জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল খালাস পাওয়ায় বাম জোটের উদ্বেগ
Published: 27th, May 2025 GMT
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাসসহ সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ভুলিয়ে দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেসব অপশক্তি তৎপর রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো.
বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী, আলবদর–আলশামস বাহিনী গঠন করে খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের সবার বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। দীর্ঘ সময় পরে হলেও যাদের বিচার হয়েছে, তাদের সবার রায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে কার্যকর করেনি। গণ অভ্যুত্থানপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আমলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের সেই রায় বাতিল করে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় দেশবাসীর মনে প্রশ্ন, বর্তমান সরকারের সময়েও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে কি না।
দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রশ্নে একাত্তরের গণহত্যাকারী ও তাদের সহযোগীদের বিচার নিশ্চিত করা এবং চব্বিশের গণহত্যাকারীদের বিচারপ্রক্রিয়া দৃশ্যমান করার দাবি জানিয়েছে বাম জোট। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ভুলিয়ে দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেসব অপশক্তি তৎপর রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এবং একাত্তর ও চব্বিশের গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জোটের নেতারা।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত আওয়ামী শাসনামলে যেমন বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে, গণগ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা, গণহারে আসামি করে ফরমায়েশি রায়ে নাগরিকদের হয়রানি করা হয়েছে, জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পুরে রাখা হয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানের পর গণহত্যার জন্য প্রকৃত দায়ীদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে মামলা না করে ঢালাও–গণহারে মামলা দিয়ে বাস্তবে বিচারপ্রক্রিয়াকে দুর্বল বা প্রকৃত অর্থে বিচারকে অস্বীকার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও গণমামলার আসামিদের কাছ থেকে পুলিশ ও কিছু রাজনৈতিক দলের লোকজনকে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বিগত আমলে যেমন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গণহারে সবাইকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বেশ কিছু মামলায় সবাইকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগ করে বাম জোট বলেছে, এতে করে বিচার ও আইনের শাসন সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথে এক অশনিসংকেত।
সচিবালয়, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে জোটের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল দেশে গণতান্ত্রিক আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সর্বত্র অরাজক পরিস্থিতি দেখে দেশবাসী উদ্বিগ্ন ও হতাশাগ্রস্ত এই ভেবে যে এত রক্তপাত ও আত্মত্যাগের পরেও গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে কি না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ম গণত ন ত র ক জ ট র গণহত য সরক র আজহ র
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদীয় গণতন্ত্রই চায় ইসলামপন্থি ছয় দল
ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রই চায়। সংস্কার কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এমন ছয়টি দলের কেউই শরিয়াহভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা, খেলাফত রাষ্ট্র চায়নি। ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। বাকি দলগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রস্তাব করেছে।
এর বাইরে ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত চেয়েছে আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্তের সুপারিশে একমত হয়নি ইসলামপন্থি দলগুলো। ধর্মভিত্তিক সব দল সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ পুনর্বহালের প্রস্তাব করেছে। কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন না করার প্রস্তাব করেছে দলগুলো। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে।
সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনে লিখিত মতামত জানায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এই তিন দল ছাড়াও মতামত জানিয়ে সংলাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি।
ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সমকালকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছে সব ধর্মভিত্তিক দল।
হেফাজতে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট এবং কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর নেতারা সমকালকে বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান হিসেবে দেখাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পর পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা বারবার জানতে চেয়েছেন, ইসলামী দলগুলোর শরিয়াহভিত্তিক শাসন, খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে জামায়াত প্রস্তাব করেছিল, জরুরি অবস্থা জারি হলেও মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার স্থগিত করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের মতামতে এবং সংলাপে তারাও উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোর আদলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, জবাবদিহির প্রস্তাব করেছে।
দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াত কখনও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করার কথা বলেনি। জামায়াত সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ছড়ানো। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জামায়াতের লক্ষ্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ১২ পৃষ্ঠার প্রস্তাবে ধর্মবিষয়ক একটি লাইন লিখেছে। এতে বলা হয়েছে, শরিয়াহবিরোধী আইন করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬ সুপারিশেও দলটি ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব দেয়নি। দলের মহাসচিব ইউনূস আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো গণতান্ত্রিক দলই শরিয়াহবিরোধী আইনের পক্ষে নয়।
৭ মে দ্বিতীয় দিনের সংলাপে শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করে ইসলামী আন্দোলন। এর ব্যাখ্যায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে শরিয়াহ আইনে বিচার হয়। ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব করেছে, নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৃথক শরিয়াহ বেঞ্চ থাকবে। বাদী ও বিবাদী একমত হলে বিচারের জন্য শরিয়াহ আদালতে যেতে পারবেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেমন সাধারণ ও শরিয়াহ পদ্ধতি রয়েছে। গ্রাহক যে পদ্ধতি পছন্দ করেন, তা গ্রহণ করেন। শরিয়াহ আদালতও তেমন ঐচ্ছিক হবে।
নেজামে ইসলাম পার্টি সংলাপে গুরুত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনে। খেলাফত মজলিস সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ সংস্কারে প্রস্তাব দেয় কমিশনে। জমিয়ত ১৬৬ সুপারিশের ১০৯টিতে একমত পোষণ করেছে। দলটি দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। দেশের নাম ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব করেছে।
মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস ১৬৬ সুপারিশের ১৪৭টিতে একমত। এই দলটিও আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনী সমকালকে বলেছেন, ইসলামপন্থি দল হিসেবে খেলাফত মজলিসের চূড়ান্ত লক্ষ্য খেলাফতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তবে তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্জন করা হবে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারলে জনগণের মতামত এবং সমর্থনে খেলাফত কায়েম করবে খেলাফত মজলিস।