পঞ্চগড়ের রিয়াদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সুযোগ পেয়েছেন। ফল প্রকাশের দিন ওয়েবসাইটে গিয়ে তিনি নিজের রোল নম্বর আর জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে খবরটা জেনেছিলেন।

এরপর বাবা-ছেলের মধ্যে কথা হয়। রিয়াদের বাবা (যিনি নিজেও একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন) স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, তাঁদের সময়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে বাসে করে ঢাকায় যেতে হতো। সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম সংগ্রহ করতে হতো। ফরম জমা দিতে হতো হাতে হাতে। আর ফি জমা দিতে দীর্ঘ সময় ব্যাংকের সামনে অপেক্ষা করতে হতো। শুধু যাতায়াত আর ঢাকায় থাকার খরচেই অনেক টাকার প্রয়োজন হতো।

এখন মুঠোফোনেই ভর্তি ফরম পূরণ করা যায়, ফি দেওয়া যায় অনলাইনে, প্রবেশপত্রও ঘরে বসে ডাউনলোড করা যায়। যাতায়াত নেই, লাইনে দাঁড়ানো নেই, বাড়তি খরচও নেই।

আরও পড়ুন‘একটুর জন্য’ আটকে যায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারি সেবা০৭ এপ্রিল ২০২৪

রিয়াদের গল্পটি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, প্রযুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সেবার রূপান্তরেরও একটি প্রতীক। যেখানে একসময় ভর্তি ফরম সংগ্রহে ঢাকায় আসা, ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন, অতিরিক্ত যাতায়াত খরচের বোঝা ছিল নিত্যদিনের সংগ্রাম, সেখানে আজ একটি স্মার্টফোনই সব ঝামেলার সমাধান।

জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, পাসপোর্টের আবেদন, জমিজমার খাজনা দেওয়া, আদালতের মামলার আপডেট জানা—এখন সবই অনলাইনে সম্ভব।

এ পরিবর্তন সরকারি সেবার প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সম্ভবপর। কিন্তু তার গতি ও গভীরতা এখনো প্রত্যাশার তুলনায় নগণ্য।

আগে যেখানে একটি কাজ করতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা অফিস, জেলা শহর ঘুরতে হতো, সেখানে এখন স্মার্টফোন অথবা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকেই আবেদন করা যায়, ফি দেওয়া যায়, তথ্য যাচাই করা যায়।

এতে সময় বাঁচে, যাতায়াত খরচ কমে আর অফিস ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকারও হতে হয় না।

সরকারি সেবায় প্রযুক্তি: অর্জন ও অপ্রাপ্তি

জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে পাসপোর্টের আবেদন, জমির খাজনা পরিশোধ, আদালতের মামলা ট্র্যাকিং—এসব অনলাইন সেবার বিস্তার নাগরিক জীবনে স্বস্তি এনেছে। তবে এ অর্জন আংশিক।

অনেক সরকারি ওয়েবসাইটের ডিজাইন পুরোনো, সার্ভার অকার্যকর, তথ্য হালনাগাদ হয় না। স্বাস্থ্য, ভূমি বা পৌরসভার সেবায় এখনো মানুষকে কাউন্টারে লাইনে দাঁড়াতে হয়, কখনোবা অনিচ্ছাকৃতভাবে দালালের শরণাপন্ন হতে হয়।

ভূমি অফিসে রেকর্ড সংশোধন করতে গেলে অনলাইন ফরম জমা দেওয়ার পরও সিলের জন্য ইউনিয়ন থেকে জেলা অফিস ঘুরতে হয়।

এ দুর্বলতার মূল কারণ, প্রযুক্তি বাস্তবায়নে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, দক্ষ জনবলের অভাব এবং সমন্বয়হীনতা।

আরও পড়ুনক্যাশলেস হওয়ার শর্তই কি হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ‘অ্যাকিলিস হিল’১৭ জুন ২০২৪বাজেটে কী চাই

১.

অবকাঠামো আধুনিকীকরণ:
সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও অ্যাপকে ব্যবহারবান্ধব, নিরাপদ ও সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হবে। ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটা সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে ডিজিটাল সেবার গতি ও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।

আইসিটি মন্ত্রণালয়কে বাড়তি বাজেট দিয়ে ‘ই-গভর্ন্যান্স মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রযুক্তি রোডম্যাপ থাকবে। এ ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই।

২. মানবসম্পদ উন্নয়ন:
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিজিটাল লিটারেসি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি জানাকেও বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেটা সরকারি অর্থ ও সম্পত্তি সুরক্ষায় কাজে আসবে।

আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের কোটা বাড়ানো এবং প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হবে।

আরও পড়ুনতথ্যপ্রযুক্তি খাত: পাবলিক সফটওয়্যার প্রকল্পের সমস্যার কারণ কী২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

৩. ইনোভেশন ফান্ড গঠন:

