কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ছয়টি খাতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের উদ্যোগে মিলছে সুফল
Published: 7th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও সমাজসেবায় নিজেদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ। কৃষি, শিক্ষা, উদ্যোক্তা তৈরি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ ছয়টি খাতে ব্যাংকটির বিভিন্ন উদ্যোগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এতে দেশের হাওর অঞ্চলের কৃষকদের আয় বেড়েছে। উন্নত হয়েছে খাদ্যাভ্যাস। খবর বিজ্ঞপ্তি
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘আমাদের সামাজিক উদ্যোগগুলো মূল কার্যক্রমের অতিরিক্ত কিছু নয়; এটি আমাদের পরিচয় এবং আমরা কীভাবে আমাদের সমাজকে সেবা করি, তার অন্যতম মূল বিষয়। আমরা সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষার্থীদের বিকাশে সহযোগিতা, পরিবেশ রক্ষা, কৃষিকে শক্তিশালী করা, উদ্ভাবনে সহায়তা ও প্রয়োজনের সময় সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়—এসব খাতে বিনিয়োগ করছি।’
কৃষি: দেশের ২৩টি জেলায় ১১টি কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এর মধ্যে আছে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মাছ ও মৌচাষ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ–সংক্রান্ত কাজ। পাশাপাশি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ কৃষিতে নতুন উদ্ভাবন ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করবে।
স্বাস্থ্য: সারা দেশে চক্ষুচিকিৎসা ক্যাম্পের মাধ্যমে ১১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে সেবা দেওয়া হয়েছে। ভাসমান হাসপাতালের মাধ্যমে দুর্গম গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ চিকিৎসা পেয়েছে। ১১৮ জন নার্সকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ৪টি কমিউনিটি হাসপাতালে মেডিকেল অক্সিজেন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
শিক্ষা এবং উদ্যোক্তা তৈরি: ইউসেপের সহযোগিতায় ফিউচারমেকার্স কর্মসূচির আওতায় প্রায় সাত হাজার তরুণ-তরুণীকে দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান–সংক্রান্ত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) একটি সম্মেলনকেন্দ্র ও শিক্ষক লাউঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাগো ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১ লাখ ১৬ হাজারের বেশি তরুণ ও তরুণীকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ: খুলনা মুক্তি সেবা সংস্থা ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে ফুল চাষের উন্নয়ন ও প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে কাজ করছে এই ব্যাংক। এ ছাড়া ৫০ হেক্টর জমিকে ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করার উদ্দেশ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প শুরু হয়েছে; এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও জলবায়ু–সহনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখের বেশি মানুষকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং গত বছরগুলোয় উত্তরের জেলাগুলোয় ১০ হাজারের বেশি মানুষকে শীতবস্ত্র দেওয়া হয়েছে। চরাঞ্চলের বন্যাঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বন্যাকালীন সুরক্ষার জন্য আটটি প্লিন্থ (প্লিন্থকে ভূতলস্তর বলা হয়। এটি একধরনের সীমারেখা, যা ভবনের উপরিকাঠামোর সঙ্গে নিচের কাঠামোর সংযোগ ঘটায়) স্থাপন করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, এসব কার্যক্রমের বাস্তব প্রভাব ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সব প্রকল্প তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের প্রধান বিটপী দাস চৌধুরী বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে আমাদের সহযোগী সংস্থাগুলোর অবদান ছাড়া এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না। দেশের প্রান্তিক এলাকায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততাই এই অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে।’
হাওরের কৃষকদের আয় বৃদ্ধি: সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের হাওরের কৃষকদের জন্য পরিচালিত প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের বার্ষিক আয় ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের বর্তমান আয় ৯৮ হাজার ২৩৮ দশমিক ৬১ টাকা, যা আগে ছিল ৮৫ হাজার ২ দশমিক ৭০ টাকা। আগাম বীজ ও সময়মতো ফসল সংগ্রহের ফলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ধান কাটা, মাড়াই ও বাছাইয়ে সময় কমেছে যথাক্রমে ৭৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ও ৭১ দশমিক ৯০ শতাংশ। পাশাপাশি সার্বিক খরচ কমেছে ৫৫ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ৭৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জলবায়ু-প্রভাবিত গ্রামীণ জীবিকা উন্নয়ন প্রকল্প: চর এলাকাভিত্তিক এই কৃষি–সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে ৯২ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে উন্নতি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এটি মূলত খাদ্যনিরাপত্তার নির্দেশক। নিরাপদ বাসস্থানের জন্য তৈরি উঁচু প্লিন্থগুলো শতভাগ ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে নিশ্চিন্ত ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি মানসিক চাপ কমেছে ৪৯ শতাংশ। এই উদ্যোগের ফলে পরিবারগুলোর গড় মাসিক আয় ৭ হাজার ৫১৯ টাকা থেকে ১৭ হাজার ২৬২ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
