তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলার বিকল্প নেই
Published: 10th, May 2025 GMT
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব) মুখলেসুর রহমান।
তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অনেকে সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। শারীরিকভাবে বৈপরীত্য ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সুযোগ পেলে প্রতিভার বিকাশে কিন্তু তারাও এগিয়ে যেতে পারেন। সেই সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি এবং সহযোগিতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।
শনিবার দুপুরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পাথওয়ের উদ্যোগে মিরপুরের কার্যালয়ে ‘তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে সেলাই মেশিন বিতরণ’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন মুখলেসুর রহমান।
তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর যারা আছেন তারা অনেকে জানেনই না তাদের কি প্রতিভা আছে। দেশ-পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বসে বসে শুধু খাবার সুযোগ আর নেই। নিজেকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। আমাদের শক্তি মানবসম্পদ। সেখানে এই জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, আমরা চেষ্টা করছি হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। জাতীয় পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী ৪০টা সংগঠনের মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাথওয়ে। প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা আর্থিক অনুদান দিচ্ছি। তারা অনেক বেশি কাজ করছে। আমরাও চেষ্টা করছি পাথওয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য।
পাথওয়ের চেয়ারম্যান রইজুর রহমান বলেন, পিছিয়ে পড়া হিসেবে নয়, স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য নিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। কারণ এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভাসমান জীবনযাপন করেন। তাদের শুধু বিশেষায়িত পেশার জন্য দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়, তাদের জন্য চাকরির সুবন্দোবস্ত করতে হবে। ড্রাইভিং শিখলে তাকে পেশা হিসেবে সুযোগ করে দিতে হবে। সেলাই শিখলে তার কাজের জন্য সুযোগ করে দেওয়া ও হিজড়াদের বানানো পোশাক পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করার উদ্যোগ নিতে হবে।
পাথওয়ের নির্বাহী পরিচালক মো.
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, চীন আজ পরাশক্তি হয়েছে কারণ তারা নাগরিকদের জনশক্তিতে রূপান্তর করেছে। আমরাও সেটা পারব যদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য কার্যকর কিছু করতে পারি। ঢাকা মহানগরে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে ট্র্যাফিক পুলিশের সহযোগী হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর দক্ষ ও শিক্ষিতদের সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ জানান মো. শাহিন।
তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর নেতা কনা হিজড়া বলেন, আমাদের সঙ্গে পদে পদে অমানবিক আচরণই শুধু নয়, মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়। হিজড়া বলে আমরা নিগৃহীত নির্যাতিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। এরপরও হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা নানা কাজে পারদর্শী, প্রতিভাসম্পন্ন, দক্ষ, যোগ্য। অনেকে আছেন ড্রাইভিং, সেলাই মেশিন, আর্টিস্ট, মেকআপ আর্টিস্ট ও পার্লারের কাজে দক্ষ। এসব ক্ষেত্রে আমরা হিজড়াদের কাজে লাগাতে পারি। এজন্য আমরা সুযোগ চাই, পরিবেশ চাই।
অনুষ্ঠানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর ১০ জনের মধ্যে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়। এসময় জানানো হয়, তাদের তৈরি করা পোশাকও বিক্রি করবে পাথওয়ে।
এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন, শহর সমাজসেবা অফিসার শহিদুজ্জামান, ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনের নির্বাহী পরিচালক মহিউদ্দিন আমিন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত ত য় ল ঙ গ র জনগ ষ ঠ জনগ ষ ঠ র জনগ ষ ঠ ক প থওয় র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে জোর দিতে হবে
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের দিন ঠিক করা আছে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। এটি একদিকে যেমন সম্মানজনক, অন্যদিকে আবার বিরাট চ্যালেঞ্জও বটে।
এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে বিশ্ববাণিজ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী উত্তরণের পর এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ‘ফ্রি মিল’বা ‘মাগনা খাওয়ার’ দিন শেষ।
ফলে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশল ঠিক করা প্রয়োজন।
প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে অর্থনীতির বৈচিত্র্য।
বলা হয়ে থাকে যে অর্থনীতির তিনটি স্তর আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, দ্বিতীয় পর্যায়ে শ্রমনির্ভর শিল্প এবং তৃতীয় তথা শেষ পর্যায়ে জ্ঞানভিত্তিক ও সেবামূলক অর্থনৈতিক কার্যাবলি প্রাধান্য পায়।
সত্তর বা আশির দশকে স্কুলে পড়তাম, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর এবং অর্থনীতিতে এর অবদান প্রায় ৮০ শতাংশ। অর্থকরী ফসল ‘পাট’কে তখন বলা হতো ‘স্বর্ণসূত্র’ বা ‘সোনালি আঁশ’ যা বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করত।
ঠিক এই মুহূর্তে চিত্রটি কেমন? অর্থনীতিতে কৃষির অবদান প্রায় ১২ শতাংশ আর এখানে মোট জনশক্তি নিয়োজিত প্রায় ৪৫ শতাংশ। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির প্রাথমিক পর্যায় উতরে ইতিমধ্যেই আমরা শ্রমনির্ভর শিল্প অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছি।
শেষ পর্যায়ে এসে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, তা হচ্ছে শ্রমনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়া।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল পোশাকশিল্প খাতের ওপর। শুধু তৈরি পোশাকশিল্প থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আসে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশ।
সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। পোশাকশিল্প আসলে একটি শ্রমনির্ভর শিল্প। এতে মেধার ব্যবহার তেমন একটা নেই। শুধু কায়িক শ্রম।
অন্যদিকে, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে মেধা বা জ্ঞানের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। যেমন প্রকৌশলীরা বিমান বা কম্পিউটার বানান, উঁচু দালান বা সেতুর নকশা করেন বা সফটওয়্যার তৈরি করেন। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে আয় অনেক বেশি সম্ভব। যেমন আপনি যে বিমান ১০০ কোটি টাকায় কিনেছেন, এর যে কাঁচামাল যেমন লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদির বাজার মূল্য হয়তো ১০ কোটি টাকা। তাহলে বাকি ৯০ কোটি টাকা আসলে মেধার মূল্য!
