ভারত পাকিস্তানে হামলা চালালে কী হবে
Published: 7th, May 2025 GMT
পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের পদক্ষেপগুলো সাধারণত ঘটে থাকে পরিচিত একটি ছকে। প্রথমে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে হামলা হয়। পাকিস্তানের ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয় নয়াদিল্লি।
এরপর ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজানো শুরু করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশটির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের। সেখানেই তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জয় ছিনিয়ে আনেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির উত্থান এবং সামাজিক মাধ্যমের কারণে এই উন্মাদনা এখন তুঙ্গে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর পরিস্থিতি আবারও একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবারও ভারত থেকে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সামান্য কয়েকজন, যাঁরা তাড়াহুড়া করে নেওয়া কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক, তাঁরাও ভয়াবহ যুদ্ধ না বাধিয়ে কীভাবে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়া যায়, সে কথা ভাবছেন।
একটি বিষয় খোলাসা করা যাক। ভারত যদি পাকিস্তানের ওপর সীমিত আকারে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা কী করতে পারে। এখানে একটি বিষয় হলো সীমিত হামলা যে শেষ পর্যন্ত সীমিতই থাকবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর অর্থ এই নয় যে ভারতের হিসাবে ভুল হবে না। অনেক সময় ভুল হিসাব থেকেই যুদ্ধ শুরু হতে দেখা গেছে।
ধরে নেওয়া যাক, পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভারত। এমনকি তা দিলও। ওই শাস্তি কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তা নেই। তবে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় এই যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে ওই শাস্তি সীমিত হবে। আরেকটু বড় পরিসরে ভাবলে এমনটা মনে করা যায় যে এক পর্যায়ে গিয়ে পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিল তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না। এর ফলে কি ‘যুদ্ধে’ ভারতের জয় হবে? উত্তরটা হবে—হ্যাঁ, যদি তারা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। আর সফল না হলে, উত্তরটা হবে ‘না’।
যদি পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার পর ভারত দেশটিকে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত না রাখতে পারে? ধরা যাক এসব পদক্ষেপ ভারতের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে নয়াদিল্লি। তাহলে যে কাল্পনিক চিত্রপট তৈরি করা যায়, তাতে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে ভারত।
হিসাব জটিল করবে পারমাণবিক অস্ত্রপাকিস্তানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ভারতের যে হিসাব–নিকাশ, তা আরও জটিল করে তুলবে ইসলামাবাদের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র। এর কারণ এটা নয় যে পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা প্রথমে বা সংঘাতের শুরুর দিকে কাজে লাগাতে পারে। বরং কারণ এটি যে দেশটির এই সক্ষমতা রয়েছে এবং হামলাকারীদের তা বিবেচনায় নিয়েই সামনে এগোতে হবে।
২০০১–০২ সালের সংকটের পর থেকেই অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে একটি নীতি অনুসরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। পারমাণবিক হামলা এড়িয়ে কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়েও স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এ থেকে ‘সীমিত যুদ্ধের’ একটি ধারণা সামনে এসেছে। এই ধরনের যুদ্ধ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেন সর্বাত্মক পারমাণবিক হামলা শুরু না হয়।
সীমিত যুদ্ধ দুই ধরনের হতে পারে। এক ধরনের যুদ্ধে দুটি পরাশক্তি সরাসরি মুখোমুখি হয় না। তৃতীয় পক্ষগুলোর মধ্যে এই যুদ্ধ হয়, যেমনটা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এরই মধ্যে ঘটেছে। আরেকটি যুদ্ধ হলো পূর্ণমাত্রায় সংঘাতে না জড়িয়ে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলা। এতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত আকারে ব্যবহার করে দুই পক্ষ। এমন যুদ্ধ হলেও উভয় পক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার ওয়াইনবার্গার ‘প্রাউড প্রফেট’ ছদ্মনামে একটি অতি-গোপনীয় ‘যুদ্ধ মহড়ার’ আয়োজন করেছিলেন। তাতে সীমিত পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের তত্ত্বগুলো যাচাই–বাছাই করা হয়েছিল। ‘প্রাউড প্রফেট’ মহড়ার পর যুদ্ধের দ্বিতীয় ধারণাটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ওই মহড়া–সংক্রান্ত নথিগুলো প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সংঘাতে আধিপত্যতবে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলার পরিকল্পনাও করছে না ভারত। তারা সীমিত আকারে গতানুগতিক হামলা চালাতে চায়। একই সঙ্গে হয়তো তারা এমনভাবে এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে চায় যেন পাকিস্তান পারমাণবিক হামলা করার পর্যায়ে না পৌঁছায়।
এমনকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ও ব্রিটিশসহ পশ্চিমা কৌশলবিদেরা এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে এটা করা সম্ভব। এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে পারবে ভারত, সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে দেশটি এবং সংঘাতে নিজেদের আধিপত্যও ধরে রাখতে পারবে। আর এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নয়াদিল্লির সমস্যার সমাধান হবে।
