ভারত পাকিস্তানে হামলা চালালে কী হবে
Published: 7th, May 2025 GMT
পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের পদক্ষেপগুলো সাধারণত ঘটে থাকে পরিচিত একটি ছকে। প্রথমে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে হামলা হয়। পাকিস্তানের ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয় নয়াদিল্লি।
এরপর ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজানো শুরু করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশটির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের। সেখানেই তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জয় ছিনিয়ে আনেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির উত্থান এবং সামাজিক মাধ্যমের কারণে এই উন্মাদনা এখন তুঙ্গে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর পরিস্থিতি আবারও একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবারও ভারত থেকে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সামান্য কয়েকজন, যাঁরা তাড়াহুড়া করে নেওয়া কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক, তাঁরাও ভয়াবহ যুদ্ধ না বাধিয়ে কীভাবে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়া যায়, সে কথা ভাবছেন।
একটি বিষয় খোলাসা করা যাক। ভারত যদি পাকিস্তানের ওপর সীমিত আকারে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা কী করতে পারে। এখানে একটি বিষয় হলো সীমিত হামলা যে শেষ পর্যন্ত সীমিতই থাকবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর অর্থ এই নয় যে ভারতের হিসাবে ভুল হবে না। অনেক সময় ভুল হিসাব থেকেই যুদ্ধ শুরু হতে দেখা গেছে।
ধরে নেওয়া যাক, পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভারত। এমনকি তা দিলও। ওই শাস্তি কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তা নেই। তবে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় এই যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে ওই শাস্তি সীমিত হবে। আরেকটু বড় পরিসরে ভাবলে এমনটা মনে করা যায় যে এক পর্যায়ে গিয়ে পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিল তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না। এর ফলে কি ‘যুদ্ধে’ ভারতের জয় হবে? উত্তরটা হবে—হ্যাঁ, যদি তারা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। আর সফল না হলে, উত্তরটা হবে ‘না’।
যদি পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার পর ভারত দেশটিকে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত না রাখতে পারে? ধরা যাক এসব পদক্ষেপ ভারতের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে নয়াদিল্লি। তাহলে যে কাল্পনিক চিত্রপট তৈরি করা যায়, তাতে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে ভারত।
হিসাব জটিল করবে পারমাণবিক অস্ত্রপাকিস্তানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ভারতের যে হিসাব–নিকাশ, তা আরও জটিল করে তুলবে ইসলামাবাদের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র। এর কারণ এটা নয় যে পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা প্রথমে বা সংঘাতের শুরুর দিকে কাজে লাগাতে পারে। বরং কারণ এটি যে দেশটির এই সক্ষমতা রয়েছে এবং হামলাকারীদের তা বিবেচনায় নিয়েই সামনে এগোতে হবে।
২০০১–০২ সালের সংকটের পর থেকেই অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে একটি নীতি অনুসরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। পারমাণবিক হামলা এড়িয়ে কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়েও স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এ থেকে ‘সীমিত যুদ্ধের’ একটি ধারণা সামনে এসেছে। এই ধরনের যুদ্ধ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেন সর্বাত্মক পারমাণবিক হামলা শুরু না হয়।
সীমিত যুদ্ধ দুই ধরনের হতে পারে। এক ধরনের যুদ্ধে দুটি পরাশক্তি সরাসরি মুখোমুখি হয় না। তৃতীয় পক্ষগুলোর মধ্যে এই যুদ্ধ হয়, যেমনটা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এরই মধ্যে ঘটেছে। আরেকটি যুদ্ধ হলো পূর্ণমাত্রায় সংঘাতে না জড়িয়ে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলা। এতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত আকারে ব্যবহার করে দুই পক্ষ। এমন যুদ্ধ হলেও উভয় পক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার ওয়াইনবার্গার ‘প্রাউড প্রফেট’ ছদ্মনামে একটি অতি-গোপনীয় ‘যুদ্ধ মহড়ার’ আয়োজন করেছিলেন। তাতে সীমিত পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের তত্ত্বগুলো যাচাই–বাছাই করা হয়েছিল। ‘প্রাউড প্রফেট’ মহড়ার পর যুদ্ধের দ্বিতীয় ধারণাটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ওই মহড়া–সংক্রান্ত নথিগুলো প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সংঘাতে আধিপত্যতবে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলার পরিকল্পনাও করছে না ভারত। তারা সীমিত আকারে গতানুগতিক হামলা চালাতে চায়। একই সঙ্গে হয়তো তারা এমনভাবে এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে চায় যেন পাকিস্তান পারমাণবিক হামলা করার পর্যায়ে না পৌঁছায়।
এমনকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ও ব্রিটিশসহ পশ্চিমা কৌশলবিদেরা এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে এটা করা সম্ভব। এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে পারবে ভারত, সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে দেশটি এবং সংঘাতে নিজেদের আধিপত্যও ধরে রাখতে পারবে। আর এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নয়াদিল্লির সমস্যার সমাধান হবে।
ভারতের এই সুযোগ রয়েছে যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমিত সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। কারণ, প্রচলিত যুদ্ধ সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে ভারত এমন হামলা চালানোর পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য যথেষ্ট কূটনৈতিক সক্ষমতা দেশটির রয়েছে।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তানের অত্যাধুনিক সমরসজ্জা সংঘাতের শঙ্কা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে১২ ঘণ্টা আগেআর এই হামলায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিশোধ নেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে। কারণ, এ জন্য দেশটিকে বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামরিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পাক, তা চাইবে না তারা। আর পাকিস্তান সংঘাত বৃদ্ধির পথে না এগোলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের আধিপত্য থাকবে।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে সীমিত যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে না–ও থাকতে পারে। দুই পক্ষই রক্ত ঝরাতে ঝরাতে আরও সংঘাতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শুধু আত্মসম্মান নয়, বরং প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধের জন্য তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া সংঘাত থামানোর জন্য প্রস্তুত না–ও থাকতে পারে তারা। আর সংঘাতে দুই পক্ষই যখন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন কোনো একটি পক্ষ যে পরিকল্পনা নিয়ে সংঘাত শুরু করে, তা ভেস্তে যেতে পারে।
আরও পড়ুনভারতে যুদ্ধকালীন তৎপরতার মহড়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্যকে নির্দেশ১৫ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনভারতের মোকাবিলায় ‘ছায়া থেকে প্রকাশ্যে’ বেরিয়ে আসছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি০৫ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নয় দ ল ল পদক ষ প র জন য ধরন র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।