এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত কেন্দ্র করে রাজস্ব প্রশাসনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আজ বুধবার থেকে সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে লাগাতার অসহযোগিতা করা হবে। সেই সঙ্গে তাদের তিনটি প্রধান দাবি হলো—জারিকৃত অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ওয়েবসাইটে প্রকাশ।

১২ মে সরকার এনবিআর বিলুপ্ত করার অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে এনবিআরের অধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা এক সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন। এর ধারাবাহিকতায় আজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এসব দাবি জানিয়েছে। এর আগে আজ দুপুরে এনবিআর কার্যালয়ে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা।

আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এত বড় প্রশাসনিক পরিবর্তন অত্যন্ত গোপন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি এনবিআরের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মতামত না নিয়ে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করা হয়। ফলে এর স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

এর আগে ১৪-১৫ ও ১৭-১৯ মে পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন দপ্তরে আংশিক কলমবিরতি পালন করা হয়। তবে ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে সভার কারণে কর্মসূচি এক দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল।

সভায় সীমিত আলোচনার সুযোগ, হতাশ প্রতিনিধিদল

২০ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। সভায় অর্থ উপদেষ্টা ছাড়াও দুজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্য, এনবিআরের সাবেক সদস্য, অর্থ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান সভায় উপস্থিত ছিলেন।

তবে প্রতিনিধিদলের অভিযোগ, ১৩ জনের মধ্যে মাত্র ২ জনকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থ উপদেষ্টা সভার শুরুতেই জানান, তিনি দীর্ঘ আলোচনা করবেন না এবং ছয় থেকে সাত মিনিটের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতে হবে।

সভায় রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলেন, জারিকৃত অধ্যাদেশ তাঁদের সুপারিশের প্রতিফলন নয়। তাঁরা এনবিআর অক্ষুণ্ন রেখে কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নতুন দুই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব নির্ধারণের পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে সভায় উপস্থিত দুজন উপদেষ্টা অধ্যাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন।

সভা শেষে অর্থ উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে জানান, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এই অধ্যাদেশ জারি হয়েছে এবং তা বহাল থাকবে। তবে পরামর্শক কমিটির মাধ্যমে কিছু বিষয় সমন্বয়ের চেষ্টা করা হবে। এমনকি তিনি এ–ও বলেন, আন্দোলন চলমান থাকবে কি না, তাতে কিছু আসে–যায় না। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ বলেছে, সভায় কথার সুযোগ না দিয়ে একতরফাভাবে ‘ফলপ্রসূ’ বলার প্রচেষ্টা তাদের আহত করেছে।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আন্দোলন আরও সংগঠিত করার লক্ষ্যে এনবিআরের তিন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে অ্যাডহক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। আগামীকাল বৃহস্পতিবার গ্রেড-১০ ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।

আন্দোলনকারীদের দাবি, এনবিআর চেয়ারম্যান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন না করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করেছেন। ফলে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

পরবর্তী কর্মসূচি

১.

২১ মে সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি পালন করা হবে;

২. ২২ মে দুপুরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান;

৩. ২২ মে এনবিআর এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিজ নিজ দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন। তবে রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এর আওতামুক্ত থাকবে;

৪. ২৪ ও ২৫ মে কাস্টম হাউস, এলসি স্টেশন ব্যতীত ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি। এই দুই দিন কাস্টম হাউস, এলসি স্টেশনগুলোয় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। তবে রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে;

৫. ২৬ মে থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত উপস থ সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের সেই ভয়াবহ রাতে যা ঘটেছিল

চা শ্রমিকদের মাতৃভূমিতে ফেরার আন্দোলন ইতিহাসে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। আজ ২০ মে, ১৯২১ সালের এই তারিখে চা শ্রমিকদের চাঁদপুর স্টেশন থেকে নিজ নিজ ভূমির দিকে যাত্রা করার কথা ছিল। অবশ্য শ্রমিক আসা শুরু হয়েছিল মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই।

শুরুর দিকে চাঁদপুর রেলস্টেশনে জড়ো হওয়া শ্রমিকেরা স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সহায়তায় গোয়ালন্দগামী জাহাজে উঠে পড়েন। ওই সময় চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সুশীল কুমার সিংহ। তিনি শ্রমিকদের সহযোগিতা করেছিলেন কিন্তু কিছুদিন পরেই  তৎকালীন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ম্যাকফরসন চাঁদপুর রেলস্টেশনে এসে হাজির হন। পরে ঘটনা নির্বিচারে হত্যার দিকে গড়ায়। তার নির্দেশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও গোর্খা সৈন্য স্টেশন ঘিরে ফেলে। ট্রেনের টিকেট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়, জাহাজের পাটাতন তুলে দিয়ে যাত্রীদের মেঘনায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

