পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা চূড়া ছুঁয়ে যায়। উভয় দেশে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। সীমান্তে গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে; খবর আসছে হতাহতের। ভারতের হামলার কী ধরনের জবাব দেয় পাকিস্তান, তার ওপর যুদ্ধের পরিসর নির্ভর করছে। 

ফোর্বস সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনার ওপর পর্যালোচনা হাজির করা হয়েছে। 

বুধবার (৭ মে) গভীর রাতে পাকিস্তানে হামলার পরই ভারতের সেনাবাহিনী তাদের এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে বলেছিল, “ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” ওই টুইট বার্তায় বলা হয়, ভারত কোনো বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়নি। সন্ত্রাসী আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ভারতে হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা হতো।

আরো পড়ুন:

শ্রীপুরে ছাত্র আন্দোলনে হামলা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতি কী?

ওই বার্তা থেকে ইঙ্গিত মেলে পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৭ জন নিহত হওয়ার বদলা নিয়েছে ভারত। এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান যদি প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তাহলে হামলা হয়তো ওই পর্যন্তই থাকবে। তবে পাকিস্তান সমুচিত জবাব দেওয়ার কথা বলেছে। 

পাকিস্তান দাবি করেছে, তার ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। অবশ্য ভারত এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। 

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ভারত কী করে তার ওপর নির্ভর করবে। তিনি ব্লুমবার্গ টিভিকে বলেন, “ভারত আক্রমণ করলে আমরা জবাব দেব। ভারত যদি পিছু হটে, তাহলে আমরা অবশ্যই পরিস্থিতি গুটিয়ে নেব।”

তবে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি জরুরি বৈঠক করার পর জানিয়েছে, পাকিস্তান এই হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।

বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিতে এই কমিটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানায়, তারা যেন ভারতের ‘উসকানিমূলক ও অবৈধ’ কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং আন্তর্জাতিক মান ও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে জবাবদিহিতার আওতায় আনে।

ভারতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎ কোনো হামলার পরিকল্পনা আছে কি না, তা স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। তবে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং বলেন, “পাকিস্তানের যেকোনো ধরনের আগ্রাসন বা দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের মোকাবিলায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”

পাকিস্তানের ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রাণহানি ও স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর এর সমুচিত জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সেনারা ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণ করে চলেছে; ভারতও পাল্টা গোলা ও গুলি ছুড়ছে। ফলে সীমান্তে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে দুই দেশ।

তবে চিরবৈরী ভারত ও পাকিস্তান বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। দুই দেশ হামলা ও পাল্টা হামলায় প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহার করছে। তবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলে তারা কী পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে; পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কী নীতি রয়েছে দুই দেশের। 

ফোর্বস সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতির বিষয়ে বলা হয়েছে, ভারত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে প্রচলিত নীতি মেনে চলার কথা বলে। ‘প্রথমে ব্যবহার না করার’ (নো ফার্স্ট ইউজ) নীতিতে অটল তারা। এর মানে হলো, ভারত কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না, যদি না তাদের ওপর প্রথমে পারমাণবিক হামলা হয়।

অন্যদিকে, পাকিস্তান এই নীতিতে বিশ্বাস করে না। ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারে ছোট আকারের ট্যাকটিক্যাল ওয়ারহেড আছে বলে ধারণা করা হয়, যেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি, যেমন ছোট ক্ষেপণাস্ত্র ‘নাসর’  দিয়ে এসব অস্ত্র ছোড়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই ধরনের ছোট ওয়ারহেড পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। কারণ- এগুলোর ব্যবহার হলে পরিস্থিতি দ্রুত বৃহৎ পরিসরের পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যা কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্রে বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তেজনার ঝুঁকি বাড়ায়।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (সিআইএ) ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ১৫ লাখ সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনী। অন্যদিকে, পাকিস্তানে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে।

তবে সেনাসংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও ভারতের বাহিনী চীনের সঙ্গে উত্তরের এবং উত্তর-পূর্বের বিতর্কিত সীমান্তে নজর দিতে গিয়ে অনেকটাই ছড়িয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশানল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনসের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারে আনুমানিক ১৬৪টি ওয়ারহেড রয়েছে, আর পাকিস্তানের আছে আনুমানিক ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র।

