গাজায় ইসরায়েলের ভয়ানক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক বিবৃতিকে স্বাগত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ২০ মে হাউস অব কমন্সে দাঁড়িয়ে গাজায় ইসরায়েলি ব্লকেডের নিন্দা জানিয়ে তাকে ‘মোরালি রং’ এবং ব্রিটিশ জনগণের নৈতিকতার প্রতি অপমান হিসেবে অভিহিত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত করেন এবং সীমিত ও তুলনামূলক ছোট পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তার আগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি যৌথভাবে সতর্ক করেন এই বলে– ইসরায়েল যদি তার সামরিক হামলা বন্ধ না করে এবং গাজায় সাহায্য প্রবেশ করতে না দেয়, তবে তারা ‘কার্যকর পদক্ষেপ’ গ্রহণ করবেন।
এসব বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের স্পষ্ট সমালোচনা উঠে এসেছে। যদিও তারা এই বিবৃতি দিতে দেড় বছরেরও অধিক সময় নিয়েছেন, যেখানে ২০২৩ সাল থেকে ইসরায়েলের অবিরত আক্রমণে ৫০ হাজারেরও বেশি গাজার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে হাজার হাজার নারী-শিশু রয়েছে। ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা যদি এক বছর আগেও ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন এবং সমালোচনা করতেন, তাহলে হয়তো এসব শিশুসহ আরও নিরাপদ প্রাণ রক্ষা করা যেত। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিলম্বিত বোধোদয় তথা নৈতিক অবস্থান স্পষ্টীকরণ কতটা পরিবর্তন আনবে?
কয়েক সপ্তাহ ধরে খবরে প্রকাশ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর বিরক্ত ও ক্লান্ত। যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরে বাদ পড়েছে ইসরায়েল। ট্রাম্পের ইসরায়েল সফরের ব্যাপারে নেতানিয়াহু প্রশাসনের ব্যাপক লবিং সত্ত্বেও তাদের ব্যর্থতা ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বড় হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর এটিই যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সকে কূটনৈতিকভাবে সেই সুযোগ দিয়েছে। যে কারণে তারাও ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। অর্থাৎ তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা কিংবা হোয়াইট হাইসের তিরস্কারের ভীতি থেকে মুক্ত।
পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অভিজ্ঞ কূটনীতিক, খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ও মানবিক কর্মীদের অত্যন্ত কঠোর অবস্থান। ১৩ মে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক টম ফ্লেচার নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, গাজায় যে ‘একুশ শতকের বর্বরতা চলছে’, তা থামান। তিনি বলেন, ১০ সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরে সেখানে কোনো ত্রাণ প্রবেশ করে না এবং ২১ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। তিনি সঠিকভাবেই ইসরায়েলের মিত্রদের এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি সহজ প্রশ্নের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করেন– ‘আপনারা কি গণহত্যা প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন রক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন? নাকি এর পরিবর্তে বলবেন, আমাদের সক্ষমতার মধ্যে আমরা সব করেছি?’
কয়েক দিন ধরে লন্ডন, প্যারিস ও অটোয়া থেকে যেসব বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা আসলে বহু দিনের বকেয়া। আমরা মনে করি, এসব পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ গাজার মানুষের ওপর গণহত্যা বন্ধে ভূমিকা রাখবে। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা হবে যথাযথ। হামলা থামাতে হবে; শুধু বয়ান দিয়ে হবে না।
১৪ হাজার শিশুর দিকে তাকিয়ে, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি; আমি আশা করি, অনতিবিলম্বে সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
হামজা ইউসুফ: স্কটল্যান্ডের সাবেক ফার্স্ট মিনিস্টার; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল খালাস পাওয়ায় বাম জোটের উদ্বেগ
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাসসহ সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ভুলিয়ে দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেসব অপশক্তি তৎপর রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু ও সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আলী। এর আগে আজ সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারকে খালাস দেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী, আলবদর–আলশামস বাহিনী গঠন করে খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের সবার বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। দীর্ঘ সময় পরে হলেও যাদের বিচার হয়েছে, তাদের সবার রায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে কার্যকর করেনি। গণ অভ্যুত্থানপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আমলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের সেই রায় বাতিল করে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় দেশবাসীর মনে প্রশ্ন, বর্তমান সরকারের সময়েও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে কি না।
দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রশ্নে একাত্তরের গণহত্যাকারী ও তাদের সহযোগীদের বিচার নিশ্চিত করা এবং চব্বিশের গণহত্যাকারীদের বিচারপ্রক্রিয়া দৃশ্যমান করার দাবি জানিয়েছে বাম জোট। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ভুলিয়ে দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেসব অপশক্তি তৎপর রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এবং একাত্তর ও চব্বিশের গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জোটের নেতারা।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত আওয়ামী শাসনামলে যেমন বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে, গণগ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা, গণহারে আসামি করে ফরমায়েশি রায়ে নাগরিকদের হয়রানি করা হয়েছে, জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পুরে রাখা হয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানের পর গণহত্যার জন্য প্রকৃত দায়ীদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে মামলা না করে ঢালাও–গণহারে মামলা দিয়ে বাস্তবে বিচারপ্রক্রিয়াকে দুর্বল বা প্রকৃত অর্থে বিচারকে অস্বীকার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও গণমামলার আসামিদের কাছ থেকে পুলিশ ও কিছু রাজনৈতিক দলের লোকজনকে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বিগত আমলে যেমন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গণহারে সবাইকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বেশ কিছু মামলায় সবাইকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগ করে বাম জোট বলেছে, এতে করে বিচার ও আইনের শাসন সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথে এক অশনিসংকেত।
সচিবালয়, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে জোটের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল দেশে গণতান্ত্রিক আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সর্বত্র অরাজক পরিস্থিতি দেখে দেশবাসী উদ্বিগ্ন ও হতাশাগ্রস্ত এই ভেবে যে এত রক্তপাত ও আত্মত্যাগের পরেও গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে কি না।