অন্যদিকে, পোশাকশিল্পে ১০ কোটি টাকার কাঁচামাল, যেমন সুতা থেকে কাপড় এবং টি-শার্ট তৈরি করে আপনি বড়জোর ২০ কোটি টাকা আয় করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার কাজের দ্বারা পণ্যটিতে ‘ভ্যালু অ্যাডিশন’–এর পরিমাণের ক্ষেত্রে এ দুটি শিল্পের বিস্তর ফারাক!
বলা হয়ে থাকে, একটি দেশের মাথাপিছু আয় যখন বেড়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে সে শ্রমনির্ভর শিল্প ছেড়ে দিয়ে জ্ঞাননির্ভর শিল্পের উৎপাদনে বেশি মনোনিবেশ করে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে আসলে তারাই প্রভুত্ব বিস্তার করে, যারা উন্নত প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদান করতে সক্ষম। ইন্টারনেট আর উন্নত যোগাযোগের যুগে, সারা বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের পরও আপনি দেখবেন, এমন অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আছে যা শুধু অল্প কিছু দেশই বানাতে সক্ষম।
কোনো প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই জাপানের পক্ষে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে এর দক্ষ জনশক্তি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই দেশ কঠোর পরিশ্রম, সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার আর সর্বোচ্চ কারিগরি দক্ষতার বদৌলতে আজ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হতে পেরেছে।বিমানের কথাই ধরুন। সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে হাজার হাজার যাত্রীবাহী বিমান ওঠা-নামা করছে বিভিন্ন বিমানবন্দরে। অথচ এ ধরনের যাত্রীবাহী ভালো বিমান বানাতে পারে হাতে গোনা চার-পাঁচটি দেশ।
একটা এফ-১৬ বোমারু বিমানের দাম প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা! একইভাবে যে কম্পিউটার আর মুঠোফোন এখন সবার ঘরে ঘরে, কিংবা নিত্যদিনের চলাচলের জন্য যেসব গাড়ি, খুব অল্প কটি দেশই ভালো মানের এ ধরনের পণ্য প্রস্তুত করতে সক্ষম।
কিন্তু কেউ চাইলেই নিজ দেশে আগামীকাল থেকে বিমান বানানো শুরু করে দিতে পারেন না। বিষয়টি এত সহজ নয়। জ্ঞানভিত্তিক এই অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হচ্ছে, উন্নত শিক্ষা ও গবেষণা। অর্থাৎ দক্ষ ও উন্নত মানবসম্পদ। প্রকৃত অর্থে তেল, গ্যাস কিংবা সোনার মতো প্রত্যেক মানুষই কিন্তু একেকটা সম্পদ। অনেক ক্ষেত্রে তা হাজার গুণ বেশি দামি।
কোনো প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই জাপানের পক্ষে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে এর দক্ষ জনশক্তি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই দেশ কঠোর পরিশ্রম, সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার আর সর্বোচ্চ কারিগরি দক্ষতার বদৌলতে আজ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হতে পেরেছে।
মোট জনসংখ্যা ও সমতলভূমি বিবেচনায় জাপান ও বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় সমান। সবকিছুতে প্রায় মিল থাকার পরও দুটি দেশের অর্থনীতির বিস্তর ফারাকের কারণ মানুষের যোগ্যতার হেরফের; তাদের জ্ঞান, শিক্ষা, সময়ানুবর্তিতা ও কর্মদক্ষতার বিস্তর পার্থক্য! জাপানের মতো বাংলাদেশেরও আছে একটি বিশাল জনসম্পদ।
কিন্তু আমরা একে বোঝা মনে করছি। কারণ, এই জনসংখ্যাকে আমরা জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারিনি। আমাদের আয়ের আরেকটি বড় উৎস হলো বিদেশিদের পাঠানো আয়। সেখানেও বাংলাদেশিরা যা করছেন, তা হচ্ছে শ্রমিকের কাজ। একটু দক্ষ হলে এই আয় বাড়তে পারত বহুগুণ।
অন্যদিকে, নিজ দেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র সম্বল তৈরি পোশাকশিল্প। এই কম মেধানির্ভর তথা শ্রমনির্ভর তৈরি পোশাকশিল্পের ঊর্ধ্বতন পদগুলো দখল করে আছে বিদেশিরা—শ্রীলঙ্কান, ভারতীয়, চায়নিজ কিংবা কোরিয়ান।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের তো কথাই নেই। খবরে দেখেছিলাম, প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অর্থ প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বাইরে চলে যায় বিদেশিদের বেতন বাবদ। ৪০ বছরের তৈরি পোশাকশিল্পের ইতিহাস বাংলাদেশের। এত দিনেও আমরা এ শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে ব্যর্থ। আমরা শুধু শ্রমিকের কাজই করছি। একটিমাত্র টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আছে—বুটেক্স। সেটির আধুনিকায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার কখনো নিয়েছে কি?