তবে একটি বড় পার্থক্য হলো, ভারতের রয়েছে একটি পারমাণবিক ট্রায়াড (triad), অর্থাৎ তারা স্থল, আকাশ ও পানির নিচ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ছোড়ার সক্ষমতা রাখে। এই সুবিধা পাকিস্তানের নেই।

৭ মে রাতে পাকিস্তানের ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হতাহতের ঘটনার সমুচিত জবাব দেওয়ার কথা বলেছেন পাকিস্তানের নেতারা। এখন দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরমে রয়েছে; কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলি চালছে, হতাহতের খবরও আসছে।

ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতা এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে একের পর এক বৈঠকের খবর আসছে। সর্বশেষ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ পার্লামেন্টে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে সর্বাত্মক যুদ্ধের ইঙ্গিত নেই। তিনি হামলার জন্য ভারতের কড়া সমালোচনা করেছেন। এই হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ বলে বর্ণনা করেছেন। বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টোও একই সুরে কথা বলেছেন। অবশ্য তিনি বলেছেন, যে যত বড়, তার পতনও তত বড়।

ঢাকা/রাসেল

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবহ র র বল ছ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সরকার বলছে সম্ভাবনা দলগুলোর সন্দেহ

চট্টগ্রাম বন্দরে চালু থাকা চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই টার্মিনালেই গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানামা হয়েছে এককভাবে। একসঙ্গে এতে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল উপযোগী একটি ছোট জাহাজ নোঙর করা যায়। বন্দরের অন্য কোনো টার্মিনালে নেই এত সুবিধা। 

জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার জন্য এ টার্মিনালে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ রয়েছে ১৪টি। অন্যান্য টার্মিনালে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। বছরে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামার সক্ষমতা থাকা এই টার্মিনাল গত বছরও হ্যান্ডল করেছে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার। এই টার্মিনাল থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্বও পাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। 
‘সোনার হরিণ’ হিসেবে পরিচিত এই টার্মিনাল ঘিরেই এসেছে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। এনসিটি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পনায় পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন মহল। বিদেশি বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনা দেখছে সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এতে পাচ্ছে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’।
বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার উদ্যোগের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করেছে বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-সংগঠন। আজ বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আগামী সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর গেটে বৃহত্তর শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)। 

কোন টার্মিনালের কত অবদান
বন্দরের কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটিতে ওঠানামা হলেও তার পাশে থাকা চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ-জিসিবিতে ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করেছে। সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল প্রথম ১০ মাসে তাদের টার্গেটের মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে। ২০২৪ সালের জুন থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত এই টার্মিনাল পরিচালনা করলেও পুরোদমে চালু হয়নি এটি। 
বন্দরের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে আংশিক চালু ছিল এনসিটি। পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার কাজ শুরু হয়। এর পরে কমতে থাকে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময়ও। আগে একটি জাহাজ ১২ থেকে ১৫ দিন পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও এখন সেটি নেমে এসেছে দুই থেকে তিন দিনে। 
২০০৭ সালে আংশিক চালু হওয়ার প্রথম বছরে এনসিটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ আসে ৪৩৬টি। ২০২৪ সালে এনসিটিতে জাহাজ এসেছে ১ হাজার ২৫০টি। ১৭ বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি এবং বহির্নোঙর মিলিয়ে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৩০০টি। 

সবচেয়ে বেশি আয় এনসিটিতে
চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের পাশাপাশি ৩৩টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনও স্থাপন করা হয়েছে এই টার্মিনালে। প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আয় নির্ভর করবে বিদেশিদের সঙ্গে দরকষাকষির ওপর। এই টার্মিনাল পরিচালনা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ দুই বছরে কনটেইনারপ্রতি বিল পেয়েছে ৭০০ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। সব খরচ বাদ দিয়ে গত দুই বছরে তাদের প্রকৃত আয় হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে কনটেইনারপ্রতি বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি মাত্র ১৮ ডলার। সেখানে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে। 

