প্রজেক্ট এসথার: যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবাদ রক্ষায় রহস্যময় অস্ত্র
Published: 27th, May 2025 GMT
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। ইতিমধ্যে ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডানপন্থী থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন একটি নীতিপত্র প্রকাশ করেছিল। এর নাম প্রজেক্ট এসথার: ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় একটি জাতীয় কৌশল।
এই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনই সেই গোষ্ঠী, যারা প্রজেক্ট ২০২৫ নামের একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। প্রজেক্টের লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ডানপন্থী একটি রাষ্ট্র গঠন।
বাইবেলের রানি এসথারের নামে নামকরণ করা হয়েছে এই প্রজেক্টের। এসথার মূলত এক ভয়ানক উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছে। আর তা হলো ইসরায়েলের বর্তমান গণহত্যার যেকোনো বিরোধিতাকে অপরাধ হিসেবে দাঁড় করানো। আর একে সামনে রেখে বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি নাগরিক অধিকারগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া।
নীতিপত্রের প্রথম ‘মূলবার্তা’ হলো ‘আমেরিকার ইসরায়েলবিরোধী, জায়নবাদবিরোধী এবং তথাকথিত ‘ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলন’ আসলে এক বিশ্বব্যাপী হামাস সমর্থক নেটওয়ার্ক (গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক-এইচএসএন)-এর অংশ।‘
আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫তবে মজার ব্যাপার হলো বাস্তবে এমন কোনো ‘গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ বলে কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবেই, এর সঙ্গে জড়িত বলে যেসব সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর অস্তিত্বও নিছক কল্পনা। জায়নবাদ আর ফিলিস্তিনি গণহত্যাবিরোধী সবাই এই কল্পনার আওতায় পড়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদি সংগঠন জিউস ভয়েস ফর পিস পর্যন্ত হামাস সমর্থক বলে চিহ্নিত হয়েছে এই এসথার প্রজেক্টের তালিকায়।
প্রজেক্টের দ্বিতীয় মূলবার্তা আরও কৌতূহলোদ্দীপক। এই কথিত হামাস নেটওয়ার্ক নাকি ‘সেসব অ্যাকটিভিস্ট ও পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা সমর্থিত, যারা পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র ধ্বংসে নিবেদিত’। এটি শুনে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কারণ, যে থিঙ্কট্যাংক নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তারাই এখন গণতন্ত্র বাঁচানোর বুলি আওড়াচ্ছে!
এই রিপোর্টে ‘পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র’ শব্দজোড়া অন্তত পাঁচবার এসেছে। অথচ ইসরায়েলি আগ্রাসনে যে হামাসশাসিত গাজা গত ১৯ মাস যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ধ্বংস হয়েছে, এ কথা কে না জানে! দুনিয়াজোড়া অস্ত্রশিল্পের মুনাফার চোখে দেখলে অবশ্য গণহত্যা তো পুঁজিবাদের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা!
যদি ট্রাম্প প্রশাসন এখন এই প্রজেক্ট এসথারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, তবে এর কারণ মূলত শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদের এজেন্ডা। এই এজেন্ডা জায়নবাদের নাম ব্যবহার করে চরম ডানপন্থী লক্ষ্য হাসিল করতে চায়।প্রজেক্ট এসথারের ভাষায়, ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই নাকি ইহুদিবিদ্বেষ। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী একটি ‘জাতীয় কৌশল’ চাইছে—এই কথিত হামাস-সমর্থক নেটওয়ার্কের প্রভাব সমাজ থেকে নির্মূল করতে হবে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ পায় জো বাইডেন প্রশাসনের সময়েই। বাইডেন প্রশাসনকে রিপোর্টে ‘ইসরায়েল-বিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবে গাজায় ইসরায়েলের প্রতিটি অপরাধে তারা একেবারে সক্রিয় সহযাত্রী।
এই নীতিপত্রে বহু সুপারিশ রয়েছে। যেমন ‘যখন হোয়াইট হাউসে কোনো বন্ধু প্রশাসন থাকবে, তখন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিরোধ করতে হবে।’
সাত মাস পর নিউইয়র্ক টাইমস–এর একটি বিশ্লেষণ জানায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর হোয়াইট হাউস এবং রিপাবলিকানরা প্রজেক্ট এসথারের অর্ধেকের বেশি সুপারিশ বাস্তবায়নের ডাক দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিরোধ বন্ধ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিল কেটে নেওয়ার হুমকি। এমনকি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করলেও বৈধ বাসিন্দাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা।
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কথিত এই হামাস-সমর্থক নেটওয়ার্ক ও তাদের সংগঠনগুলো নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈচিত্র্য, সমতা আর অন্তর্ভুক্তি এবং তথাকথিত মার্ক্সবাদী আদর্শের আড়ালে ‘জায়নবাদের বিরুদ্ধে’ বয়ান ছড়াচ্ছে। আর শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, তারা নাকি মার্কিন গণমাধ্যমেও দাপটের সঙ্গে সক্রিয়। বড় হোক কিংবা ছোট—প্রতিটি বিক্ষোভই নাকি তারা সব জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে তুলে ধরতে সক্ষম।
এখানেই অবশ্য রিপোর্ট থেমে থাকেনি। তাদের মতে, এই নেটওয়ার্ক ও সংগঠনগুলো টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইহুদিবিদ্বেষী প্রচার’ অবাধে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ‘হুমকি’ দমন করতে প্রজেক্ট এসথারে রয়েছে বেশ কিছু চরম সুপারিশ।
যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক-সমর্থক শিক্ষক-কর্মী অপসারণ, বিক্ষোভকারীদের এমনভাবে ভীত করা যাতে তাঁরা এইচএসওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকেই ভয় পায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ কনটেন্ট নিষিদ্ধ করা। এর মানে ইসরায়েলিদের হাতে হওয়া গণহত্যা নিয়ে যেকোনো কিছুই ইহুদিবিরোধী হিসেবে গণ্য হবে।
তবু এসব জোরালো প্রচারণার মধ্যেও দ্য ফরোয়ার্ড পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় জানানো হয়—এই প্রজেক্টে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি সংগঠন অংশ নেয়নি বা প্রকাশ্যে এর সমর্থন করেনি। মার্কিন ইহুদিদের এই সংবাদপত্র জানায়, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ইহুদিদের সমর্থন পেতে হিমশিম খেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সংগঠনের মাধ্যমে। এর পুরো মনোযোগ শুধু বামপন্থী ইসরায়েল সমালোচকদের দিকেই। ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ইহুদিবিরোধীদের নিয়ে তারা নিশ্চুপ।
এদিকে এই মাসেই মার্কিন ইহুদি নেতৃত্বের একটি খোলাচিঠিতে সতর্ক করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বহু শক্তি এখন ‘ইহুদি নিরাপত্তা’র কথা বলে আসলে উচ্চশিক্ষা, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাাধীনতা ধ্বংস করতে চাইছে।
যদি ট্রাম্প প্রশাসন এখন এই প্রজেক্ট এসথারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, তবে এর কারণ মূলত শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদের এজেন্ডা। এই এজেন্ডা জায়নবাদের নাম ব্যবহার করে চরম ডানপন্থী লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। ইহুদিবিদ্বেষ বা ইহুদিপ্রীতির কথা সেখানে কেবল বাহানা।
বেলেন ফের্নান্দেস কলাম লেখক, আল–জাজিরা
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন টওয় র ক গণতন ত র ইসর য় ল ড নপন থ জ য়নব দ গণহত য প রক শ স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