অভিধানে স্বৈরাচারের মানে করা হয়েছে—‘নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করা’। কিন্তু স্বৈরাচারের বাস্তবসম্মত সংজ্ঞা হলো—এটি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিবিহীন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্যের চাওয়া-পাওয়া ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নিজের খেয়ালখুশি ও পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে অন্যের জীবন ও জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং দ্বিতীয় পক্ষকে এ অবস্থা মেনে নিতে বাধ্য করে। একটি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে স্বৈরাচার আসলে মানবতাবিরোধী অপসংস্কৃতি।

আমরা সাধারণত স্বৈরাচার ব্যাপারটিকে একটি রাজনীতি-সম্পৃক্ত বিষয় বলে ভেবে এসেছি। কিন্তু ব্যাপারটির সীমানা শুধু রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর বিস্তৃতি রয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। অন্য একটি মাত্রায় বিচার করলে স্বৈরাচার শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থাকতে পারে, এমন নয়। এর সদম্ভ উপস্থিতি সম্ভব ব্যক্তিগত বা সমাজজীবনেও। স্বৈরাচার কখনো কখনো স্থূলভাবে আত্মপ্রকাশ করে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে এর অবস্থান খুব সূক্ষ্ম। চূড়ান্ত বিচারে স্বৈরাচার বহুমাত্রিক জটিল একটি ব্যাপার। একে একরৈখিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শুধু খণ্ডিত একটি ছবিই পাওয়া যাবে।

রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারে সরকার পর্যায়ে যখন কোনো ব্যক্তি বা শক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে এসে বা জনগনকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে কুক্ষিগত করে, তার জন্য জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়ে। সে অবস্থায় ক্ষমতাধর সেই ব্যক্তি হয়ে ওঠে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর এক শক্তি। সে হয়ে ওঠে সব রকমের দুর্নীতির ধারক ও বাহক। ইংরেজিতে তাই একটি কথা আছে—‘অ্যাবসুলেট পাওয়ার মেকস ওয়ান অ্যাবসুলেটলি করাপট’।

এ প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ফল হচ্ছে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী অঙ্গুলিহেলন ব্যতীত কোনো কাজই সমাধা করা যায় না। এতে ক্ষমতার একধরনের চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ ঘটে, যেখানে তুচ্ছতম বিষয়গুলোও নিষ্পত্তির জন্য নিয়ে আসা হয় সর্বক্ষণতার অধিকারী ব্যক্তিটির কাছে। ফলে একদিকে যেমন প্রশাসনে জন্ম লাভ করে চূড়ান্ত অদক্ষতা, অন্যদিকে সেখানে স্থায়ীভাবে স্থান করে নেয় চরম দুর্নীতি।

রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাষ্ট্রীয় সর্বময় ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারী একজন শাসককে রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সম্পদের ওপরে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করে। এ অবস্থায় সেই শাসকেরা অর্থসম্পদ একদিকে নিজের খেয়ালখুশিমতো ব্যয় করতে পারে, আত্মসাৎও করতে পারে। সে ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ের সব বিধিবিধান, নিয়মশৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হয়, থাকে না সেখানে কোনো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি।