চার কারণে বিতর্ক 
এনসিটি ঘিরে সরকারের তৎপরতা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ না করা, বন্দরের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার চিন্তা এবং সবচেয়ে বেশি আয় আসা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।  
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন– যে টার্মিনালটি ১৭ বছর ধরে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল, সবচেয়ে বেশি আয় এবং কর্মসংস্থান করেছে, সেটি কেন দিতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে। ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে এই টার্মিনালের জন্য। বিদেশি প্রতিষ্ঠান নতুন আর কী বিনিয়োগ করবে এই টার্মিনালে– এই প্রশ্ন সামনে এনেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। নতুন কোনো স্থানে নতুন করে টার্মিনাল করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে আপত্তি নেই তাদের। 

সম্ভাবনা দেখছে সরকার
তবে সরকার বলছে, এনসিটির বর্তমান সক্ষমতা ও দক্ষতা আমূল পাল্টে দেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কীভাবে তারা এটা করবে– সেই পরিকল্পনাই তাদের কাছ থেকে চেয়েছে সরকার। যে প্রতিষ্ঠানকে তারা ভাবছে, তারা বিশ্বের সেরা বন্দরগুলোতে কাজ করছে। তাদের কর্মদক্ষতার কারণেই ওইসব বন্দর আছে বিশ্বসেরার তালিকায়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে কারও চাকরি যাবে না। উল্টো কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়বে। বাড়বে সুযোগ-সুবিধা। এমনই মত এই সরকারের।  

চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে গত ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু যে সাইজে এই হৃৎপিণ্ড আছে, তাতে চলে না। এই হৃৎপিণ্ডকে বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড বানাতে হবে। কাজেই আমরা বললাম যে, পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে, আগেই ডাকা হয়েছে; কিন্তু কাজটা ঠিকমতো এগোচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি– এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে বলেছেন, যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে; যেভাবেই হোক। 
এর আগে বন্দর পরিদর্শনে এসে অভিন্ন ইচ্ছার কথা বলেছেন বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তারা বিশ্বে ৭০-৮০টি বন্দর পরিচালনা করা দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা এটি শেষ করতে চান। এমন বক্তব্য ও তৎপরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল ইস্যুটি সবার সামনে চলে আসে।

যে পথে হাঁটছে সরকার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের মার্চে নিউমুরিং টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এটি আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। 
পরে এ কাজ এগিয়ে নিতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভা ডাকার উদ্যোগ নেয় তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মে মাসের মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট-টিএসআর প্রদান করবে। এ প্রতিবেদন অনুমোদনের পর দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। সেপ্টেম্বরে এ ব্যাপারে কনসেশন চুক্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।

যা বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, এনসিটি ভালো করছে; লোকসানেও নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি আয় করছে এই টার্মিনাল দিয়ে। এর মাধ্যমে দক্ষও হয়ে উঠছে তারা। সক্ষমতার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ না পেলে ভবিষ্যতে বিদেশিরা ছেড়ে দিলে পরিচালনায় সংকট তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তাদের মাধ্যমে আমাদের আয়, সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, সেটি যাতে সত্য হয়। সরকারকে এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমাদের অপারেটরদের তুলনায় বাইরের অপারেটররা অনেক বেশি দক্ষ– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও জোরালো হবে। তবে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে কথা বললে আর বিতর্ক থাকত না।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য এবং ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন, এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে। সেটি না করাতে এখানে বিতর্ক হচ্ছে; সন্দেহ বাড়ছে। এই বন্দরই আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ইচ্ছা হলেই কেউ এটা বিদেশিদের দিয়ে দিতে পারে না। এনসিটি না দিয়ে অন্য যেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে, সেই টার্মিনাল দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। 
সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলেছে, দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক।

বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সমালোচনা করেন।
এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে গত ২০ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগর শাখার আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক তাদের নিজেদের তৈরি করা টার্মিনালে; আমাদের তৈরি টার্মিনালে নয়।

 


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