ভারতের এই সুযোগ রয়েছে যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমিত সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। কারণ, প্রচলিত যুদ্ধ সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে ভারত এমন হামলা চালানোর পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য যথেষ্ট কূটনৈতিক সক্ষমতা দেশটির রয়েছে।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তানের অত্যাধুনিক সমরসজ্জা সংঘাতের শঙ্কা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে১২ ঘণ্টা আগেআর এই হামলায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিশোধ নেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে। কারণ, এ জন্য দেশটিকে বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামরিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পাক, তা চাইবে না তারা। আর পাকিস্তান সংঘাত বৃদ্ধির পথে না এগোলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের আধিপত্য থাকবে।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে সীমিত যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে না–ও থাকতে পারে। দুই পক্ষই রক্ত ঝরাতে ঝরাতে আরও সংঘাতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শুধু আত্মসম্মান নয়, বরং প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধের জন্য তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া সংঘাত থামানোর জন্য প্রস্তুত না–ও থাকতে পারে তারা। আর সংঘাতে দুই পক্ষই যখন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন কোনো একটি পক্ষ যে পরিকল্পনা নিয়ে সংঘাত শুরু করে, তা ভেস্তে যেতে পারে।
আরও পড়ুনভারতে যুদ্ধকালীন তৎপরতার মহড়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্যকে নির্দেশ১৫ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনভারতের মোকাবিলায় ‘ছায়া থেকে প্রকাশ্যে’ বেরিয়ে আসছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি০৫ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নয় দ ল ল পদক ষ প র জন য ধরন র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
সরকার বলছে সম্ভাবনা দলগুলোর সন্দেহ
চট্টগ্রাম বন্দরে চালু থাকা চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই টার্মিনালেই গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানামা হয়েছে এককভাবে। একসঙ্গে এতে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল উপযোগী একটি ছোট জাহাজ নোঙর করা যায়। বন্দরের অন্য কোনো টার্মিনালে নেই এত সুবিধা।
জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার জন্য এ টার্মিনালে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ রয়েছে ১৪টি। অন্যান্য টার্মিনালে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। বছরে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামার সক্ষমতা থাকা এই টার্মিনাল গত বছরও হ্যান্ডল করেছে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার। এই টার্মিনাল থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্বও পাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
‘সোনার হরিণ’ হিসেবে পরিচিত এই টার্মিনাল ঘিরেই এসেছে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। এনসিটি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পনায় পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন মহল। বিদেশি বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনা দেখছে সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এতে পাচ্ছে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’।
বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার উদ্যোগের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করেছে বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-সংগঠন। আজ বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আগামী সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর গেটে বৃহত্তর শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)।
কোন টার্মিনালের কত অবদান
বন্দরের কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটিতে ওঠানামা হলেও তার পাশে থাকা চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ-জিসিবিতে ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করেছে। সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল প্রথম ১০ মাসে তাদের টার্গেটের মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে। ২০২৪ সালের জুন থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত এই টার্মিনাল পরিচালনা করলেও পুরোদমে চালু হয়নি এটি।
বন্দরের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে আংশিক চালু ছিল এনসিটি। পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার কাজ শুরু হয়। এর পরে কমতে থাকে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময়ও। আগে একটি জাহাজ ১২ থেকে ১৫ দিন পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও এখন সেটি নেমে এসেছে দুই থেকে তিন দিনে।
২০০৭ সালে আংশিক চালু হওয়ার প্রথম বছরে এনসিটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ আসে ৪৩৬টি। ২০২৪ সালে এনসিটিতে জাহাজ এসেছে ১ হাজার ২৫০টি। ১৭ বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি এবং বহির্নোঙর মিলিয়ে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৩০০টি।
সবচেয়ে বেশি আয় এনসিটিতে
চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের পাশাপাশি ৩৩টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনও স্থাপন করা হয়েছে এই টার্মিনালে। প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আয় নির্ভর করবে বিদেশিদের সঙ্গে দরকষাকষির ওপর। এই টার্মিনাল পরিচালনা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ দুই বছরে কনটেইনারপ্রতি বিল পেয়েছে ৭০০ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। সব খরচ বাদ দিয়ে গত দুই বছরে তাদের প্রকৃত আয় হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে কনটেইনারপ্রতি বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি মাত্র ১৮ ডলার। সেখানে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে।
চার কারণে বিতর্ক
এনসিটি ঘিরে সরকারের তৎপরতা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ না করা, বন্দরের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার চিন্তা এবং সবচেয়ে বেশি আয় আসা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন– যে টার্মিনালটি ১৭ বছর ধরে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল, সবচেয়ে বেশি আয় এবং কর্মসংস্থান করেছে, সেটি কেন দিতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে। ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে এই টার্মিনালের জন্য। বিদেশি প্রতিষ্ঠান নতুন আর কী বিনিয়োগ করবে এই টার্মিনালে– এই প্রশ্ন সামনে এনেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। নতুন কোনো স্থানে নতুন করে টার্মিনাল করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে আপত্তি নেই তাদের।
সম্ভাবনা দেখছে সরকার
তবে সরকার বলছে, এনসিটির বর্তমান সক্ষমতা ও দক্ষতা আমূল পাল্টে দেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কীভাবে তারা এটা করবে– সেই পরিকল্পনাই তাদের কাছ থেকে চেয়েছে সরকার। যে প্রতিষ্ঠানকে তারা ভাবছে, তারা বিশ্বের সেরা বন্দরগুলোতে কাজ করছে। তাদের কর্মদক্ষতার কারণেই ওইসব বন্দর আছে বিশ্বসেরার তালিকায়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে কারও চাকরি যাবে না। উল্টো কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়বে। বাড়বে সুযোগ-সুবিধা। এমনই মত এই সরকারের।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে গত ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু যে সাইজে এই হৃৎপিণ্ড আছে, তাতে চলে না। এই হৃৎপিণ্ডকে বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড বানাতে হবে। কাজেই আমরা বললাম যে, পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে, আগেই ডাকা হয়েছে; কিন্তু কাজটা ঠিকমতো এগোচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি– এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে বলেছেন, যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে; যেভাবেই হোক।
এর আগে বন্দর পরিদর্শনে এসে অভিন্ন ইচ্ছার কথা বলেছেন বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তারা বিশ্বে ৭০-৮০টি বন্দর পরিচালনা করা দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা এটি শেষ করতে চান। এমন বক্তব্য ও তৎপরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল ইস্যুটি সবার সামনে চলে আসে।
যে পথে হাঁটছে সরকার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের মার্চে নিউমুরিং টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এটি আর বেশি দূর এগোতে পারেনি।
পরে এ কাজ এগিয়ে নিতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভা ডাকার উদ্যোগ নেয় তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মে মাসের মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট-টিএসআর প্রদান করবে। এ প্রতিবেদন অনুমোদনের পর দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। সেপ্টেম্বরে এ ব্যাপারে কনসেশন চুক্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।
যা বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, এনসিটি ভালো করছে; লোকসানেও নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি আয় করছে এই টার্মিনাল দিয়ে। এর মাধ্যমে দক্ষও হয়ে উঠছে তারা। সক্ষমতার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ না পেলে ভবিষ্যতে বিদেশিরা ছেড়ে দিলে পরিচালনায় সংকট তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তাদের মাধ্যমে আমাদের আয়, সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, সেটি যাতে সত্য হয়। সরকারকে এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমাদের অপারেটরদের তুলনায় বাইরের অপারেটররা অনেক বেশি দক্ষ– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও জোরালো হবে। তবে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে কথা বললে আর বিতর্ক থাকত না।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য এবং ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন, এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে। সেটি না করাতে এখানে বিতর্ক হচ্ছে; সন্দেহ বাড়ছে। এই বন্দরই আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ইচ্ছা হলেই কেউ এটা বিদেশিদের দিয়ে দিতে পারে না। এনসিটি না দিয়ে অন্য যেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে, সেই টার্মিনাল দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলেছে, দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক।
বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সমালোচনা করেন।
এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে গত ২০ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগর শাখার আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক তাদের নিজেদের তৈরি করা টার্মিনালে; আমাদের তৈরি টার্মিনালে নয়।