সম্প্রতি বেশ কিছু ভোগ্য ও সেবা পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টজন ও দাতাগোষ্ঠী অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশের অতি নিম্ন পর্যায়ের কর-জিডিপি অনুপাত কিংবা অপরাপর সমপর্যায়ের বা প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের অতিনগণ্য রাজস্ব আয় বিবেচনায় করের পরিধি বাড়ানোর সব উদ্যোগের ওপর জোর দিয়ে আসছে। তবে কর বাড়ানোর কথা তাদের কেউই বলেনি। বরং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রায়ই করের হারে সামঞ্জস্য বিধানের কথা বলেছে। এমনকি ট্রেড বেজ্ড মানি লন্ডারিং বা বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার কমানোর জন্য অনেক আন্তর্জাতিক সামষ্টিক অর্থনীতির গবেষক করের হার হ্রাসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। অথচ আমাদের এখানে দেখছি ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ মেরে ফেলার সর্ববিধ উদ্যোগ।
লাতিন আমেরিকা কিংবা মধ্য ইউরোপের কিছু দেশে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্ররোচনা বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় ‘হাইপার ইনফ্লেশন’ বা অতিমাত্রায় মূল্যস্ফীতির কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওইসব দেশে অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষত ছাড়াও ব্যাপক জনঅসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। দাতাগোষ্ঠীর প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশে কেন কাজে আসছে না বা আসবে না– এ নিয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে বলেছেন। আমাদের এই ব্যাপক আয়বৈষম্য আর দারিদ্র্যের দেশে গরিব মানুষদের ‘বোকা’ ভাবা গুরুতর অন্যায় ছাড়াও শাসককুলের জন্য হঠাৎ শনি বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
দুই.
বাংলাদেশে যেমন একদিকে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে; অন্যদিকে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধি নিয়ে সভা-সমিতির সংখ্যাও বেড়েছে। এগুলোর সম্ভবত বহুলাংশে সরকারের তরুণতর অংশের তাড়নাজাত। এটি অবশ্যই ভালো। তবে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী অনেককেই বলতে শুনেছি, সরকারের তরুণতর অংশ লেখাপড়ায় মেধাবী ও স্মার্টদের বাচনভঙ্গি আর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ওপর খুব বেশি জোর দেন। অনেকে কিছুটা বিহ্বলিত হয়ে ইংরেজিতে তাদের তোড়ের কথা বলছেন। বক্তৃতায় ‘সারবস্তু’ নিয়ে ভাবছেন না।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে আমাদের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ছিলেন গ্রিক-আমেরিকান জন ফিলমেরিডিস। তিনি ছিলেন অনেকটা ডিএনএ (ডেইলি নাম্বার অলওয়েজ)। তিনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, ‘ডোন্ট স্পিক ইংলিশ, স্পিক নাম্বারস।’ আমরা ইদানীংকার বাংলাদেশে আবার দেখছি শুধু ইংরেজিতে ‘ভুজুং ভাজুং’ (আমাদের ক্যাডেট কলেজের পিটি-প্যারেডে হাবিলদার মেজর ওস্তাদজিরা এটি ব্যবহার করতেন) করছেন। ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’ প্রশ্নটির উত্তরে জোর দিচ্ছেন না। বাংলা প্রবাদে আছে ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’। আলোচ্যদের দৌড়ও কেন জানি শুধু লিংকডইন পোস্টের বাইরে যেতে পারছে না।
মোটেও আশ্চর্য হবো না, আলোচ্যরা যদি শিগগিরই বিদেশে অযথা বিনিয়োগ সম্মেলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি আপাতত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কিছুটা ক্ষ্যামা দিয়ে যারা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন কিংবা স্থানীয় বড় ব্যবসায়ী আছেন, তাদের দিকে দৃষ্টি দিতে বলব। এতে লাভ হবে; অনেক লাভ হবে। বাংলাদেশে অনেক কষ্ট করে বিরাট একটি ব্যক্তি খাত বিকাশ লাভ করেছে। যে কোনো জাতীয়তাবাদী শক্তির উচিত নীতি-পরিবেশ উন্নত করে সত্যিকার অর্থে তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে দেওয়া।
তিন.
বড়দের বেশির ভাগ যদিও নয়; সরকারের তরুণতর অংশের অনেকেই অনেকটা দাম্ভিকতায় সবজান্তা ভাব করছেন। প্রায় সব বিষয়ে যেন ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’। এটি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। একেকজন নির্দিষ্ট নিজ নিজ দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করলেই অধিকাংশের জন্য মঙ্গল হবে। যা সবার মঙ্গল তা কোনো একজনের একক দায়িত্ব হতে পারে না। কেউ চেষ্টা করলেও তিনি ব্যর্থ হবেন– ইতিহাস বলে । হয়তো বাতির নিচেই থেকে যাবে অন্ধকার। তারা যদি জনকল্যাণে ব্রতী না হয়ে নিজের খ্যাতি বা সুগন্ধ ছড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে সাধারণ মানুষ আরও পিছিয়ে পড়বে।
চার.
