যে কারণে সরকারি সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতেই হবে
Published: 12th, May 2025 GMT
পঞ্চগড়ের রিয়াদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সুযোগ পেয়েছেন। ফল প্রকাশের দিন ওয়েবসাইটে গিয়ে তিনি নিজের রোল নম্বর আর জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে খবরটা জেনেছিলেন।
এরপর বাবা-ছেলের মধ্যে কথা হয়। রিয়াদের বাবা (যিনি নিজেও একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন) স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, তাঁদের সময়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে বাসে করে ঢাকায় যেতে হতো। সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম সংগ্রহ করতে হতো। ফরম জমা দিতে হতো হাতে হাতে। আর ফি জমা দিতে দীর্ঘ সময় ব্যাংকের সামনে অপেক্ষা করতে হতো। শুধু যাতায়াত আর ঢাকায় থাকার খরচেই অনেক টাকার প্রয়োজন হতো।
এখন মুঠোফোনেই ভর্তি ফরম পূরণ করা যায়, ফি দেওয়া যায় অনলাইনে, প্রবেশপত্রও ঘরে বসে ডাউনলোড করা যায়। যাতায়াত নেই, লাইনে দাঁড়ানো নেই, বাড়তি খরচও নেই।
আরও পড়ুন‘একটুর জন্য’ আটকে যায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারি সেবা০৭ এপ্রিল ২০২৪রিয়াদের গল্পটি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, প্রযুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সেবার রূপান্তরেরও একটি প্রতীক। যেখানে একসময় ভর্তি ফরম সংগ্রহে ঢাকায় আসা, ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন, অতিরিক্ত যাতায়াত খরচের বোঝা ছিল নিত্যদিনের সংগ্রাম, সেখানে আজ একটি স্মার্টফোনই সব ঝামেলার সমাধান।
জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, পাসপোর্টের আবেদন, জমিজমার খাজনা দেওয়া, আদালতের মামলার আপডেট জানা—এখন সবই অনলাইনে সম্ভব।
এ পরিবর্তন সরকারি সেবার প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সম্ভবপর। কিন্তু তার গতি ও গভীরতা এখনো প্রত্যাশার তুলনায় নগণ্য।
আগে যেখানে একটি কাজ করতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা অফিস, জেলা শহর ঘুরতে হতো, সেখানে এখন স্মার্টফোন অথবা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকেই আবেদন করা যায়, ফি দেওয়া যায়, তথ্য যাচাই করা যায়।
এতে সময় বাঁচে, যাতায়াত খরচ কমে আর অফিস ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকারও হতে হয় না।
সরকারি সেবায় প্রযুক্তি: অর্জন ও অপ্রাপ্তিজন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে পাসপোর্টের আবেদন, জমির খাজনা পরিশোধ, আদালতের মামলা ট্র্যাকিং—এসব অনলাইন সেবার বিস্তার নাগরিক জীবনে স্বস্তি এনেছে। তবে এ অর্জন আংশিক।
অনেক সরকারি ওয়েবসাইটের ডিজাইন পুরোনো, সার্ভার অকার্যকর, তথ্য হালনাগাদ হয় না। স্বাস্থ্য, ভূমি বা পৌরসভার সেবায় এখনো মানুষকে কাউন্টারে লাইনে দাঁড়াতে হয়, কখনোবা অনিচ্ছাকৃতভাবে দালালের শরণাপন্ন হতে হয়।
ভূমি অফিসে রেকর্ড সংশোধন করতে গেলে অনলাইন ফরম জমা দেওয়ার পরও সিলের জন্য ইউনিয়ন থেকে জেলা অফিস ঘুরতে হয়।
এ দুর্বলতার মূল কারণ, প্রযুক্তি বাস্তবায়নে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, দক্ষ জনবলের অভাব এবং সমন্বয়হীনতা।
আরও পড়ুনক্যাশলেস হওয়ার শর্তই কি হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ‘অ্যাকিলিস হিল’১৭ জুন ২০২৪বাজেটে কী চাই১.
