কমতে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন রোগজীবাণু ও প্যারাসাইটের বিস্তার বাড়ায়। উদ্ভূত পরিবেশে নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রাণীদের ওপর আক্রমণ করে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রাণীরা সহজেই সংক্রমণের শিকার হয়। এমনকি কলোস্ট্রামে ইমিউনোগ্লোবুলিনের ঘনত্বও কমে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ প্রভাব প্রাণিসম্পদ এবং কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রভাবের ফলে যেসব সাধারণ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তা হলো: (১) মাটির উর্বরতায় পরিবর্তন: বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং খরার কারণে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায়। পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি মাটির উর্বরতাকে প্রভাবিত করে, যা প্রাণিখাদ্যের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। (২) পরিবেশব্যবস্থার রূপান্তর: তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিবর্তনের ফলে চারণভূমি, বনভূমি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তিত হয়। পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রাণিপালন ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। (৩) সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: খাদ্য, পানি, এবং চারণভূমির জন্য মানুষের ও প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ে। সীমিত সম্পদে জীবিকার জন্য এই প্রতিযোগিতা বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় সংকট তৈরি করে। (৪) খাদ্যশস্যের উৎপাদন, গুণগত মান এবং প্রকারে পরিবর্তন: শস্যের বৃদ্ধি ও ফলন জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। খরা বা বন্যার কারণে শস্য উৎপাদন হ্রাস পায়। খাদ্যশস্যের গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় পশুর জন্য উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব হয়। (৫) চারণভূমির উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন: তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে চারণভূমি সংকুচিত হয়। ঘাস বা প্রাণিখাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় গবাদিপশুর পুষ্টির ঘাটতি হয়। (৬) রোগতত্ত্বের পরিবর্তনের কারণে নতুন রোগের উদ্ভব: পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে রোগবাহী পোকামাকড়ের বিস্তার বৃদ্ধি পায়। নতুন জীবাণু ও রোগের উদ্ভব হয়, যা প্রাণীদের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গবাদি প্রাণীর যত্নে যা যা করণীয় তা হলো: (১) তাপ এবং শক্তিশালী সূর্যালোক থেকে প্রাণীদের রক্ষা করা। (২) গবাদি প্রাণীর জন্য ঘন ছায়াযুক্ত গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা। (৩) খোলা এবং বায়ু চলাচল শেড তৈরি করা, যা প্রাণীদের আর্দ্রতা এবং সরাসরি সূর্যালোক থেকে রক্ষা করে। (৪) শেডের ছাদ পরিষ্কার এবং সাদা রঙের ব্যবস্থা করা (৫) গরমের দিনে প্রাণীদের শরীর ঠান্ডা রাখতে তাদের দিনে ১ থেকে ২ বার ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করানো, বিশেষ করে মহিষকে গোসল করানো এবং ধারায় ঝরনার পানি ছিটিয়ে দেওয়া। (৬) প্রাণীর জন্য সর্বদা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা ও দিনে বারবার পানি পরিবর্তন করা। (৭) পাখা, কুলার, ফোয়ারা ইত্যাদির মতো শেড কুলিং ডিভাইসের ব্যবস্থা করা। (৮) হালকা, সহজপাচ্য এবং তাজা খাবার সরবরাহ করা। সকালে ও সন্ধ্যায় খাবার দেওয়া যখন তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে (গ্রীষ্মকালে ১০টার আগে এবং বিকেল ৪-৫টার পরে খাবার সরবরাহ করা) (৯) শীত না হলে ঠান্ডা আবহাওয়ায় সকালে বা সন্ধ্যায় মাঠে চরাতে হবে। (১০) গরমে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই নিয়মিত ভ্যাকসিন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং যদি প্রাণী অসুস্থ হয়ে পড়ে, দ্রুত প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। (১১) গোয়ালঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং গরমে দুর্গন্ধ রোধের ব্যবস্থা করা। (১২) গবাদি প্রাণীদের জন্য তাপ–সহনশীল (শাহিওয়াল, ব্রাহমা, জেবু জাতের গরু তাপ-সহনশীল গবাদিপশুর জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়) জাত নির্বাচন করা ।

পরিশেষে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গবাদি প্রাণীদের জীবনে নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে। তবে সচেতনতা, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং সম্মিলিত উদ্যোগে কাজ করার মনোভাব আমাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সরকার, খামারি এবং গবেষকদের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই এবং নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলি, যা মানুষের পাশাপাশি গবাদি প্রাণীদের জীবনও সুরক্ষিত করবে।

ড.

এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে

বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে একধরনের আলোচনা প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক চুক্তি গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আলোচনার পরিধি, কাঠামো ও অংশগ্রহণকারীদের বাছাই কতটা ন্যায়সংগত ও প্রতিনিধিত্বমূলক হচ্ছে?

বাংলাদেশ এখন একধরনের রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক নির্বাচন ছিনতাই করেছে, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করেছে, গুম-খুন চালিয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা–কর্মী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র–জনতার ওপর সহিংস হামলা চালায়। যেভাবে এই হামলা চালানো হয়েছিল, তা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নয়।

আরও পড়ুনক্ষমা না চাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই২০ অক্টোবর ২০২৪

এ রকম বাস্তবতার মধ্যেও আমরা যদি শুধু শাসক দলটির পতনকেই গণতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় ধরে নিই, তাহলে তা হবে একটি ‘অর্ধসত্য’। কারণ, কোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা শুধু সরকার বা প্রশাসনই তৈরি করে না, তা একটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক কাঠামোও গড়ে তোলে।

এই কাঠামোর অংশ হয়ে যায় কিছু গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও—যারা হয়তো সরাসরি দমননীতি চালায়নি; কিন্তু চুপ থেকেছে, কিছু না দেখে থাকার ভান করেছে কিংবা নিরাপত্তা ও সুযোগের বিনিময়ে নির্যাতনকে বৈধতা দিয়েছে।

এই মানসিক কাঠামোর ভাঙন কেবল একজন শাসকের পতনেই শেষ হয় না; এটি সম্পূর্ণ হয়, যখন আমরা সাহস করে সেই মানুষদের কথাও বলি—যারা সরাসরি অন্যায় করেনি, কিন্তু চুপ থেকেছে বা নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে অন্যায় মেনে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? আমরা কি শুধু অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব, নাকি একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার কথা ভাবব?

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর গ্রামগঞ্জের কর্মী-সমর্থকেরা কী ভাবছেন০৬ জুন ২০২৫একটি ‘সরল’ প্রশ্ন

 ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচন। এ কারণে এ নির্বাচনগুলোর ভোটের ফলাফল বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আমার প্রশ্ন একেবারে মৌলিক এবং সরল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছিল। দেশের অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার একাধিকবার এই দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।

এবার যখন একটি নতুন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সূচনা হচ্ছে, তখন কি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থান, চিন্তা ও মতামত পুরোপুরি উপেক্ষা করা হবে—এই প্রশ্নটি হয়তো অনেকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন না।

কেউ কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছেন—যেন তাঁদের গায়ে ‘দোসর’ বা ‘দালাল’–জাতীয় কোনো ট্যাগ না লেগে যায়। এ এক নতুন ধরনের পরিস্থিতি, যেখানে সমালোচনার বদলে চলে প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ আর কণ্ঠ রুদ্ধ করার প্রতিযোগিতা!

অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলকে কেন সুযোগ দেব? এই দলের সমর্থকেরা এখনো খোলাখুলিভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চায়নি। এই ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর যে এই দলের সমর্থকেরা কীভাবে এতটা অনুশোচনাহীন হতে পারে? তারা আত্মসমালোচনা না করে এখনো ‘কনস্পাইরেসি থিওরি’ (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে।

কিন্তু আমরা কি প্রশ্ন তোলা বন্ধ করে দেব? এই প্রেক্ষাপটেই বরং আমাদের আরও বেশি করে প্রশ্ন করতে হবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে আমাদের সামষ্টিক ভূমিকা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।

বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশ্বাসী দল বা মতকে সমর্থন করেন, নির্বাচনের সময় এই মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ভোট দেন। আমরা কি পরিপক্ব ও দায়িত্বশীল উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করে তাঁদেরকে ঐকমত্যের আলোচনার মঞ্চে আনতে পারতাম না?

আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে০৭ জুলাই ২০২৫আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

বিশ্বজুড়ে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর যদি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের সময় শুধু প্রতিশোধ বা একচেটিয়া পক্ষপাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে তা খুব কম ক্ষেত্রেই টেকসই হয়। সফল এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন হয় আলোচনার, ক্ষমা ও অংশগ্রহণের এক প্রজ্ঞাপূর্ণ ভারসাম্য।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের পতনের পর নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্যোগে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল, শুধু অপরাধী চিহ্নিত করা নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে বিভক্ত জাতিকে পুনর্মিলনের দিকে নিয়ে আসা।

 একইভাবে রুয়ান্ডার ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর ‘গাকাকা আদালত’ নামে একধরনের ‘কমিউনিটি বেইজড’ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যেখানে অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি সহাবস্থানের নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়।

লাতিন আমেরিকার বহু দেশেও ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন ফোরাম’-এর মতো কাঠামো দেখা গেছে; যেখানে অপরাধ, অপরাধী ও অনুশোচনা—সব কিছুকে যুক্ত করে সমাজে একটি নতুন সম্মিলিত চুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরও পড়ুনজাতিসংঘের প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগের সামনে কী অপেক্ষা করছে১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতিমান পণ্ডিত আরেন্ড লাইপহার্ট তাঁর ‘কনসোসিয়েশনাল ডেমোক্রেসি’ তত্ত্বে বলেন, বিভক্ত সমাজে যদি টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়, তবে সব বড় গোষ্ঠীকেই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তারা পূর্বতন শাসকের সমর্থক হোক বা না হোক।

একইভাবে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্র্যাটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি বইয়ে দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ তখনই টেকে, যখন নতুন শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে শত্রু নয় বরং অংশীদার হিসেবে দেখে।

বর্তমানে ঐকমত্যের আলোচনা প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন; কিন্তু যাঁরা কোনো দলের মধ্যে নেই, তাঁদের জন্য একটি স্বাধীন ও সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের নেই অনুশোচনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা১১ নভেম্বর ২০২৪বর্তমান বাস্তবতা ও রাজনৈতিক পূর্বাভাস

অনেকেই মনে করছেন যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না কিংবা করবে না। আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগ সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দলটি পুরোপুরি নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটেনি। কাজেই ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো নাম বা কাঠামোয় অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাধ্যমে হলেও দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে—এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যিনি সব সময় মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সামাজিক সংহতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকার এবং বক্তৃতায় ইউনূস কখনোই আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেননি। তিনি বরং আওয়ামী লীগকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে দলটি গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে।

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে৩০ অক্টোবর ২০২৪

এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ইউনূসের মধ্যে একধরনের ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন’ কৌশল কাজ করছে, যেখানে অপরাধের বিচার হবে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করা হবে না।

এ ছাড়া জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেও দেখা যাচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার চাইলেও দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত হয়েছে, তবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন এবং পূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।’

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের পক্ষে থাকলেও রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নির্মূলের বিপক্ষে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সব গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনই হলো বাংলাদেশের জন্য বৈধতা পুনঃস্থাপনের একমাত্র পথ।

আগামী নির্বাচন যদি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল আসবে কি না—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, ইউনূসের মতো একজন সংবেদনশীল নেতার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করেই কি নির্বাচন হবে?

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট পেতে পারে, কিছু জরিপে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। এমন একটি দল, যাদের শতকরা ১৫-২০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেই দলের সমর্থক বা প্রতিনিধিদের একেবারে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক রূপরেখা কতটা যুক্তিসংগত বা টেকসই হবে—তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন তোলা দরকার।

আরও পড়ুনভারতের নীতিতে আওয়ামী লীগ–নির্ভরতা ও অপতথ্যের রাজনীতি০৫ ডিসেম্বর ২০২৪কিছু জরুরি প্রশ্ন

এই পরিস্থিতিতে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা হত্যা, সন্ত্রাস, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল না, তারা কি একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় ভিন্ন নামে অংশ নিতে পারবে? তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা কি ঠিক হবে? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ধর্মনিরপেক্ষ ভোটার এবং একসময় আওয়ামী লীগ-ঘরানার আদর্শে বিশ্বাসী অনেক নাগরিক এখন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সমাজে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। তাহলে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না?

ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এই মত বা অবস্থানগুলো কোথাও দৃশ্যমান নয়। কমিশন কি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী কাঠামো গঠনের বিষয়টি আমলে নেবে না? আমরা কি এমন একটি প্রক্রিয়া দেখছি, যা ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি সংকট তৈরি করছে?

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব

আরও পড়ুনআওয়ামী সমর্থকেরা কাকে ভোট দেবে২৮ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