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে অনিয়ম খুঁজে বের করার জন্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক হিসাব ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছে। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, তারা অতীতের মতো কিছু ‘টায়ার্ড’ হয়ে ‘রিটায়ার্ড’ হওয়া সরকারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে এ জন্য বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। অতীতে এসব তদন্ত কমিটি ‘বিরাগ’ কিংবা ‘অনুরাগ’–এর বশবর্তী না হয়ে কোনো কাজ করতে পারেনি কিংবা তাদের হয়তো বিশেষ বিশেষ বিষয়ে সক্ষমতা বা জ্ঞানেরও অভাব ছিল। এখন থেকে আমাদের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) উচিত স্থানীয় হিসাব প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ফরেনসিক অডিটে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উৎসাহিত বা প্রণোদিত করা।
পাঁচ
নতুন সরকারের সময় অনেক বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আপদে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা হয়তো সংগত কারণেই হয় জেলে গেছেন কিংবা বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে সমস্যায় পড়েছে তাদের হাজার হাজার কর্মী, জোগানদার, ঋণদাতা ব্যাংক আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাদের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী। এতে কর্মীদের মধ্যে যেমন ‘প্যানিক’ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও ভুল বার্তা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকদের অনেক বুঝে-শুনে এগোতে হবে। জোর করে যেনতেন প্রশাসক বা স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়ে দিলেই হবে না; তাদের অতীতে সমপর্যায়ের কাজের দক্ষতা বা ‘কোর কম্পিটেন্স’ বিবেচনায় নিতে হবে। কিছুতেই ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’ বা ব্যবসায়ের চলতি ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।
তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রচলিত বিধি-নিষেধ আবার খতিয়ে দেখতে হবে। বিবিধ প্রচলিত চুক্তির ব্যত্যয় ঘটছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘উট পাখি’তুল্য ব্যবহার মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। সব দেশি-বিদেশি অংশীজনকে সমঝোতায় নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। বন্ধ ব্যাংকের একটি ট্যাগলাইন আমার অনেক মনে ধরেছে– ‘সবাকার ভালা, আপনার ভালা’।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আগামী সপ্তাহে চীনে ৫০ টন আম রপ্তানি করবে বাংলাদেশ: কৃষি সচিব
আম উৎপাদনে শীর্ষ দশে থাকলেও নানা বাধায় রপ্তানিতে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে বর্তমান সরকার চীনকে আম রপ্তানির নতুন গন্তব্য বানাতে চায়। এতে রপ্তানিকারকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। গুণগত মান ঠিক রেখে আম উৎপাদন করে রপ্তানিতে এবার রেকর্ড গড়তে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়।
বুধবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, আগামী বুধবার চীনে প্রথমবারের মতো প্রায় ৫০ টন আম রপ্তানি করবে বাংলাদেশ। এছাড়াও কাঁঠাল ও লিচু রপ্তানির বিষয়েও ভাবছে সরকার।
কৃষি সচিব বলেন, দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে কীভাবে আমের রপ্তানি বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। গত বছর ধান আমদানি করতে হলেও, এ বছর আর তা প্রয়োজন হচ্ছে না।
ড. এমদাদ উল্লাহ বলেন, ডলার সংকটের কারণে এক সময় সারের ঘাটতি ছিল, তবে এখন সেই সমস্যা নেই। সরকার নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এই সংকটের সফল সমাধান করেছে। স্মরণকালের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি শাকসবজি উৎপাদন হয়েছে এবং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সরকার কৃষি খাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। কৃষিকে জনপ্রিয় করতে অ্যাপসের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়াও বিমান ভাড়া কমানোর লক্ষ্যে কার্গো বিমান ব্যবস্থার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, আমাদের ডেল্টা প্ল্যান রয়েছে, সেখানে আমাদের কৃষিকে অঞ্চলভিত্তিক ছয়টি হটস্পটে ভাগ করা হয়েছে। ছয়টি হটস্পটকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা করে দেখেছি। যে নতুনত্বের কথা বলা হচ্ছে, মূল সংযোজন কীভাবে করা যায় এবং কীভাবে অগ্রসর হলে কৃষির সার্বিক উন্নয়ন হবে, সেটিকে আমরা নয়টি থিমেটিক এরিয়ায় শনাক্ত করেছি।
নয়টি থিমেটিক এলাকায় ২৫টি উপখাত নিয়ে ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যদি এগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের প্রয়োজন। এজন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও সেটা করতে গিয়ে আমাদের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নির্দিষ্ট কাঠামোগত পরিকল্পনা এখনো তৈরি করতে পারিনি। সেটি নিয়েই আমরা কাজ করছি।
এখন আমরা ২৫ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি কৃষি কৌশলগত পরিকল্পনা বা পারসপেক্টিভ প্ল্যানের উন্নয়ন ঘটাতে চাই। ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর জনসংখ্যা কত বাড়ছে সেটি হিসাব করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বা বিভাগগুলো মৌলিক খাদ্য নিশ্চিতের জন্য যে কাজগুলো করে থাকে তার আইটেমগুলো শনাক্ত করে সেগুলোর চাহিদাকে শনাক্ত করতে চাই, যোগ করেন কৃষি সচিব।