অবকাঠামো আধুনিকীকরণ:
সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও অ্যাপকে ব্যবহারবান্ধব, নিরাপদ ও সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হবে। ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটা সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে ডিজিটাল সেবার গতি ও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
আইসিটি মন্ত্রণালয়কে বাড়তি বাজেট দিয়ে ‘ই-গভর্ন্যান্স মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রযুক্তি রোডম্যাপ থাকবে। এ ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই।
২. মানবসম্পদ উন্নয়ন:
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিজিটাল লিটারেসি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি জানাকেও বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেটা সরকারি অর্থ ও সম্পত্তি সুরক্ষায় কাজে আসবে।
আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের কোটা বাড়ানো এবং প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হবে।
আরও পড়ুনতথ্যপ্রযুক্তি খাত: পাবলিক সফটওয়্যার প্রকল্পের সমস্যার কারণ কী২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫৩. ইনোভেশন ফান্ড গঠন:
স্থানীয় স্টার্টআপ ও টেক কোম্পানিগুলোকে সরকারি সেবার সফটওয়্যার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ই-জুডিশিয়ারি’ প্ল্যাটফর্মটি আরও উন্নত করতে আইন মন্ত্রণালয় স্থানীয় ডেভেলপারদের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
৪. স্মার্ট সার্ভিল্যান্স ও ডেটা অ্যানালিটিকস:
চীনের বিভিন্ন শহরে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম অপরাধ দমনে কার্যকর। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে প্রতিটি শহরে ‘স্মার্ট সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক’ স্থাপন করা যেতে পারে।
পুলিশ ডেটাবেইজের সঙ্গে ইলেকট্রনিক নিবন্ধন যুক্ত করে রিয়েল-টাইম ক্রাইম ম্যাপিং চালু করা যায়।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিই দুর্নীতির প্রতিষেধক। প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা বাড়লে ঘুষ-দুর্নীতি কমবে। যেমন ডিজিটাল লেনদেন। ভূমি অফিসে সব লেনদেন যদি ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে রেকর্ড করা হয়, তাহলে জালিয়াতি রোধ করা সহজ হবে।
আবার ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের দরপত্র অনলাইনে উন্মুক্ত করলে দালাল চক্রের হস্তক্ষেপ কমবে।
ট্যাক্স সংগ্রহ, ভাতা বিতরণ বা লাইসেন্স ইস্যুতে রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ) চালু হলে মানবীয় ভুল ও দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, সরকারি সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার ৩০ শতাংশ দক্ষতা বাড়ায় এবং ২৫ শতাংশ অপচয় কমায়। বাংলাদেশে যদি ই-গভর্ন্যান্স পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।
এ অর্থ স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অবকাঠামো খাতে পুনর্বিনিয়োগ করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যাবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটের ১০ শতাংশ আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়, যার অর্ধেক ব্যয় হবে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরে। ই-গভর্ন্যান্স কমিশন গঠন করে সব মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় করা যেতে পারে। স্টার্টআপ ফান্ডে পরীক্ষামূলক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা যায়।ডিজিটাল সিস্টেম হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি সেলকে শক্তিশালী করতে হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইন্টারনেট–সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ভিলেজ’ প্রকল্প জোরদার করতে হবে।
মোবাইল ব্যাংকিং, ই-ফাইলিংয়ের মতো সেবার ব্যবহার বাড়াতে মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালানো দরকার।
পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে মূলধারার ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটের ১০ শতাংশ আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়, যার অর্ধেক ব্যয় হবে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরে।
ই-গভর্ন্যান্স কমিশন গঠন করে সব মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় করা যেতে পারে। স্টার্টআপ ফান্ডে পরীক্ষামূলক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা যায়।
এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করা রিয়াদের গল্প শুধু একটি সাফল্যের কাহিনি নয়, প্রমাণ করে, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কতটা সম্ভব। কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণে সরকারি খাতকে প্রাইভেট সেক্টরের গতিতে এগোতে হবে।
আগামী বাজেটে প্রযুক্তিকে কেবল একটি ‘খাত’ হিসেবে না দেখে সব উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি, তথা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারই নিশ্চিত করবে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, সাম্য ও ন্যায্যতা—যে চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি।
এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই গভর ন য ন স র ব যবহ র ব র জন য পর ক ষ বর দ দ ত করত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা চলছেই, আরও ৯৫ ফিলিস্তিনি নিহত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতা চলছেই। বাদ যাচ্ছে না সেখানে অবস্থিত ক্যাফে, স্কুল ও ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র। ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান সাম্প্রতিক হামলায় আরও ৯৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে।
স্থানীয় সময় সোমবার গাজা শহর ও উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় এসব হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে শুধু আল-বাকা নামে এক সমুদ্র তীরবর্তী ক্যাফেতেই নিহত হন ৩৯ জন। খবর আল জাজিরারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের পূর্বসতর্কতা ছাড়াই সেখানে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। ক্যাফেটিতে নারী ও শিশুসহ অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন একটি জন্মদিন উদযাপন করতে। সেখানে নিহতদের মধ্যে এক সাংবাদিকও রয়েছেন। তার নাম ইসমাইল আবু হাতাব।
এদিকে গাজা শহরের ইয়াফা স্কুলে আশ্রয় নেওয়া কয়েকশ বাস্তুচ্যুত মানুষের ওপরও হামলা চালানো হয়। আবু জারাদে নামের একজন জানান, তারা হামলার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সরে যাওয়ার নোটিশ পান। তিনি বলেন, আমরা কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। গত ৬৩০ দিনেরও বেশি সময় ধরে আমরা কোনো সাহায্য পাইনি। প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি।
এছাড়া মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা শহীদ হাসপাতাল চত্বরে চালানো আরেক হামলায় আহত হন আরও অনেকে। সেখানে কয়েক হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। হামলার সময় আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা। অনেকেই দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হাসপাতালটিতে এর আগেও অন্তত ১০ বার হামলা হয়েছে।
আল জাজিরা বলছে, ত্রাণের আশায় দাঁড়ানো মানুষকে লক্ষ্য করেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিসে বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)’-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবারের জন্য অপেক্ষারত মানুষের ওপর চালানো হামলায় অন্তত ১৫ জন নিহত হন এবং ৫০ জন আহত হন।
ইসরায়েলের এই হামলার শিকার অধিকাংশই ছিলেন ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো সাধারণ ফিলিস্তিনি। জিএইচএফ গত মে মাসের শেষ দিকে সীমিত পরিসরে গাজায় ত্রাণ বিতরণ শুরু করার পর থেকে এসব কেন্দ্রে প্রায় প্রতিদিনই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এখন পর্যন্ত এসব হামলায় অন্তত ৬০০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৪ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনাদের সরাসরি নিরস্ত্র ত্রাণপ্রার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে বলা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সেনা জানিয়েছেন, অনেক সময় কোনো হুমকি না থাকলেও ত্রাণপ্রার্থীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতার নির্দেশ দেওয়া হয়।