এ খাতে গবেষণার জন্য কখনো কি বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে? বরং বাস্তবে যা দেখেছি, তা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা বুটেক্স থেকে পাস করে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ক্ষমতা আর অর্থবিত্তে সরকারি প্রশাসন অনেক আকর্ষণীয়। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা হয় সেই পথ বেছে নিয়ে আমলা হচ্ছেন বা ‘ব্রেইন ড্রেইন’–এর শিকার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন এবং সেখানেই থেকে যাচ্ছেন।
একইভাবে, বাংলাদেশের প্রায় সমান সময়ে, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হয়েও সিঙ্গাপুরের ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিক্ষার বিস্তার এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ সাধন। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কিউআন তাঁর প্রায় ৩০ বছরের শাসনামলে যে বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো, প্রাকৃতিক সম্পদহীন সিঙ্গাপুরের প্রত্যেক নাগরিককে সম্পদে পরিণত করা।
প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এটি সম্ভব করেছিলেন লি কিউআন। একসময়ের একটি সাধারণ মানের বিশ্ববিদ্যালয় ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’কে তাই সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করে আজ বিশ্বের প্রথম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে পরিণত করা হয়েছে। কোনো এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমার সৌভাগ্য যে উচ্চশিক্ষার্থে এ দুটি দেশেই গমন ও লম্বা সময় অবস্থানের সুযোগ পেয়েছিলাম। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল আর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে মাস্টার্স। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বলতে যা বোঝায়, তার পরিপূর্ণ বিস্তারের চেষ্টা করা হয়েছে এ দুটি দেশে। সামগ্রিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের অবস্থার কাছাকাছি হওয়ায়, এ দুটি দেশকে আমরা উদাহরণ হিসেবে অনুকরণ করতে পারি।
এ প্রসঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার একসময়কার একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বিগত সরকারের অবকাঠামোনির্ভর উন্নয়ন নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যতীত এসব সুদৃশ্য অবকাঠামো ‘কঙ্কালসদৃশ’। নিঃসন্দেহে কঙ্কাল দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি ছাড়া আপনি দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু রক্ত মাংস ছাড়া একটি কঙ্কাল মৃত মানুষেরই প্রতীক। তেমনি একটি দেশের উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
তবে জনগণের করের টাকা কিংবা ঋণ—বহু কষ্ট করে এই যে অবকাঠামো নির্মাণ, পরবর্তীকালে এর সঠিক ব্যবহারের জন্য সৎ ও দক্ষ জনশক্তি যদি তৈরি করা না হয়, তাহলে তা বেহাল কিংবা মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু আফসোসের বিষয়, তিনি শিক্ষা উপদেষ্টা থাকাকালীন এবং পরবর্তীকালে পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ও একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন বা মানবসম্পদ উন্নয়নের রোডম্যাপ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি।
আমার মতে, এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বাত্মক মনোনিবেশ করা। অনেকেই দাবি করছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তথা প্রযুক্তিশিক্ষা নিয়ে কমিশন গঠনের। এটি এখন সময়ের দাবি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ মানবসম্পদই হবে একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। শুধু অর্থবিত্ত আর বড় বড় অবকাঠামো থাকলেই বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, যদি না জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্য এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জ্ঞানের ভিত্তিতেই এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে একটি উৎপাদনশীল জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব, যা হতে পারে সোনা, রুপা কিংবা হীরার চেয়ে বেশি দামি সম্পদ।
ড. মো. সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস (সিআইআরএস), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।