একজন স্বৈরাচারী শাসক এসব নীতিবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অনুদান, পুরস্কার বা উপহার দান করেন ইচ্ছেমতো, ক্রমাগত লঙ্ঘন করেন অর্থনৈতিক সুশাসনকে। এর ফলে একদিকে সম্পদের সংকট দেখা দেয়, রাষ্ট্রীয় ঋণভার বেড়ে যায়, অন্যদিকে প্রকৃত মানব উন্নয়ন ব্যাহত হয়। ব্যাপারটি এ জন্যই ঘটতে পারে, যেহেতু স্বৈরাচারী শাসনে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি বলে কিছু নেই। একজন স্বৈরশাসক কোনোরকমের দায়বদ্ধতা অনুভব করে না, সে জবাবদিহি করে না জনগণের কাছে। দায়বদ্ধহীনতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতি অর্থনৈতিক স্বৈরাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে স্বৈরাচারী শক্তির আত্মপ্রকাশ ও তার প্রতিষ্ঠানিকীকরণ একজন ব্যক্তির দ্বারা হয় না। যে ব্যক্তি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়, তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে হলে গড়ে তুলতে হয় এক সহযোগী শ্রেণির, একটি সহযোগী মোর্চার। সে মোর্চার দলভুক্ত গোষ্ঠীগুলোকে তুষ্ট রাখতে প্রয়োজন হয় সম্পদ বিতরণের। সে সম্পদ আসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, যা কিনা জনগণের সম্পদ। সেসব কুক্ষিগত সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ওই সম্পদ পাচার করা হয় দেশের বাইরে। সত্যিকার অর্থে স্বৈরাচারী প্রভুর স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য এসব গোষ্ঠীকে দেওয়া হয় যথেচ্ছাচার ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করার নানান সুবিধা।

রাজনৈতিক স্বৈরাচারের অন্যতম আধার রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতন্ত্রমনা হয়, তাহলে তারা দলের অভ্যন্তরে সর্বপর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা করবে। সেখানে আলোচনা হবে সর্ব অর্থে মুক্ত, মুক্তচিন্তা ও মুক্ত পরিবেশে, যেখানে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সম–অধিকার থাকবে সাধারণ কর্মী থেকে নেতা পর্যন্ত সবার। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে।

স্বৈরাচারী শাসককে তোষণের জন্যে এসব সহযোগী তোষামোদের প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে। মিথ্যা স্তবগানে তোষিত নেতাকে এ ধারণাই দেওয়া হয় যে তিনিই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। স্বাভাবিকভাবেই তোষিত নেতা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। নেতাকে স্বেচ্ছাচারী করার মাধ্যমে অনুগামীরাও স্বেচ্ছাচারিতার ছাড়পত্র পেয়ে যায়।

তোষামোদের রাজনীতির অন্যতম ফলাফল স্বেচ্ছাচারিতা। এ স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া ক্রমাণ্বয়ে নেতাকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কখনো বাস্তব সত্যকে তোষিত নেতার কাছে তুলে ধরা হয় না। বাস্তবতা থেকে ক্রমান্বয়ে বর্জিত হয়ে তোষিত নেতা শুধু তা–ই দেখতে পান, যা তোষামোদকারীরা তাঁকে দেখাতে চায়।

রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের প্রলম্বিত বলয়ই হচ্ছে রাজনৈতিক স্বৈরাচার। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের আলোচনা শুরু হতে পারে রাজনৈতিক মূল্যবোধ থেকে। রাজনৈতিক মূল্যবোধে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব থাকে, অনুপস্থিত থাকে পারস্পরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের, শক্তির ব্যবহার থাকে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের যেকোনো ক্ষেত্রকে নিশ্চিহ্ন করার, দৃঢ় প্রচেষ্টা থাকে ভিন্নমতের টুঁটি চেপে ধরার, তাহলে রাজনৈতিক মূল্যবোধ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে।

এ স্বৈরাচারের আরেক মাত্রিকতা হচ্ছে অহংবোধ—‘আমি যা বলছি, তা–ই ঠিক’, ‘আমি সব জানি’। ব্যাপারটি তখন অন্যদের জন্য হয়ে ওঠে বাধ্যতামূলক। সেখানে মারা পড়ে সেই আপ্তবাক্য—‘আমি আপনার সঙ্গে সর্ববিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারি; কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।’

রাজনৈতিক স্বৈরাচারের অন্যতম আধার রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতন্ত্রমনা হয়, তাহলে তারা দলের অভ্যন্তরে সর্বপর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা করবে। সেখানে আলোচনা হবে সর্ব অর্থে মুক্ত, মুক্তচিন্তা ও মুক্ত পরিবেশে, যেখানে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সম–অধিকার থাকবে সাধারণ কর্মী থেকে নেতা পর্যন্ত সবার। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে।