স্থানীয় স্টার্টআপ ও টেক কোম্পানিগুলোকে সরকারি সেবার সফটওয়্যার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ই-জুডিশিয়ারি’ প্ল্যাটফর্মটি আরও উন্নত করতে আইন মন্ত্রণালয় স্থানীয় ডেভেলপারদের সঙ্গে কাজ করতে পারে।

৪. স্মার্ট সার্ভিল্যান্স ও ডেটা অ্যানালিটিকস:
চীনের বিভিন্ন শহরে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম অপরাধ দমনে কার্যকর। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে প্রতিটি শহরে ‘স্মার্ট সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক’ স্থাপন করা যেতে পারে।

পুলিশ ডেটাবেইজের সঙ্গে ইলেকট্রনিক নিবন্ধন যুক্ত করে রিয়েল-টাইম ক্রাইম ম্যাপিং চালু করা যায়।

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিই দুর্নীতির প্রতিষেধক। প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা বাড়লে ঘুষ-দুর্নীতি কমবে। যেমন ডিজিটাল লেনদেন। ভূমি অফিসে সব লেনদেন যদি ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে রেকর্ড করা হয়, তাহলে জালিয়াতি রোধ করা সহজ হবে।

আবার ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের দরপত্র অনলাইনে উন্মুক্ত করলে দালাল চক্রের হস্তক্ষেপ কমবে।

ট্যাক্স সংগ্রহ, ভাতা বিতরণ বা লাইসেন্স ইস্যুতে রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ) চালু হলে মানবীয় ভুল ও দুর্নীতি হ্রাস পাবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, সরকারি সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার ৩০ শতাংশ দক্ষতা বাড়ায় এবং ২৫ শতাংশ অপচয় কমায়। বাংলাদেশে যদি ই-গভর্ন্যান্স পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।

এ অর্থ স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অবকাঠামো খাতে পুনর্বিনিয়োগ করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যাবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটের ১০ শতাংশ আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়, যার অর্ধেক ব্যয় হবে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরে। ই-গভর্ন্যান্স কমিশন গঠন করে সব মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় করা যেতে পারে। স্টার্টআপ ফান্ডে পরীক্ষামূলক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা যায়।

ডিজিটাল সিস্টেম হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি সেলকে শক্তিশালী করতে হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইন্টারনেট–সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ভিলেজ’ প্রকল্প জোরদার করতে হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং, ই-ফাইলিংয়ের মতো সেবার ব্যবহার বাড়াতে মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালানো দরকার।

পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে ব‍্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে মূলধারার ব‍্যাংকিং সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটের ১০ শতাংশ আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়, যার অর্ধেক ব্যয় হবে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরে।

ই-গভর্ন্যান্স কমিশন গঠন করে সব মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় করা যেতে পারে। স্টার্টআপ ফান্ডে পরীক্ষামূলক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা যায়।

এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করা রিয়াদের গল্প শুধু একটি সাফল্যের কাহিনি নয়, প্রমাণ করে, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কতটা সম্ভব। কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণে সরকারি খাতকে প্রাইভেট সেক্টরের গতিতে এগোতে হবে।

আগামী বাজেটে প্রযুক্তিকে কেবল একটি ‘খাত’ হিসেবে না দেখে সব উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি, তথা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারই নিশ্চিত করবে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, সাম‍্য ও ন্যায‍্যতা—যে চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি।

এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ই গভর ন য ন স র ব যবহ র ব র জন য পর ক ষ বর দ দ ত করত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, নিবন্ধন স্থগিত

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এসব সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই দিনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ–সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ অনুযায়ী এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ গতকাল সোমবার রাতে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ সংগঠন এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কী কারণে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, ‘এটা হলো যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে বলে বিজ্ঞপ্তি, প্রজ্ঞাপন, সেটার ধারাবাহিকতায় আমরা এখানে এটা করেছি।’

সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তার (সংগঠন) যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে গত রোববার সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ–২০২৫ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। আগের আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারত। সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান ছিল না। নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়, সত্তার যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যাবে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী, ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝায়।

এটা হলো যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে বলে বিজ্ঞপ্তি, প্রজ্ঞাপন, সেটার ধারাবাহিকতায় আমরা এখানে এটা করেছি। আখতার আহমেদ, জ্যেষ্ঠ সচিব, নির্বাচন কমিশন

এর আগে গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।

এ ছাড়া সেদিন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীন সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্র ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয় উপদেষ্টা পরিষদ।

প্রজ্ঞাপনে যা আছে

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কাজ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং এসব অভিযোগ দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব অপরাধের অভিযোগে সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং দেশের ফৌজদারি আদালতে বহুসংখ্যক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারপত্র বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্যান্য নেতা–কর্মীর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য দেওয়া, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া এসব কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। দলটি এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। এভাবে বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এ ছাড়া সরকার যুক্তিসংগতভাবে মনে করে, সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯–এর ধারা ১৮ (১)–এর ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সমীচীন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