মধু উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে মধুচাষিদের আয় বৃদ্ধি: এ প্রকল্পের মাধ্যমে মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাশাপাশি বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং বিক্রয়মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৭০ শতাংশ চাষি জানিয়েছেন, লিচু, আম, শর্ষে ও ধনের ফলন বেড়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এসব উদ্যোগ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে থাকা এবং ব্যাংকের অঙ্গীকার ‘হেয়ার ফর গুড’ (ভালো করার জন্য আছি) বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশের ১২০ বছরের বেশি সময়ের উন্নয়নযাত্রার অংশীদার হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড উন্নয়নশীল অগ্রগতির লক্ষ্যে অর্থবহ সামাজিক উদ্যোগে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র ম সহয গ ত ক ষকদ র র জন য আম দ র পর ব শ দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
কাছের মানুষ পাশে থাকলে কঠিন যুদ্ধেও জেতা যায়, তার প্রমাণ বিসিএস ক্যাডার মালিহা
মালিহার মা আসমা বেগমের কথা না বললেই নয়। জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার কলমা গ্রামে। ঢাকায় বড় হয়েছেন। বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯৯৩ সালে জগন্নাথ কলেজে (সে সময় কলেজ ছিল, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হয়) ভর্তি হন। এর এক বছর পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
একঝটকায় ঢাকার শিক্ষার্থী থেকে ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের গৃহবধূ হয়ে গেলেন। আসমা বেগমের খুব ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার।
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার পাট চুকে গেল। চাকরির স্বপ্নের সমাপ্তি। মালিহা তাঁর মাকে সারাটা জীবন কেবল অন্যের জন্য করে যেতে দেখেছেন। বিনিময়ে মা পেয়েছে কেবল উপেক্ষা আর অবহেলা।
নতুন জীবন নতুন সংগ্রামউচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় মালিহার। বিয়েতে মালিহার মায়ের কেবল একটা অনুরোধ ছিল পাত্র ও তাঁর মা-বাবার কাছে—তাঁর কন্যার লেখাপড়ার যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। বিয়ের পর মায়ের ইচ্ছায়, স্বামীর পরামর্শে মালিহা ভর্তি হন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজে।
মালিহা এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তখন কলেজটি ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বর্তমানে কলেজটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১৯ সালের মার্চে ইন্টার্ন চলাকালীন মা হন মালিহা। মা হয়েও ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করেন। তারপর সময় নষ্ট না করে শুরু করেন চাকরির পড়াশোনা।
সারা জীবন কেবল চেয়েছি মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে। কী করলে আমার মা একটু স্বস্তি পাবে। আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বলেছেন, “তুমি কেবল আবেগ নিয়ে কখনোই মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারবা না। এ জন্য তোমার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে হবে।” আমাকে আরও বলত, “আমার মতো স্টুডেন্টের যদি সরকারি চাকরি (ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার) হয়, তোমার কেন হবে না। তুমি আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি পরিশ্রমী, তোমার আরও ভালো চাকরি হবে।”মুলকে সাদ মালিহা, লাইভস্টক ক্যাডার, ৪৪তম বিসিএসযে কান্না আনন্দেরমালিহার মামি শিক্ষা ক্যাডার হন। সে সময় থেকে তাঁর রঞ্জু মামা তাঁকে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। মালিহা ২০২০ সাল থেকে চাকরির পড়াশোনা শুরু করেন। ২০২৫ সালে এসে প্রথম সরকারি চাকরি পান। যোগ দেন সরকারি ব্যাংকের অফিসার পদে।
এর কিছুদিন পর ৩০ জুন ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে। তবে তখন ক্যাডার পদ আসেনি মালিহার। বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।
লাইভস্টক ক্যাডারে ৬৮জন ‘রিপিট ক্যাডার’ ছিল। সেসব পুনর্মূল্যায়ন করে আবার যখন ৬ নভেম্বর নতুন ফল প্রকাশ করা হয়, তাতে নাম আসে মালিহার। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর।
মালিহার মা আসমার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন যেন মেয়ের ভেতর দিয়ে সত্য হয়ে ধরা দেয়। মালিহা যখন চাকরির সুখবর জানাতে মাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে ‘আম্মুউউউ’ বলে একটা চিৎকার দিয়েছেন, মা আসমা বেগম ভয়েই অস্থির! নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো বিপদ হয়েছে। এরপরই শুনলেন খবরটা। মা-মেয়ে দুজনেই ফোনের দুই পাশে কাঁদছেন, যে কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির, সফলতার।
মামির শাড়ি আর ব্লেজার পরে বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন মালিহা