জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ‘জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানবতার জন্য একটি অস্তিত্ব সংকট’—এই সত্যটা কি আমরা উপলব্ধি করছি? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং গবাদি প্রাণীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে।

জলবায়ু পরিবর্তন গবাদি প্রাণীর জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে, যা খাদ্যনিরাপত্তা এবং কৃষি অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং পরিবেশগত পরিবর্তন গবাদিপশুর স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা এবং প্রজননক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব ফেলে। দুগ্ধজাত গবাদি প্রাণীর ওপর জলবায়ুগত প্রভাবের ফলে যেসব সাধারণ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তা হলো—খাদ্য গ্রহণ হ্রাস, দুধ উৎপাদন ও দুধের চর্বি হ্রাস, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং প্রজননক্ষমতা হ্রাস।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রাণীদের দেহে হিট স্ট্রেস হয়, যা তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। খাদ্য গ্রহণ কম হওয়ার কারণে প্রাণীরা পর্যাপ্ত শক্তি পায় না, ফলে কাজ করার ক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া গর্ভধারণের হার কমে যায় এবং জন্মানো বাছুরের শরীরের ওজন কম হয়। পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে প্রাণীদের দুধ বা মাংসের পুষ্টিমান কমে যায়। শারীরিক স্ট্রেসের কারণে প্রাণীরা কম পরিমাণে দুধ উৎপাদন করে বা মাংসের গুণগত মান কমে যায়। অতিরিক্ত তাপের সরাসরি প্রভাবে ৬৫ শতাংশ দুধ উৎপাদন কমে যায়। এ ছাড়া দুধে প্রোটিনের পরিমাণ কমতে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন রোগজীবাণু ও প্যারাসাইটের বিস্তার বাড়ায়। উদ্ভূত পরিবেশে নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রাণীদের ওপর আক্রমণ করে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রাণীরা সহজেই সংক্রমণের শিকার হয়। এমনকি কলোস্ট্রামে ইমিউনোগ্লোবুলিনের ঘনত্বও কমে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ প্রভাব প্রাণিসম্পদ এবং কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রভাবের ফলে যেসব সাধারণ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তা হলো: (১) মাটির উর্বরতায় পরিবর্তন: বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং খরার কারণে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায়। পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি মাটির উর্বরতাকে প্রভাবিত করে, যা প্রাণিখাদ্যের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। (২) পরিবেশব্যবস্থার রূপান্তর: তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিবর্তনের ফলে চারণভূমি, বনভূমি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তিত হয়। পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রাণিপালন ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। (৩) সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: খাদ্য, পানি, এবং চারণভূমির জন্য মানুষের ও প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ে। সীমিত সম্পদে জীবিকার জন্য এই প্রতিযোগিতা বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় সংকট তৈরি করে। (৪) খাদ্যশস্যের উৎপাদন, গুণগত মান এবং প্রকারে পরিবর্তন: শস্যের বৃদ্ধি ও ফলন জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। খরা বা বন্যার কারণে শস্য উৎপাদন হ্রাস পায়। খাদ্যশস্যের গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় পশুর জন্য উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব হয়। (৫) চারণভূমির উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন: তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে চারণভূমি সংকুচিত হয়। ঘাস বা প্রাণিখাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় গবাদিপশুর পুষ্টির ঘাটতি হয়। (৬) রোগতত্ত্বের পরিবর্তনের কারণে নতুন রোগের উদ্ভব: পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে রোগবাহী পোকামাকড়ের বিস্তার বৃদ্ধি পায়। নতুন জীবাণু ও রোগের উদ্ভব হয়, যা প্রাণীদের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গবাদি প্রাণীর যত্নে যা যা করণীয় তা হলো: (১) তাপ এবং শক্তিশালী সূর্যালোক থেকে প্রাণীদের রক্ষা করা। (২) গবাদি প্রাণীর জন্য ঘন ছায়াযুক্ত গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা। (৩) খোলা এবং বায়ু চলাচল শেড তৈরি করা, যা প্রাণীদের আর্দ্রতা এবং সরাসরি সূর্যালোক থেকে রক্ষা করে। (৪) শেডের ছাদ পরিষ্কার এবং সাদা রঙের ব্যবস্থা করা (৫) গরমের দিনে প্রাণীদের শরীর ঠান্ডা রাখতে তাদের দিনে ১ থেকে ২ বার ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করানো, বিশেষ করে মহিষকে গোসল করানো এবং ধারায় ঝরনার পানি ছিটিয়ে দেওয়া। (৬) প্রাণীর জন্য সর্বদা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা ও দিনে বারবার পানি পরিবর্তন করা। (৭) পাখা, কুলার, ফোয়ারা ইত্যাদির মতো শেড কুলিং ডিভাইসের ব্যবস্থা করা। (৮) হালকা, সহজপাচ্য এবং তাজা খাবার সরবরাহ করা। সকালে ও সন্ধ্যায় খাবার দেওয়া যখন তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে (গ্রীষ্মকালে ১০টার আগে এবং বিকেল ৪-৫টার পরে খাবার সরবরাহ করা) (৯) শীত না হলে ঠান্ডা আবহাওয়ায় সকালে বা সন্ধ্যায় মাঠে চরাতে হবে। (১০) গরমে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই নিয়মিত ভ্যাকসিন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং যদি প্রাণী অসুস্থ হয়ে পড়ে, দ্রুত প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। (১১) গোয়ালঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং গরমে দুর্গন্ধ রোধের ব্যবস্থা করা। (১২) গবাদি প্রাণীদের জন্য তাপ–সহনশীল (শাহিওয়াল, ব্রাহমা, জেবু জাতের গরু তাপ-সহনশীল গবাদিপশুর জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়) জাত নির্বাচন করা ।