মোঃ আবুল হাসান অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সদস্য, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটি উপদেষ্টা, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন রাইজিংবিডিকে  বলেন, ‘‘চা শ্রমিকরা কলিমগঞ্জ রেলস্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন নারী ছোট শিশুদেরকে নিয়ে ট্রেনে রওনা দিতে পেরেছিলেন। পুরুষেরা হাঁটা শুরু করেছিলেন। কিছু মানুষ জাহাজে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং কিছু মানুষ জাহাজে উঠতেও পেরেছিলেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে তৎকালীন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের যে প্রতিনিধি ম্যাকফরসন সে চাঁদপুরে উপস্থিত হয়ে যাত্রীদের জাহাজে উঠতে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক শ্রমিক নদীতে ভেসে যান। এই ঘটনা  উনিশ, বিশ তারিখ জুড়ে হয়েছে। এবং রাতের বেলা ‘গোর্খা সৈন্য’ অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের ওপর আক্রমণটা করে অনেককে হত্যা করেছে। ’’

আরো পড়ুন:

ঈদের আগে পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

হিলিতে আরনু জুটমিল বন্ধ ঘোষণা, শ্রমিকেরা দিশেহারা

গোর্খা সৈন্য সম্পর্কে মোঃ আবুল হাসান জানান, এই চা শ্রমিকদেরকে যারা সংগ্রহ করেছেন তারা মূলত এক ধরণের দালাল। যেসব অঞ্চল থেকে চা শ্রমিকদেরকে আনা হয়েছে, পুরো প্রক্রিয়াতে একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। অনেকটা দাস কেনা-বেচার ব্যবসায়ের মতো। চা বাগানে শ্রমিকদেরকে আনার পরে এদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষকে মালিকপক্ষ বিশেষ বাহিনী হিসেবে বা গোর্খা পুলিশ হিসেবে ব্যবহার করতো। 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটি বড় অংশ ছিল অসহযোগ আন্দোলন। মুল্লুক চলো আন্দোলনও ছিল এক ধরণের অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনে চা শ্রমিকদের সম্পকৃক্ততা নানান ফর্মে, নানান মাত্রায় ছিল। মুল্লুক চলো আন্দোলন ঘিরে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটার পরে সে সময় কংগ্রেসের প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বস্ত্রীক চাঁদপুরে এসে বাকি ভূক্তভোগী শ্রমিকদের দেখে যান, খোঁজখবর নেন। 

‘‘ওই আন্দালনের জের ধরে সাড়ে চার হাজার রেল শ্রমিকদের টার্মিনেট করা হয়েছিল। তো এই সব ধর্মঘটে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের নানাভাবে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দিয়েছিলেন দীনবন্ধু, চার্লস অ্যান্ড রুলস। ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে টার্মিনেট করার মতো পরিস্থিতি কিছুদিন আগেও ছিল। আমাদেরকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে নানান সময়ে। জবরদস্তির ব্যাপারটা এখনও নানানভাবে আছে। বিমোট এরিয়াতে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলোতে নানা রকম জবরদস্তির নজির পাওয়া যায়।’’—যোগ করেন মোঃ আবুল হাসান

তিনি আরও বলেন, ‘‘কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পনেরো বছর আগেও এই জবরদস্তি ব্যাপারটা প্রবল ছিল। এমনকি  এখনও জবরদস্তি আছে। একজন চা শ্রমিক যদি চা বাগানে যে ধরণের মজুরি বা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় সে যদি এটা মেনে নিতে না চায় তাহলে আইনগতভাবে বাগানে থাকার সকল অধিকার হারাবে। ২০০৫,’০৭ এই সময়ে যেতাম তখন যাদেরকে সেন্টার করে আমরা যেতাম তাদেরকে নোটিশ করা হতো। বা গ্রাম চৌকিদার ডেকে নিয়ে শোকোজ করা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে টার্মিনেট করা; এই ধরণের পরিস্থিতি কিছুদিন আগেও ছিল।’’ 

বিশ্বের রাজনীতির সুফলগুলো এই চা শ্রমিকদের ঘরে না পৌঁছালেও কুফলগুলো কালে কালে, সময়ে সময়ে ঠিকই পৌঁছেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব থেকেও মুক্ত ছিলেন না তারা।

মোঃ আবুল হাসান বলেন, ‘‘মোটা দাগে বলতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে চা শিল্প যদিও লাভ করছিল কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের দোহাই দিয়ে যে ধরনের চুক্তিতে কিংবা সুযোগ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে চা শ্রমিকদের আনা হয়েছিল সেসব সুযোগ সুবিধাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’

‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে, মার্তৃভূমিতে ফিরতে পারেননি চা বাগানের শ্রমিকেরা। এখনও চলমান আইনের বিরুদ্ধে কথা বলার আইনী সুযোগ নেই কোনো শ্রমিকের। এরপরেও যেটুকু পরিবর্তন এসেছে তার পেছনে রয়েছে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের অনেক বড় প্রভাব।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের অসহযোগ
  • এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি ও অসহযোগ কর্মসূচির ডাক আন্দোলনকারীদের
  • এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও অসহযোগ কর্মসূচির ডাক আন্দোলনকারীদের
  • এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও অসহযোগ কর্মসূচির ডাক আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের
  • অসহযোগ কর্মসূচি ও চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের
  • ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের সেই ভয়াবহ রাতে যা ঘটেছিল
  • সাবেক উপাচার্যের দুর্নীতি তদন্তে অসহযোগিতা রাবি প্রশাসনের