মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিতর্ক, কমতে পারে অংশগ্রহণ
Published: 28th, March 2025 GMT
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বৈশাখের অন্যতম আয়োজন। প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নির্দিষ্ট ব্যাচের তত্ত্বাবধানে এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াসে আয়োজিত হয়। এবার ভিন্নতা ঘটায় আয়োজন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের একাংশ তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। ফলে এবার অংশগ্রহণ কমবে বলে তারা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারুকলার ১৩তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী সমকালকে বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সম্পূর্ণ অর্থ অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শিল্পকর্ম বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এখানে কোনো বাণিজ্যিক বিষয় বা স্পন্সর থাকে না। চারুকলার রীতি অনুযায়ী যা এ বছর ২৬তম ব্যাচের দায়িত্ব হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু এবারের আয়োজনে সেই রীতি মানা হচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীদের সম্মতি ও সম্পৃক্ততা নেই। এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস ও ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
সীমান্ত ঘোষ নামে চারুকলার এক ছাত্র ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, ‘বৈশাখ ১৪৩২-এ আমাদের ব্যাচ, আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে– ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। তবে এ আয়োজনকে ‘স্বজনপ্রীতিদুষ্ট ও দেশের পরিবর্তনকালীন সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী’ আখ্যায়িত করেছে ২৬ ব্যাচ। আয়োজন ও আয়োজক কমিটিকে বর্জন করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার শোভাযাত্রা নিয়ে স্পষ্ট বিবৃতিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ আয়োজনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চাটুকারিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে আমরা শিক্ষকদের আয়োজন করা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা ও শোভাযাত্রা সমর্থন করছি না।’
ভাটা পড়বে আনন্দ আয়োজনে
প্রাক্তন ও বর্তমান একাধিক শিক্ষার্থী জানান, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমবে। চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের তৈরি শিল্পকর্ম কেনার লোকও কমবে। সেই সঙ্গে এবার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার শঙ্কা রয়েছে। আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে প্রথম বিতর্ক তৈরি হয় শহীদ আবু সাঈদের মোটিফ তৈরির সিদ্ধান্তে। দ্বিতীয় হচ্ছে, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আয়োজনের নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিতে। তৃতীয় বিতর্ক তৈরি হয়, নির্ধারিত ব্যাচকে দায়িত্ব না দেওয়ায়। এসব কারণে প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে চারুকলা অনুষদের একজন শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আয়োজন ও কমিটিকে বর্জন করেছে বলে শুনেছি। আর শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটা ঠিক আছে। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন অনেক বেশি রাজনৈতিক হচ্ছে। এতে সবার অংশগ্রহণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা, তা নষ্ট হয়ে গেছে।’ অনেকে জানান, তাদের ব্যাচ এবং পুরো চারুকলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্জন করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল সমকালকে বলেন, ১৯৮৯ সালে এই শোভাযাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর আয়োজন করে। ২০০৬ সালে প্রতিবছর নির্ধারিত একটি ব্যাচকে আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে একটি ব্যাচ আয়োজন করলেও যে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল না, তা নয়। সেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হতো না। এ ছাড়া আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এই আয়োজন একাডেমিক কার্যক্রমের অংশ করা হবে। এ কারণে কোনো ব্যাচকে আলাদাভাবে দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছে না। ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হয়ে গেছে। তারা এসে কখনও বলেওনি যে, তারা আয়োজন করতে চায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ৯ ও ১২ মার্চ অনুষদের সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করি। সেখানে কোনো নির্ধারিত ব্যাচকে দিয়ে আয়োজন না করানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ মার্চ ছাত্র-শিক্ষক সমন্বয়ে একটা বৈঠক হয়। সেখানে নানা ধরনের কমিটি ও উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলোতে বর্তমান ছাত্রদের যুক্ত করা হয়। তবে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এসে কাজ করতে চাইলে তাদেরও যুক্ত করা হচ্ছে।’
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই...
‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর ঘরভরা সন্তান’—এই ছিল একসময় বাঙালির আদর্শ সুখী পরিবারের প্রত্যাশা। এখন গোয়ালভরা গরুও নেই, পুকুরভরা মাছও নেই, গোলাভরা ধানও নেই। তবে সুখের কথা, ঘরভরা সন্তানের কোনো অভাব নেই। এই অভাব নেই-এর প্রভাব নিয়ে ভেবেছিলাম আর লেখালেখি করব না—আমার ধারণাটাই হয়তো ভুল। কারণ, সেসব লেখা (প্রথম আলোতেই প্রকাশিত) হালে পানি পায়নি, কারও সমর্থন তো দূরের কথা।
আমার অজ্ঞতাপ্রসূত অনধিকারচর্চা হিসেবে হয়তো তিরস্কৃতও হয়েছে। তবে কয়েক দিন আগে একজন রিকশাচালকের টেলিভিশন ক্যামেরায় দেওয়া মন্তব্যটি শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। জ্ঞানী-গুণীরা না হলেও একজন সাধারণ শ্রমিকের উপলব্ধি থেকে আমার বিশ্বাসের সমর্থন তো পেলাম। তাঁর কথার মধ্যে আমার বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি খুঁজে পেলাম। তিনি বলেছিলেন, এ দেশ ‘ফেরেশতা’ এলেও চালাতে পারবেন না, কারণ এ দেশে শুধু মেট্রোরেলের নিচে যত মানুষ রাত যাপন করে, পৃথিবীর বহু দেশেও এত মানুষ নেই।
মানবসম্পদ যে শুধু আশীর্বাদই নয়, উপচে পড়া এ সম্পদ যে অভিশাপও হতে পারে, একজন বিজ্ঞ নয়—অজ্ঞ (?) সাধারণ মানুষের কথার মধ্যে তার পর্যবেক্ষণ লক্ষ করা গেল। তবে এ তো অতি সাধারণ একজন মানুষের পর্যবেক্ষণ। এ প্রসঙ্গে কিছু অসাধারণ মানুষের পর্যবেক্ষণ লক্ষ করা যাক।
ভারতের বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী খুশবন্ত সিংয়ের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘...আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আজকের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, বস্তি, দুর্নীতি ও অপরাধ—এসবের বেশির ভাগই অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং আমরা যে আত্মঘাতী হারে সন্তান জন্ম দিচ্ছি, তার ফল।’ কথাগুলো আমাদের ক্ষেত্রেও
শতভাগ প্রযোজ্য।
অজ্ঞতা, উদাসীনতা, ধর্মীয় বিধিবিধানের অপব্যাখ্যা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশের জন্য কী দুর্ভোগ যে ডেকে আনছে, তা বোঝার ক্ষমতা যে আমাদের নেই তা নয়। কিন্তু জনতুষ্টির বিবেচনায় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে লেখক, বুদ্ধিজীবী, তথা সিভিল সোসাইটি—সবাই বিষয়টিকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যান (অধম ক্ষমাপ্রার্থী)।
স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, পঞ্চাশ বছর পর তা এসে দাঁড়িয়েছে আঠারো কোটিতে (সরকারি হিসাবে, বাস্তবে তা কুড়ি কোটি ছাড়িয়ে যাবে)।কিছুদিন আগে একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে আঠারো কোটি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।’
এই সংগ্রাম থেকেই জন্ম নিচ্ছে যত অশিক্ষা, অপরাধ, প্রতারণার নব নব কৌশল। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়বে একচিলতে জমির জন্য ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, চাঁদাবাজি, দখলদারি ইত্যাদি নিয়ে খুনোখুনি, তথা নানা ধরনের অপমৃত্যু। মানুষের জীবনের যেন কোনো মূল্য নেই। সরবরাহ বেশি হলে মূল্য কমে যাওয়া—অর্থনীতির এ সাধারণ নিয়ম যেন এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
একটি মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বেঁচে থাকার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক পন্থায় সুযোগ না পেলে যেকোনো পন্থায় সে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেই। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস ইত্যাদির জন্মও এভাবেই। তবে ‘কচু কাটতে কাটতে ডাকাত’—একপর্যায়ে বেঁচে থাকার এ যুদ্ধ ওপরে ওঠার সংক্ষিপ্ত পন্থা হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশে এই শর্টকাট পন্থাটি সমাজের সর্বস্তরেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। বহু বিত্তশালীর উত্থানের পেছনেও এই শর্টকাট পন্থা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এই সমাজবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেছে। তরুণেরা লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে।
উইনস্টন চার্চিলের একটি মন্তব্য মনে পড়ছে, ‘ইন্ডিয়ান্স ব্রিড লাইক রেবিট’ (ভারতীয়দের প্রজনন ইঁদুরের মতো) । মন্তব্যটি আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক এবং ক্ষুব্ধ হওয়াও স্বাভাবিক, কিন্তু কথাটি কি একেবারেই মিথ্যা?
স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, পঞ্চাশ বছর পর তা এসে দাঁড়িয়েছে আঠারো কোটিতে (সরকারি হিসাবে, বাস্তবে তা কুড়ি কোটি ছাড়িয়ে যাবে)।
আরও পড়ুনজনসংখ্যা, উন্নয়ন ও বৈষম্যের মধ্যে সম্পর্ক কী১১ নভেম্বর ২০২৫কলকারখানা, বাসস্থান ইত্যাদির প্রয়োজনে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, পাহাড়-পর্বত—কিছুই রেহাই পাচ্ছে না। এ ছাড়া উপায়ই-বা কী। চারদিকে শুধু ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। প্রকৃতিকে এভাবে বিধ্বস্ত করলে সে তার প্রতিশোধ নেবেই। ২১ নভেম্বরের ভয়ংকর দুর্যোগ আমাদের জন্য কি একটি ওয়েকআপ কল নয়? ঢাকা শহর মানুষের ভারে ন্যুব্জ। শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশের চিত্রও একই।
আমরা জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করব, লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করব—এসব জনতুষ্টিমূলক মেঠো বয়ান অনেক শুনেছি। যাঁরা এসব আশ্বাসবাণী শোনান, তাঁরা নিজেরাও জানেন, যে গতিতে আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্টা তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এর সঙ্গে পাল্লা দিতে সমর্থ হবে না।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
এ শুধু গান নয়, বাস্তব। এ দেশের মাটি, জল, হাওয়া, ষড়্ঋতুর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যাবে? ভূস্বর্গ পাওয়া যাবে, মাটির পৃথিবী নয়। আমরা যাঁরা দেশটাকে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসি, তাঁদের ভেবে দেখতে হবে। অন্তত এই একটি বিষয়ে কোনো জনতুষ্টির রাজনীতি নয়।
স্বল্পমেয়াদি কসমেটিক সমাধানের চেষ্টা না করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে—এ আমাদের জাতীয় সমস্যা, সব সমস্যার মূল।
সৈয়দ আব্দুল হাদী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সংগীতশিল্পী
*মতামত লেখকের নিজস্ব