পরিশেষে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গবাদি প্রাণীদের জীবনে নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে। তবে সচেতনতা, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং সম্মিলিত উদ্যোগে কাজ করার মনোভাব আমাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সরকার, খামারি এবং গবেষকদের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই এবং নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলি, যা মানুষের পাশাপাশি গবাদি প্রাণীদের জীবনও সুরক্ষিত করবে।

ড.

এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

সিদ্ধিরগঞ্জে পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে ৩ এনসিপি কর্মীকে ছুরিকাঘাত

সিদ্ধিরগঞ্জে এনসিপি প্রার্থীর পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে তিন এনসিপি কর্মীকে ছুরিকাঘাতে আহত করার অভিযোগ উঠেছে।

আহতরা হলেন, জেলা ছাত্রশক্তির পদপ্রার্থী রিয়াদ (২৪), বায়েজিদ (২১) ও তামিম (২৩)। তাদের প্রথমে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে ও পরে খানপুর ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় থানায় মামলা প্রস্তুতি নিচ্ছে ভুক্তভোগীরা।

জেলা এনসিপির সদস্য রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এনসিপির দলীয় প্রার্থী আবদুল্লাহ আল আমিনের পোস্টারিং চলছিলো। সাইনবোর্ডের মিতালী মার্কেট এলাকায় পোস্টারিং করার সময় অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি বাঁধা দেয়। এর প্রতিবাদ করলে ছাত্রশক্তির কর্মী তামিমকে মারধর করে এবং তার কাছ থেকে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।’

বুধবার অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে দুপুর ২ টায় মিতালী মার্কেটে আসে তামিম, রিয়াদ ও বায়েজিদ। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করতে গেলে ২৫/৩০ জনের একটি দল সংঘবদ্ধ ভাবে হামলা চালায়। ছুরিকাঘাত করে গুরুত্বর জখম করা হয় তাদের। পরে এনসিপির নেতাকর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে সাইনবোর্ডস্থ প্রো একটিভ হাসপাতাল ও পরে শহরের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’

এই বিষয়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, ‘তারা রাতে আমার পোস্টার লাগানোর সময় মারধরের শিকার হয়। কারা মারধর করেছে সেই ফুটেজ সংগ্রহ করতে গেলে ফের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। এরা মিতালী মার্কেটের কর্মচারী ও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে চলে বলে শুনেছি। 

এই ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করবো আমরা। এখানে নির্বাচনী পরিবেশ যে কোন অবস্থায় আছে তা এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয়। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবী জানাচ্ছি।’

ঘটনার বিষয়টি অবগত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল বারিক। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী সহ এনসিপির নেতাকর্মীরা থানায় এসেছেন। তাদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত জেনে নিচ্ছি। তথ্য প্রমান পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