কলাকেন্দ্রে কালো দেয়ালের আবহে মিশে ছিল ধোঁয়াটে হলুদ আলো, আর তার মধ্যেই চলছিল প্রদর্শনী ‘কালের হালখাতা’। এই প্রদর্শনীতে শিল্পী সাইদুল হক জুইস এক হিসাবরক্ষকের ভূমিকায়, তবে তাঁর খাতায় লেখা হচ্ছে মানুষের রক্তের হিসাব। প্রদর্শনীটি গণহত্যাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এটি একাধারে গভীর শোকের প্রকাশ এবং রাষ্ট্রীয় ও সাম্রাজ্যিক দানবীয়তার বিরুদ্ধে এক তীক্ষ্ণ অবস্থান।
এই প্রদর্শনীতে শিল্পী কাজ করেছেন গণহত্যা নিয়ে। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের নিহত মানুষেরা যেন বর্তমান দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁদের চেতনার পরীক্ষা নিতে এসেছে। লালমাটিয়ার কলাকেন্দ্রে সাইদুল হক জুইসের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কালের হালখাতা’ নামে অনুষ্ঠিত হয় এই শিল্প প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীর জন্য কলাকেন্দ্রের গ্যালারি পরিণত হয়েছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত এক পরিসরে। আলো ছিল নরম ও উষ্ণ, আর তা আছড়ে পড়ছিল দেয়ালে ঝোলানো ইনস্টলেশনগুলোর ওপর। শিল্পী এমন এক ভিজ্যুয়াল পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, যেখানে লাল কাপড়ের ওপরে কাগজের ম্যাশ দিয়ে তৈরি লাশের ফরম ছিল। কখনো তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল চিঠি, কখনো নিখোঁজ বা নিহতের তালিকা, কখনোবা কেবল একের পর এক কাফন মোড়ানো মানুষ।
ব্যক্তি অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক উপলব্ধি ও ইতিহাসের গভীর স্মৃতিকে একই সূত্রে বেঁধে রেখেছিল জুইসের শিল্পকর্মগুলো।
প্রদর্শনীর আরেক অংশে ছিল তারের তৈরি এক ভেঙে পড়া শহরের জাল। সেই কাঠামোর ভেতরে বসে ছিল কার্ডবোর্ডে গড়া কালো কাক। যেন তারা গণহত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী, ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার একমাত্র জীবিত প্রহরী।
শিল্পীর ব্যবহৃত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল মুখোশ। প্রদর্শনীতে উপস্থিত মুখোশগুলোর চোখ শূন্য, মৃত ও ক্লান্ত। প্রতিটি মুখোশ যেন রাষ্ট্রীয় ও সাম্রাজ্যিক নিপীড়নের প্রতীক। একটি মুখোশের মুখে ছিল মানবহাড়, যার ওপর বসে ছিল কাক। চিত্রটি যেন সেই শোষকের রূপ, যে মানুষকেই খাদ্যে পরিণত করে। আরেকটি মুখোশে আঁকা ছিল মানচিত্র, কিন্তু তা কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা; শাসকের লোভী বিভাজনের নিদর্শন। একটি মুখোশের চোখ ছিল চরম অন্ধকারে; যেন এক প্রগাঢ় শূন্যতা। সেই মুখ থেকে বের হচ্ছিল তারে মোড়ানো কুণ্ডলি, যেন এক গুমরে ওঠা আর্তনাদ। কুণ্ডলির নিচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য হাত; ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উঠে আসার আকুতি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণহত য
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)