অথচ কখনো কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও স্বৈরাচারী মূল্যবোধ প্রকট ওঠে। সেখানে সাধারণ সদস্যদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন না, সিদ্ধান্তের সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয় দলের সর্বোচ্চ নেতাকে, যিনি একক সিদ্ধান্তে সবকিছু নির্ধারণ করেন। অধীশ্বরের মতো এক চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয় দলনেতাকে। স্বাভাবিকভাবেই সেই দলনেতা চরম স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন।

দেশে দেশে, যুগে যুগে বারবার রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের মৃত্যুঘণ্টা বাজে। গণ–অভ্যুত্থানই স্বৈরাচারকে হঠায়। কিন্তু স্বৈরাচারকে পরাজিত করার প্রক্রিয়ায় ঝরে যায় বহু তরুণ তাজা প্রাণ। আত্মাহুতি দেয় অন্যরাও। তাই যেখানেই অক্টোপাসের মতো স্বৈরাচারের বাহু বিদ্যমান, সেখানেই ছাত্র-জনতা জাগ্রত স্বৈরাচারের মূল উৎপাটনে।

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচন না হওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে: আমীর খসরু

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র জনগণ প্রতিহত করবে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত সংসদ হবে। এটি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।

আজ শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের মেহেদীবাগ এলাকায় নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-১০ আসনের শুলকবহর ও ৪২ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দ্রুত দেশে ফিরবেন। মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। তারেক রহমানের রাজনীতি এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য। জনগণের প্রত্যাশা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন তিনি।

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে আমীর খসরু তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই নির্বাচন বাংলাদেশের, গণতন্ত্রের বাঁচা–মরার সংগ্রাম। জনগণ ভোট দিলে সরকার গঠন করে প্রথম দিন থেকে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করবে বিএনপি। হাতে সময় নেই, মানুষের ধৈর্য নেই। পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক কোটি লোকের চাকরি দিতে হবে ১৮ মাসে। এই ওয়াদা পূরণ করতে হলে বিনা মূল্য প্রাথমিক পাঁচটি সেবা দিতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে পরিবার কার্ডের মাধ্যমে। কৃষকের ক্ষমতায়ন করবে কৃষক কার্ড।

তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রের পথ থেকে বিএনপি কখনো বিচ্যুত হয়নি। আওয়ামী লীগ একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল, শহীদ জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শ, বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ তারেক রহমানের আদর্শের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী বেলাল, সদস্য মামুনুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, বিএনপি নেতা আশরাফ চৌধুরী, গোলাম কাদের চৌধুরী, নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব জমির উদ্দিন, শুলকবহর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শামসুল আলম, ৪২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শায়েস্তা উল্লা চৌধুরী প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ওসমান হাদীর উপর গুলির ঘটনায় মাসুদুজ্জামানের তীব্র নিন্দা 
  • ওসমান হাদীর উপর গুলির ঘটনায় মাসুদুজ্জামানের গভীর নিন্দা 
  • হাদির ওপর হামলা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত: বিএনপি
  • বিজয় ও বিপর্যয়
  • তারেক রহমান দেশে এলে রাজনীতিতে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে: আমীর খসরু
  • ২৫ তারিখে দেশের রাজনীতিতে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে: আমীর খসরু
  • নির্বাচন না হওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে: আমীর খসরু
  • ষড়যন্ত্র রুখতে পারে গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস: তারেক
  • মওলানা ভাসানী মজলুমদের পক্ষে ছিলেন, কখনো আপোষ করেননি: টুকু 
  • একটি দল ভোটের প্রয়োজনে আ.লীগের নাম মুখে নেয় না: সালাউদ্দিন আহমেদ